সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

রোজা পালনে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীদের করণীয়

নতুনধারা
  ১৩ মার্চ ২০২৪, ০০:০০

চলছে পবিত্র রমজান মাস। সারা বিশ্বের প্রায় ৫০ মিলিয়ন মুসলমান রোজা রাখছেন। অধিকাংশ ডায়াবেটিস রোগীই রোজা রাখতে পারেন না। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তির শারীরিক অবস্থার ওপর নির্ভর করে তিনি রোজা রাখতে পারবেন কিনা। সেজন্য প্রয়োজন রোজা শুরু হওয়ার বেশ কিছুদিন আগেই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে যাচাই-বাছাই করে নিয়ে তারপর তিনি রোজা রাখতে সক্ষম কিনা, রোজাতে কী কী নিয়মকানুন মেনে চলবেন, মুখে খাওয়ার ওষুধ কিংবা ইনসুলিন কীভাবে নেবেন ইত্যাদি ইত্যাদি। রোগীর বিগত দিনগুলোতে ডায়াবেটিসের অবস্থা, ডায়াবেটিস সংক্রান্ত জটিলতা, ডায়াবেটিসের পাশাপাশি অন্যান্য রোগ, রক্তে লিপিডের পরিমাণ, রক্তচাপ ইত্যাদি সবকিছু বিবেচনা করে চিকিৎসক সিদ্ধান্ত দিয়ে থাকেন রোগীটি রোজা রাখতে পারবে কি পারবে না।

যেসব ব্যক্তির ডায়াবেটিস একেবারেই নিয়ন্ত্রণে থাকে না, অতিসম্প্রতি ডায়াবেটিক কিটো-এসিডোসিস হয়েছে- তাদের রোজা রাখা উচিত নয়। তাছাড়া যেসব ডায়াবেটিস রোগীর কোনো অর্গান ফেইলিওরের ইতিহাস, যেমন : হার্ট ফেইলিওর, কিডনি ফেইলিওর, লিভার ফেইলিওর ইত্যাদি রোগ আছে তাদেরও রোজা না রাখাই উত্তম। এছাড়াও যাদের চোখের রেটিনায় সমস্যা, স্নায়ুবিক দুর্বলতা, রক্তনালিতে সমস্যা, তীব্র পেপটিক আলসার, ফুসফুসের যক্ষ্ণা, তীব্র ইনফেকশান, মারাত্মক হাঁপানি, ক্যানসারে আক্রান্ত, সম্প্রতি হার্ট অ্যাটাক কিংবা স্ট্রোক হয়েছে, লিভারে সমস্যা রয়েছে, অতি দুর্বল স্বাস্থ্যের অধিকারী, পূর্ববর্তী গর্ভকালীন সময়ে ডায়াবেটিসের ইতিহাস ছিল, অনিয়ন্ত্রিত মৃগীরোগ এবং মারাত্মক মানসিক সমস্যা রয়েছে- তাদেরও রোজা পালনে নিরুৎসাহিত করা হয়। গর্ভবতী এবং শিশুকে যারা বুকের দুধ পান করান তাদেরও রোজা পালনে নিরুৎসাহিত করা হয়।

রোজা পালনকালে ডায়াবেটিস রোগীদের ঝুঁকিসমূহ:

দ্ব রক্তে গস্নুকোজের পরিমাণ অতিরিক্ত কমে যাওয়া বা হাইপোগস্নাইসেমিয়া।

দ্ব রক্তে গস্নুকোজের পরিমাণ অতিরিক্ত বেড়ে যাওয়া বা হাইপারগস্নাইসেমিয়া।

দ্ব পানি স্বল্পতা।

দ্ব ওজনের তারতম্য ঘটা।

দ্ব রমজানে ডায়াবেটিস রোগীর যে সমস্যাটি নিয়ে চিকিৎসকরা সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন থাকেন- তা হচ্ছে 'হাইপোগস্নাইসেমিয়া' বা রক্তে গস্নুকোজ বা সুগারের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে কমে যাওয়া। হাইপোগস্নাইসেমিয়া এত মারাত্মক হতে পারে যে, রোগী কোমায় চলে যেতে পারে- যা তার মস্তিষ্কে মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে।

প্রতিটি ডায়াবেটিস রোগী এবং তার পরিবারের সদস্যদের হাইপোগস্নাইসেমিয়া হলে কি কি লক্ষণ প্রকাশ পায় এবং হলে কী করণীয় তা অবশ্যই জানা প্রয়োজন।

সবচেয়ে কমন যে লক্ষণগুলো প্রকাশ পায় :

হ অতিরিক্ত ঘাম, হ হাত-পা কাঁপতে থাকা, হ বুক ধড়ফড় করা, হ বেশি ক্ষুধা লাগা, হ অস্বাভাবিক উদ্বিগ্নতা, হ ঝিমাতে থাকা, হ কথা জড়িয়ে যাওয়া, হ মনোযোগ ঘাটতি, হ অল্পতেই রেগে যাওয়া, হ বমি বমি ভাব, হ মাথা ব্যথা / মাথা ঘোরা ইত্যাদি।

যে কোনো সময় রক্তে গস্নুকোজের মাত্রা ৩.৯ মিলিমোল/লিটারের নিচে নেমে গেলে অর্থাৎ রোগীর হাইপোগস্নাইসেমিয়া হলে সঙ্গে সঙ্গেই রোজা ভেঙে ফেলতে হবে এবং এক গস্নাস ফ্রেশ পানিতে ৪-৬ চামচ গস্নুকোজ মিশিয়ে খেয়ে নিতে হবে।

ডায়াবেটিস রোগীদের রোজা রাখলে বেশ কিছু উপকার হয়ে থাকে :

দ্ব রোজা শরীরের বিপাকীয় কাজের উন্নতি ঘটায়।

দ্ব শরীরের অতিরিক্ত ওজন কমাতে সাহায্য করে।

দ্ব উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে।

দ্ব নিয়মানুবর্তিতার এক অনন্য চর্চা হয়। আর নিয়মানুবর্তিতা ডায়াবেটিসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা।

রোজা পালন কালে ডায়াবেটিস রোগীদের করনীয় :

দ্ব বেশি পরিমাণ শর্করা ও চর্বিযুক্ত খাবার খাওয়া যাবে না।

দ্ব মিষ্টি জাতীয় খাবার কম খেতে হবে।

দ্ব মিষ্টি পানীয় পরিহার করতে হবে। মিষ্টি শরবতের পরিবর্তে ডাবের পানি পান করা যেতে পারে।

দ্ব ইফতার থেকে সেহরির মধ্যবর্তী সময়ে প্রচুর পানি পান করতে হবে। সেহরি যতটা সম্ভব দেরিতে খেতে হবে আর ইফতার যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি করতে হবে। হাইপোগস্নাইসেমিয়া প্রতিরোধে এটি খুবই কার্যকরী উপায়।

দ্ব রোজা রেখে স্বাভাবিক কাজগুলো করতে কোনো বাধা নেই। তবে অতিরিক্ত শারীরিক পরিশ্রম হাইপোগস্নাইসেমিয়ায় আক্রান্ত করতে পারে। তাই দিনের বেলায় অতিরিক্ত শারীরিক পরিশ্রম না করাই ভালো। ইফতার এবং সেহরির মধ্যবর্তী সময়ে ঘণ্টাখানেকের জন্য শরীরচর্চা করা যেতে পারে।

দ্ব যারা নিয়মিত প্রতিদিন সকালে গিস্নপিজাইড, গস্নাইক্লাজাইড, গিস্নমেপেরাইড জাতীয় ওষুধ সেবন করতেন, তারা একই ডোজে ইফতারের সময় সেটা খাবেন। যারা দুইবেলা খেতেন, সকালে ও রাতে- তারা সকালের ডোজের পুরোটা ইফতারের সময় খাবেন। তবে রাতের ডোজের 'অর্ধেকটা' সেহরির সময় খাবেন।

দ্ব যারা মেটফরমিন জাতীয় ওষুধ দিনে ১ বেলা খেতেন সেটি ইফতারের পর খাবেন। যারা দিনে দুইবেলা খেতেন তারা একটি ইফতারের পর এবং একটি সেহরির পর খাবেন। আর যারা ৩ বেলা ৫০০ মিলিগ্রামের একটি করে ট্যাবলেট খেতেন, তারা ইফতারে একসঙ্গে দুইটি ট্যাবলেট অর্থাৎ মোট ১০০০ মিলিগ্রাম খাবেন। আর সেহরিতে ৫০০ মিলিগ্রামের ১টি ট্যাবলেট খাবেন।

দ্ব যারা লিনাগিস্নপ্টিন জাতীয় ওষুধ খেতেন তাদের ডোজের পরিবর্তন হবে না। একই ওষুধটি একই ডোজে ইফতারে বা সেহরিতে খাবেন।

দ্ব যারা ইম্পাগিস্নফ্লোজেন জাতীয় ওষুধ খেতেন তারা একই ডোজে ইফতারে খাবেন-? তবে এই ওষুধ যারা খাচ্ছেন তারা অবশ্যই পর্যাপ্ত পানি পান করবেন।

দ্ব যারা দুইবেলা ইনসুলিন নিয়ে থাকেন, সকালের ডোজের সমপরিমাণ ইফতারের আগে নেবেন। আর রাতের ডোজের 'অর্ধেক' পরিমাণ সেহরির সময় নেবেন।

ডা. আবু হেনা মোস্তফা কামাল

উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা, নীলফামারী সদর, নীলফামারী।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে