শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কিশোর অপরাধ দমনে পরিবার ও আইনের ভূমিকা সমান্তরাল

অ্যাডভোকেট মো. সাইফুদ্দীন খালেদ
  ০১ ডিসেম্বর ২০২০, ০০:০০

দেশের কোমলমতি শিশু-কিশোররাই দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ কর্ণধার। তাদের উন্নতি ও অগ্রগতির ওপর নির্ভর করে দেশ ও জাতির উন্নতি। সেই শিশু-কিশোর যথোপযুক্ত ভবিষ্যৎ নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য পরিবার, সমাজ, জাতি ও রাষ্ট্র সঠিক কর্মপন্থা ও নীতি আজও নিরূপণ করতে পেরেছে কি?

উপযুক্ত শিক্ষার অভাবে তাদের মধ্যে বখাটেপনা এবং নিত্য-নতুন অপরাধপ্রবণতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে ক্রমেই। সম্প্রতি বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে উঠতি বয়সের কিশোরদের জড়িয়ে পড়ার ঘটনা ঘটছে। কখনো ওরা সংঘবদ্ধ হয়ে অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। চুরি, ছিনতাই থেকে শুরু করে ধর্ষণ, ডাকাতি, মাদক পাচার, খুনের মতো ঘটনার সঙ্গে জড়িত হচ্ছে।

ক্রমবর্ধমান হারে কিশোর অপরাধ যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে তার ফলে এটি অল্প সময়ের মধ্যেই একটি মারাত্মক সামাজিক ব্যাধি হিসেবে পরিণত হতে পারে। যা একটি সমাজ বা রাষ্ট্রের সামগ্রিক কল্যাণের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার, অর্থনৈতিক দৈন্যদশা, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, যৌথ পরিবার প্রথার বিলুপ্ত, যথাযথ অভিভাবকত্ব না থাকা এবং সামাজিক অস্থিরতা ও অবক্ষয় এ সব অপরাধ এবং বখাটেপনার সৃষ্টি করছে।

দেশের বিভিন্ন স্থানে সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্ব, রাজনৈতিক গ্রম্নপিং, প্রেম-মোবাইল ইত্যাদি প্রতিহিংসার কারণে কিশোর হামলা, নির্যাতন, হত্যা, অপহরণ, ছিনতাই প্রভৃতি অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। কিশোর অপরাধের ক্ষেত্রে সঙ্গদলের প্রভাব একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এলাকার কথিত বড় ভাইদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ের কারণে এ সব কিশোররা ক্রমেই বেপরোয়া হয়ে ওঠে। ফলে তাদের ভবিষ্যৎ বিপন্ন এবং পরিবারের শান্তি-স্বস্তি বিনষ্ট হওয়া ছাড়াও সমাজে নৈরাজ্য ও নিরাপত্তাহীনতা বাড়ছে। বিশেষত সাম্প্রতিককালে কিশোর অপরাধ এ দেশে একটি জাতীয় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা দল বাঁধছে এবং একদল অন্যদলের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়াচ্ছে। খুনের মতো সহিংসতায় মেতে উঠতে তাদের বাধছে না।

আইনের বিধান মতে- ১৮ বছর বয়স পূর্ণ হওয়ার আগ পর্যন্ত যে কেউ শিশু হিসেবে বিবেচিত হবে। আবার শিশুর প্রতি অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ ক্রমান্বয়ে অপরাধে জড়িয়ে তুলতে তা প্রভাব বিস্তার করে। সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রেই শিশু-কিশোররা নানারকম বাজে আচরণ কিংবা দুর্ব্যবহারের শিকার হয়ে থাকে। যেমন- স্কুলে কোনো ছেলেকে কেউ মারধর বার্ যাগিং করলে শিশুর মননে ক্ষোভের জন্ম নিতে পারে। এ ক্ষেত্রে স্কুল কর্তৃপক্ষেরই উচিত যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া।

পরিবারেরও এ বিষয়ে সচেতন হওয়া দরকার। উঠতি বয়সি ছেলেমেয়ে তথা কিশোর-কিশোরীদের চলাফেরা, আচার-আচরণ, চাল-চলন, কথাবার্তা, লিঙ্গভেদে পোশাকের তারতম্য, শারীরিক অঙ্গভঙ্গি ইত্যাদি বিষয়ে অভিভাবক মহল সচেতন না হওয়ায় তারা পথভ্রষ্ট হয়ে পড়ে। আপনার সন্তান কোথায় যায়, কী করে, সময়মতো ক্লাসে গেল কিনা, ক্লাস শেষে সময় মতো বাসায় ফিরল কিনা, আবার স্কুলে গেল ঠিক কিন্তু মিথ্যা কোনো কারণ দেখিয়ে স্কুল থেকে বের হয়ে গেল কিনা, কাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করছে, আড্ডা দিচ্ছে এ সব খোঁজ-খবর রাখা দরকার।

আবার অতি আদরের নামে সন্তানের আবদার রাখতে গিয়ে এমন কিছু জিনিস তাদের দিয়ে দেওয়া হয় যার দ্বারা সে খারাপ পথে চলে যেতে পারে। উদাহরণ হিসেবে তারা উলেস্নখ করলেন 'স্মার্ট ফোন'। এ ছাড়া সন্তানের চুলকাটা, নখকাটা, রুচিশীল ও ভদ্রোচিত পোশাক পরা এ সব বিষয়েও অভিভাবকরা সন্তানদের কোনো আদেশ, উপদেশ বা কাউন্সিলিং অভাব। শুধু তাই নয়- অবস্থা এমন যেন আমাদের ছেলেমেয়েদের উচ্ছৃঙ্খল বন্ধু যত বেশি হতে পারে ততই এটা নিয়ে আমরা গর্ববোধ করি। পারিবারিক মূল্যবোধের শিক্ষায় যথেষ্ট ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। এখনকার কিশোর-তরুণ সমাজ কিংবা বেশির ভাগ মানুষের মধ্যে বই পড়ার আগ্রহ কমে গেছে বলে মনে হয়। তবে পরিহাস করে বলতে হয়, এখন বুক বা বই একটা পড়ছে আর সেটা হচ্ছে 'ফেসবুক'!

প্রযুক্তির নেতিবাচক প্রভাব যে কত ভয়ানক হতে পারে তা এখন পরিলক্ষিত হচ্ছে। আমরা এখন আর মাঠে খেলা করতে যাই না, পার্কে বিনোদনের জন্য যাই না, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যাই না কিংবা বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সরাসরি দেখা করি না। এখন সব ফেসবুকেই সেরে ফেলছি। বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির যুগে টেলিভিশন, ইন্টারনেট, পত্রিকা, ম্যাগাজিন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যেমন মোবাইল, ফেসবুক, টুইটার, বস্নগ, ইউটিউবের মতো গণমাধ্যমগুলো শিশু-কিশোরদের দারুণভাবে প্রভাবিত করে। তাই ওই গণমাধ্যমগুলো ব্যবহারের ক্ষেত্রে

অভিভাবকরা যথেষ্ট সচেতন না হলে কোমলমতি শিশু-কিশোররা অপরাধে লিপ্ত হতে পারে। বিশেষ করে কুরুচিপূর্ণ যৌন আবেগে ভরপুর ম্যাগাজিন ও পত্রিকা কিশোর-কিশোরীদের মন-মানসিকতার ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। অর্থনৈতিক অবস্থাও কিশোর অপরাধের মাত্রাকে প্রভাবিত করে। দরিদ্র ও সম্পদের প্রাচুর্য উভয়ই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভবে কিশোর অপরাধ সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। দরিদ্রতার কারণে মৌলিক চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হয়ে কিশোররা বিভিন্ন প্রকারের অপরাধে লিপ্ত হয়ে থাকে। কিশোর অপরাধ সংঘটনের ক্ষেত্রে পারিপার্শিক সামাজিক পরিবেশের প্রভাব অপরিসীম বিধায় আবাসিক পরিবেশ, সঙ্গীদের প্রভাব, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দুর্বলতা, সামাজিক শোষণ-বঞ্চনা ইত্যাদি সামাজিক উপাদানগুলো শিশু-কিশোরদের আচরণে প্রভাব বিস্তার করে থাকে।

পৃথিবীর অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও শিশু অপরাধে অভিযুক্তদের বিচার ও সংশোধনের জন্য পৃথক আদালত ও সংশোধনাগার আছে। শিশুদের বয়স বিবেচনায় নিয়ে শিশু ও কিশোর অপরাধের বিচার ও সংশোধন করার জন্য এ ব্যবস্থা। আমাদের দেশে শিশুদের জন্য পৃথক বিচারব্যবস্থার সূচনা ১৯৭৪ সাল থেকে। ১৯৭৪ সালের শিশু আইন ও ১৯৭৬ সালের শিশু নীতিই আমাদের প্রথম আইন ও বিধি। এর পর থেকে বিভিন্ন আইনে শিশুদের কথা বলা আছে। কিন্তু শিশুদের জন্য পূর্ণাঙ্গ আইন ১৯৭৪ সালের আইনটিই। এটি ২০১৩ সালে সংশোধিত হয়ে আরও পূর্ণাঙ্গরূপ ধারণ করে।

বাংলাদেশ মূলত ১৯৮৯ সালের শিশু অধিকার সনদে স্বাক্ষর করার মাধ্যমে শিশু বা কিশোর অপরাধ ও বিচারব্যবস্থার ওপর জোর দেয়। আইনে শিশু অপরাধীদের বিচারের চেয়ে তাদের সংশোধনের বিষয়টিই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সে কারণেই তাদের বিচারের প্রক্রিয়াটিও হতে হবে সংশোধনমূলক যেন কিশোর হৃদয়ে তা বিরূপ প্রভাব বা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে না পারে। ফৌজদারি অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে কিশোরদের গ্রেপ্তার করা হলেও পরে তাদের কিশোর সংশোধনাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

কিশোর অপরাধ প্রতিরোধের উত্তম স্থান হলো পরিবার। জন্মের পর শিশু পারিবারিক পরিবেশ মাতা-পিতার সংস্পর্শে আসে। শিশুর সামাজিক জীবনের ভিত্তি পরিবারেই রচিত হয়। তাই তাদের আচরণ ও ব্যক্তিত্ব গঠনে পরিবার গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। পরিবারের কেউ অপরাধপ্রবণতার সঙ্গে যুক্ত থাকলে শিশু-কিশোররাও তাতে প্রভাবিত হয়। কিশোর অপরাধ প্রতিরোধে পরিবার, সমাজের মুরব্বি, শিক্ষক-শিক্ষিকা, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, মিডিয়াসহ প্রত্যেকের সচেতনতা ও সক্রিয় ভূমিকা প্রয়োজন।

লেখক : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে