মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

বিশ্বসাহিত্যে শীত ঋতুর জয়জয়কার

সাইফুল ইসলাম
  ০৬ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০

প্রকৃতি সব দেশে সব পারিপার্শ্বিকতায় সব ঋতুকে তার আশীর্বাদে ধন্য করেছে। বসন্ত, গ্রীষ্ম, শরৎ বা শীতকাল, যে ঋতুই হোক না কেন মানুষ কখনো এর থেকে বিমুখ হয়নি কিংবা প্রকৃতিও নিরন্তর চরম রুদ্র রূপ ধারণ করে মানুষকে বিপর্যস্ত করে তোলেনি। আধুনিক মানুষ তার বৈষয়িক প্রাপ্তির তৃষ্ণা মিটাতে মানব মনের সব সুকুমার বৃত্তি বিসর্জন দিয়েছে। কিন্তু মানুষের এ পরিবর্তনের জন্য প্রকৃতিকে দোষারোপ করা যায় না কিছুতেই। এ প্রসঙ্গে ওয়ার্ডস ওয়ার্থ বলেছেন,‘Nature never did betray the heart that loved her.’ প্রকৃতি যে রূপ-সুষমায় মানুষের মনকে আপস্নুত করে তার মধ্যে শীতের সৌন্দর্য উলেস্নখযোগ্য। শীতের সুষমা কবি-সাহিত্যিকদেরও মন কেড়েছে। আবার কখনো কখনো শীতকাতর মানুষের দুঃখ-যাতনায় তারা ব্যথিত হয়েছেন। যুগে যুগে শীত ঋতু স্থবিরতা, ঊষরতা, বিলীন হয়ে যাওয়ার উপমা-রূপক-অলঙ্কার সৃজনে সাহিত্যিকদের রসদ জুগিয়েছে। একজন সাধারণ মানুষের কাছে একটা ঋতু বছরের ভিন্ন সময়ের পরিক্রমা ছাড়া আর কিছুই নয়, কিন্তু একজন লেখকের কাছে ঋতু হলো উদ্‌যাপন, বিরহকাতরতা, শোক, স্মরণ ও চোখের তৃষ্ণা মেটানোর উপলক্ষ। ঋতু পরিক্রমায় শীতঋতু অমানিশা কাল হিসেবে সাধারণ্যে বিবেচিত হলেও বিশ্বসাহিত্যে শীতের সৌন্দর্য ও আবহ নিয়ে সৃজনের অনেক উদাহরণ রয়েছে। মার্কিন কবি রবার্ট ফ্রস্টের‘Stopping by Woods on a Snowing Evening’ কবিতাটি সম্পর্কে সাহিত্য অনুরাগীদের সবাই অবগত। পিভি শেলী শীত ঋতু সম্পর্কে আশা জাগানিয়া ‘O wind, If winter comes can spring be far behind...’ বেশ জনপ্রিয়। শেক্সপিয়ার শীতের ওপর ভিত্তি করে লিখেছেন তার অনবদ্য নাটক,'The Winter's Tale’, , ইমোজেন রবার্টসন তার ‘The Paris Winter’ উপন্যাসে বিশ শতকের প্যারিসের ইতিহাস বর্ণনার পাশাপাশি শীতের অনুপম সৌন্দর্যের বর্ণনা দিয়েছেন। ১৯৪০ সালে স্প্যানিশ মুক্তিযুদ্ধ শেষে ইউরোপে ফরাসি সেনাবাহিনীর দাপট নিয়ে সি জে স্যানসম লিখেছেন আন্তর্জাতিক বেস্ট সেলার Winter in Madrid.’ বিখ্যাত কাশ্মিরী-আমেরিকান কবি আগা শহিদ আলী কাশ্মীরের শীতকাল নিয়ে লিখেছেন। শহিদ আলীর কাব্য তালিকায় কাশ্মিরের সব ঋতুর বর্ণনা থাকলেও তার শীত ঋতুর বর্ণনা অনন্যতার দাবিদার। তিনি তার ্তুডরহঃবৎসবহ্থ কবিতায় লিখেছেন, ‘Snow gleams as if a lover's gaze has fallen to earth./How the season whitens...’ বাংলা সাহিত্যেও দেখা যায় শীত ঋতুর জয়জয়কার। মধ্যযুগে, বিশেষ করে মঙ্গলকাব্যে বারবার ওঠে এসেছে বছরের পঞ্চম ঋতু শীতের কথা। পরবর্তীতে আধুনিক বাংলা কবিদের লেখায়ও শীত আবহের উপস্থিতি দেখা যায়। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, 'শীতের হাওয়া হঠাৎ ছুটে এলো/গানের হাওয়া শেষ না হতে।/মনের কথা ছড়িয়ে এলোমেলো।/ভাসিয়ে দিল শুকনো পাতার স্রোতে। জসিম উদ্‌?দীনের কবিতায় আমরা শীতকে পাই আমাদের স্বদেশি আবহে। শীতকালের যে অন্তরঙ্গ বর্ণনা তার কবিতায় প্রকাশ পেয়েছে, বাংলা সাহিত্যে আর কোনো কবি এভাবে লিখেছেন বলে মনে হয় না। কবির 'রাখাল ছেলে' কবিতা থেকে একটি উদ্ধৃতি এখানে যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক- 'ঘুম হতে আজ জেগেই দেখি শিশির-ঝরা ঘাসে,/সারা রাতের স্বপন আমার মিঠেল রোদে হাসে।' কবির বিখ্যাত 'নিমন্ত্রণ' কবিতায় আছে শীতের অনুষঙ্গ- 'তুমি যদি যাও দেখিবে সেখানে মটর-লতার সনে,/ সিম আর সিম হাত বাড়ালেই মুঠি ভরে সেইখানে।/তুমি যদি যাও সে-সব কুড়ায়ে,/নাড়ার আগুনে পোড়ায়ে পোড়ায়ে,/খাব আর যত গেঁয়ো চাষীদের ডাকিয়া নিমন্ত্রণে,/হাসিয়া হাসিয়া মুঠি মুঠি তাহা বিলাইব জনে জনে।' রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ 'শীতরাত' কবিতায় লিখেছেন, 'এইসব শীতের রাতে আমার হৃদয়ে মৃতু্য আসে;/বাইরে হয়তো শিশির ঝরছে, কিংবা পাতা। ' তার কবিতায় ঘুরে ঘুরে এসেছে ্তুপউষের ভেজা র্ভোথ, ্তুনোনাফল্থ, 'আতাবন', 'চুলের উপর তার কুয়াশা রেখেছে হাত', 'ঝরিছে শিশির', 'পউষের শেষরাতে নিমপেঁচাটি'। ্তুএইসব ভালো লাগে' কবিতায় জীবনানন্দ লিখেছেন, 'জানালার ফাঁক দিয়ে ভোরের সোনালি রোদ এসে/আমারে ঘুমাতে দেখে বিছানায়, আমার কাতর চোখ, আমার বিমর্ষ চুল/এই নিয়ে খেলা করে; জানে সে যে বহুদিন আগে আমি করেছি কী ভুল/পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমাহীন গাঢ় এক রূপসীর মুখ ভালোবেসে,/পউষের শেষরাতে আজো আমি দেখি চেয়ে আবার সে আমাদের দেশে...।' আবিদ আজাদ তার কবিতায় লিখেছেন, ্তুসব মরবে এবার শীতে/কেবল আমার ফুসফুসের পাতাঝরার শব্দ ছাড়া।্থ রুদ্র মুহম্মদ শহিদুলস্নাহ লিখেছেন, ্তুআমিও সারারাত মৃত মানুষের শীতে- শীতার্দ্র হয়েছিলাম।' শীত ঋতু বিশ্ব সাহিত্যে এতটা স্থান করে নিয়েছে যে তার বর্ণনা স্বল্প পরিসরে তুলে ধরা এক কথায় অসম্ভব। আমরা শুধু বলতে পারি, শীত কেবল রিক্ততার ঋতু নয়- এক পরাবাস্তব আবহের ঋতু, ফুল ফসলের আশা জাগানিয়া ঋতু, অলৌকিক ভাবনার আবেশ জাগানিয়া ঋতু! জয়তু রিক্ততার রানি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে