শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ভিন্ন ধর্মাবলম্বীকে বিয়ে করার আইনানুগ পদ্ধতি

এ আইনের অধীনে বিয়ের ফলে জন্মগ্রহণকারী সন্তান যদি এ আইনের অধীনেই বিয়ের ইচ্ছা পোষণ করেন তবে তার পিতা বিয়ের ক্ষেত্রে যে আইনে রক্ত-সম্পর্কীয় ও বৈবাহিক সম্পর্কীয় বাধার সম্মুখীন ছিলেন, সে আইন এবং এ আইনের ২ ধারা তার ওপর প্রযোজ্য হবে। তবে এ আইনের কোনো কিছুই এ আইনের অধীনে বিয়ের ফলে জন্মগ্রহণকারী সন্তানের অন্য কোনো আইনে সম্পাদিত বিয়ের বৈধতা ক্ষুণ্ন করবে না।
খালিদ ইয়াহইয়া
  ০২ মার্চ ২০২১, ০০:০০

ধর্মীয় বিধানের আওতায় পারিবারিক আইনে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীর সঙ্গে বিবাহ-বন্ধন নিষিদ্ধ। এক্ষেত্রে, একই ধর্মের নয় অথচ বিয়ে করতে চায় এমন ব্যক্তিদের বিয়েকে আইনসম্মত করার যে বিধান রয়েছে তা 'বিশেষ বিবাহ আইন, ১৮৭২' নামে অভিহিত। যেসব ব্যক্তি মুসলিম, হিন্দু, খ্রিষ্টান, ইহুদি, পার্সি, বৌদ্ধ, শিখ বা জৈন ধর্ম গ্রহণ করেননি, তাদের মধ্যে এ বিয়ে হতে পারে। এছাড়া যেসব ব্যক্তি হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ বা জৈন ধর্ম গ্রহণ করেছেন এ আইন দ্বারা তাদের জন্য বিয়ের বিকল্প একটি ধরন নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়াও যেসব বিয়ের বৈধতা সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে সেসব সুনির্দিষ্ট বিয়ের বৈধতাও দেওয়া হয়েছে এ আইনের মাধ্যমে।

বাংলাদেশে মুসলিম কোনো ব্যক্তি ইচ্ছা করলে অন্য ধর্মের কোনো ব্যক্তিকে মুসলিম আইন অনুযায়ীই বিয়ে করতে পারেন। যদি অন্য পক্ষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন তবে তো কোনো সমস্যাই নেই, অর্থাৎ বিয়েটি 'বৈধ বিয়ে'। তবে অন্য পক্ষ যদি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ না-ও করেন তবুও মুসলিম পারিবারিক আইন অনুযায়ী বিয়ে করা যাবে। তবে এক্ষেত্রে বিয়েটি 'অনিয়মিত' হবে। তদ্রম্নপ, খ্রিষ্ট ধর্মের ক্ষেত্রেও কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। অন্য পক্ষ খ্রিষ্ট ধর্ম গ্রহণ করলে কোনো সমস্যাই নেই। তবে অন্য পক্ষ খ্রিষ্ট ধর্ম গ্রহণ না করলে খ্রিষ্টান পারিবারিক আইন অনুযায়ী বিয়েটি 'অনিয়মিত' বিয়ে হবে।

বিয়ের শর্তাবলি : বিশেষ বিবাহ আইনের ২ ধারা মোতাবেক বিয়ে অনুষ্ঠানের ৩টি শর্ত বিদ্যমান। যথা- ১. ছেলে-মেয়েকে অবিবাহিত হতে হবে অথবা ছেলে বা মেয়ের অন্য কোনো স্বামী বা স্ত্রী থাকতে পারবে না। ২. 'বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, ১৯২৯' অনুসারে ছেলের বয়স ২১ ও মেয়ের বয়স ১৮ হতে হবে। ৩. বিয়ের ছেলে বা মেয়ে পরস্পরের সঙ্গে রক্তের সম্পর্কের কেউ, যাদের মধ্যে বিয়ে নিষিদ্ধ, তারা কেউ হতে পারবে না।

পদ্ধতি : এ আইনের ৫ ধারা মোতাবেক বিয়ে সম্পাদনের ইচ্ছা পোষণ করলে দুই পক্ষের কোনো একজনকে অবশ্যই নিবন্ধক বরাবর লিখিত নোটিশ দিতে হবে। নিবন্ধক বরাবর নোটিশ প্রদানকারীকে অবশ্যই নোটিশ দেওয়ার কমপক্ষে ১৪ দিন আগে থেকে সে জেলায় বসবাস করতে হবে। নিবন্ধককে অবশ্যই ওই জেলার হতে হবে, যে জেলায় দুই পক্ষের অন্তত কোনো একজন নোটিশ দেওয়ার কমপক্ষে ১৪ দিন আগে থেকে বসবাস করছেন।

বিয়ের প্রত্যয়নপত্র : বিয়ে সম্পাদনের পর নিবন্ধক 'বিবাহ প্রত্যয়ন বই'য়ে প্রত্যয়নপত্র অন্তর্ভুক্ত করবেন, যা নির্ধারিত একটি ফরম। এটি অবশ্যই উভয় পক্ষ এবং তিনজন সাক্ষী কর্তৃক স্বাক্ষরিত হতে হবে। নিবন্ধক সরকার-নির্ধারিত ফরমে 'বিবাহ প্রত্যয়ন বই'য়ে লিপিবদ্ধ সব অন্তর্ভুক্তির অনুলিপি তার জেলার 'জন্ম, মৃতু্য ও বিয়ের রেজিস্ট্রার জেনারেল'-এর কাছে পাঠাবেন।

এ আইনের ১১ ধারা মোতাবেক বিয়ে সম্পন্ন করতে হবে রেজিস্ট্রার এবং ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষরদানকারী তিনজন সাক্ষীর সম্মুখে। উলেস্নখ্য, পক্ষগণকে রেজিস্ট্রার ও সাক্ষীগণের উপস্থিতিতে বলতে হবে 'আমরা পরস্পর পরস্পরকে আইনসঙ্গত স্ত্রী অথবা স্বামী হিসেবে গ্রহণ করলাম'।

বিশেষ বিবাহ আইনে বাংলাদেশের কোনো মুসলিম, খ্রিষ্টান, ইহুদি, পার্সি, বৌদ্ধ, শিখ বা জৈন নন বা তাদের একজন যে কোনো এটি বা অন্য ধর্মে বিশ্বাসী তাদের মধ্যে বিয়ের ব্যবস্থা করতে হলে বিশেষ বিবাহ আইনের অধীন উপযুক্ত নিয়মাবলি অনুসরণ করা বাধ্যতামূলক।

জন্মগ্রহণকারী সন্তানের বিবাহ : এ আইনের অধীনে বিয়ের ফলে জন্মগ্রহণকারী সন্তান যদি এ আইনের অধীনেই বিয়ের ইচ্ছা পোষণ করেন তবে তার পিতা বিয়ের ক্ষেত্রে যে আইনে রক্ত-সম্পর্কীয় ও বৈবাহিক সম্পর্কীয় বাধার সম্মুখীন ছিলেন, সে আইন এবং এ আইনের ২ ধারা তার ওপর প্রযোজ্য হবে। তবে এ আইনের কোনো কিছুই এ আইনের অধীনে বিয়ের ফলে জন্মগ্রহণকারী সন্তানের অন্য কোনো আইনে সম্পাদিত বিয়ের বৈধতা ক্ষুণ্ন করবে না।

সহ-উত্তরাধিকারিত্বের ওপর ফলাফল : এ আইনের ২২ ধারানুসারে, হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ ও জৈন ধর্মে বিশ্বাসী কোনো পরিবারের কোনো সদস্যের এ আইনে বিয়ে হলে তিনি ওই পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন বলে গণ্য হবেন।

সম্পত্তির উত্তরাধিকার : হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ ও জৈন ধর্মে বিশ্বাসী কোনো ব্যক্তি, যিনি এ আইনের অধীন বিয়ে করেছেন তার সম্পত্তির এবং এ বিয়ের ফলে জাত সন্তানের সম্পত্তির উত্তরাধিকার 'উত্তরাধিকার আইন, ১৯২৫' অনুযায়ী নিয়ন্ত্রিত হবে।

মূলত, ওই দুই ব্যক্তির মধ্যেই এ বিয়ে হতে পারে, যাদের কেউই মুসলিম, হিন্দু, খ্রিষ্টান, ইহুদি, পার্সি, বৌদ্ধ, শিখ বা জৈন ধর্মে বিশ্বাস করেন না। কিংবা ওই দুই ব্যক্তির মধ্যে এ বিয়ে হতে পারে, যাদের প্রত্যেকেই হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ বা জৈন-এর একটি বা অন্য ধর্মে বিশ্বাস করেন। এছাড়া যেসব ব্যক্তি হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ বা জৈন ধর্মে বিশ্বাসী, এ আইন দ্বারা তাদের জন্য বিয়ের বিকল্প একটি ধরন নির্ধারণ করা হয়েছে।

পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধনে শিথীলতা এবং ক্রমবর্ধমান বিবাহ বিচ্ছেদ এ আইনের অন্যতম একটি কুফল। তাই বিশেষ বিবাহ আইনের অধীন বিয়ে করার সুযোগ থাকায় স্বধর্মের উপযুক্ত পাত্র-পাত্রী থাকা সত্ত্বেও তাদের বিয়ে না করে ভিন্ন ধর্মে বিশ্বাসীদের বিয়ে করার মানসিকতা আমাদের অবশ্যই পরিহার করা উচিত।

খালিদ ইয়াহইয়া : পিএইচডি গবেষক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে