রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

খোকা থেকে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ

জ্যোতিষ সমাদ্দার বাবু
  ০৯ মার্চ ২০২৪, ০০:০০

পঞ্চান্ন বছরের যাপিত জীবন ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের, যা সময়ের বিচারে বেশ সংক্ষিপ্ত। কিন্তু জীবনের দৈর্ঘ্যের চেয়ে তার কর্মের পরিধি ছিল হাজার গুণ বেশি। ইংরেজিতে যাকে বলা হয়- খধৎমবৎ :যধহ ষরভব অর্থাৎ জীবনের চেয়ে বড়। অল্প কথায় এ মহান নেতার বঙ্গবন্ধু উপাধি নিয়ে সংক্ষিপ্তভাবে আলোচনা নিয়ে আসছি এই লেখায়।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার রাজনৈতিক জীবনের চার হাজার ৬৮২ দিন কারাভোগ করেছেন। এর মধ্যে বিদ্যালয়ে ছাত্র অবস্থায় ব্রিটিশ আমলে সাত দিন আর বাকি চার হাজার ৬৭৫ দিন তিনি কারাভোগ করেন পাকিস্তান সরকারের আমলে। জীবনের প্রায় ১৩ বছর কারাগারে ছিলেন তিনি, বঙ্গবন্ধুর লেখা কারাগারের রোজনামচা বই ও বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত থেকে জানা। সবশেষে ১৯৭২ সালের ৭ জানুয়ারি পাকিস্তান কারগার থেকে মুক্তি পান এবং ১০ জানুয়ারি সদ্য স্বাধীন দেশ বাংলাদেশে ফিরে আসেন।

স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা, হিমালয় উচ্চতার মানুষ হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ বুধবার (বাংলা তারিখ ৪ চৈত্র, ১৩২৬) এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার জন্মস্থান অবিভক্ত ভারতবর্ষে বাংলা প্রদেশের ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহাকুমা (বর্তমান জেলা) টুঙ্গিপাড়া গ্রামে। গোপালগঞ্জ মিশনারি হাইস্কুলে বঙ্গবন্ধু সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হন। এই মিশনারি স্কুলে পড়াশোনাকালীন অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী স্কুল পরিদর্শনে গেলে ছাত্রাবাসের ছাদ দিয়ে পানি পড়া এবং তা সারাবার জন্য বঙ্গবন্ধু স্কুল ছাত্রদের পক্ষ থেকে দাবি তুলে ধরেন।

উচ্চশিক্ষার উদ্দেশে ১৯৪৭ সালে বিএ পাস করেন। ওই বছর ভারত বিভাগের পর শেখ মুজিবুর রহমান আইন অধ্যয়নের উদ্দেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তবে ১৯৪৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এনে তাকে বহিষ্কার করায় আইন পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি। যদিও ২০১০ সালে এই বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে স্থাপন করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু চেয়ার।

বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ সংগ্রামী রাজনৈতিক জীবনের ঊপাধি উপহার স্বরূপ ১৯৬৯ সালের ২ ফেব্রম্নয়ারি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তাদের প্রিয় নেতা শেখ মুজিবকে সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা জানাবে। সেই সিদ্ধান্ত অনুসারেই রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ২৩ ফেব্রম্নয়ারি বিকাল ৩টায় সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা সভার আয়োজন করা হয়। এদিকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ও বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবি জোরাল হলে ২২ ফেব্রম্নয়ারি জনগণের অব্যাহত চাপের মুখে পাকিস্তান সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে বঙ্গবন্ধুসহ অন্যান্য আসামিকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।

'বঙ্গবন্ধু' উপাধি ভূষিত : ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রম্নয়ারি রেসকোর্স (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ময়দানে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে লাখ লাখ ছাত্র জনতার সংবর্ধনা সমাবেশে শেখ মুজিবুর রহমানকে আনুষ্ঠানিকভাবে 'বঙ্গবন্ধু' উপাধিতে ভূষিত করা হয়। এই ঘোষণা দেন বর্তমান আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা সংসদ সদস্য তোফায়েল আহমেদ। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানের ভাষণে ছাত্রসমাজের ১১ দফা দাবির প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানান।

সেই জনসমুদ্রে লাখ লাখ লোক এসেছে প্রিয় নেতা শেখ মুজিবকে এক নজর দেখতে। প্রিয় নেতাকে নিয়ে মঞ্চে উঠে চিরাচরিত প্রথা ভঙ্গ করে আগেই সভাপতির ভাষণ দেওয়ার জন্য মঞ্চে দাঁড়িয়ে লাখ লাখ মানুষকে অনুরোধ জানিয়ে তোফায়েল আহমেদ বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে তুমি বলার অনুমতি নিয়ে বলেছিলেন, 'প্রিয় নেতা তোমার কাছে আমরা ঋণী, বাঙালি জাতি চিরঋণী। এই ঋণ কোনোদিনই শোধ করতে পারব না। সারা জীবন এই ঋণের বোঝা আমাদের বয়ে চলতে হবে। আজ এই ঋণের বোঝাটাকে একটু হালকা করতে চাই। জাতির পক্ষ থেকে তোমাকে একটা উপাধি দিয়ে।' যে নেতা তার জীবনের যৌবন কাটিয়েছেন পাকিস্তানের বিভিন্ন কারাগারে, ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে মৃতু্যকে আলিঙ্গন করেছেন, সেই নেতাকে কৃতজ্ঞ বাঙালি জাতির পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞচিত্তে 'বঙ্গবন্ধু' উপাধিতে ভূষিত করা হলো। লাখ লাখ লোক তুমুল করতালির মধ্য দিয়ে এই প্রস্তাব গ্রহণ করে প্রিয় নেতাকে 'বঙ্গবন্ধু' উপাধিতে ভূষিত করে লাখ লাখ কণ্ঠে ধ্বনি তুলেছিল, 'জয় বঙ্গবন্ধু।'

১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃতু্যবার্ষিকী উপলক্ষে আওয়ামী লীগের আলোচনা সভায় বঙ্গবন্ধু পূর্ব বাংলার নামকরণ করেন 'বাংলাদেশ'। তিনি বলেন, 'এক সময় এ দেশের বুক হইতে, মানচিত্রের পৃষ্ঠা হইতে 'বাংলা' কথাটির সর্বশেষ চিহ্নটুকুও চিরতরে মুছিয়া ফেলার চেষ্টা করা হইয়াছে। একমাত্র 'বঙ্গোপসাগর' ছাড়া আর কোন কিছুর নামের সঙ্গে 'বাংলা' কথাটির অস্তিত্ব খুঁজিয়া পাওয়া যায় নাই। জনগণের পক্ষ হইতে 'আমি ঘোষণা করিতেছি, আজ হইতে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশটির নাম 'পূর্ব পাকিস্তানে'র পরিবর্তে শুধুমাত্র 'বাংলাদেশ'।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে