শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

নিরাপদ নৌপথ নিশ্চিতে প্রয়োজন আইনের প্রয়োগ ও সমন্বিত উদ্যোগ

অ্যাডভোকেট মো. সাইফুদ্দীন খালেদ
  ০৪ মে ২০২১, ০০:০০

নদীমাতৃক বাংলাদেশে নৌপথ খুব স্বাভাবিক কারণেই যোগাযোগ ও পরিবহণের গুরুত্বপূর্ণ রুটে পরিণত হয়। ঔপনিবেশিক শক্তির হাত ধরে আসা যান্ত্রিক পরিবহণের সূচনা হয়েছিল এই রুটে। কিন্তু আধুনিককালে এসে বিশ্বের আর সব জনগোষ্ঠী যখন তাদের নৌপথকে আরও নিরাপদ ও কার্যকর করে তোলার দিকে মনোযোগ দিয়েছে, এদিকে আমাদের নৌপথ যেন পড়ে আছে অবহেলিতভাবে।

স্থল ও আকাশপথের তুলনায় নৌপথ যদিও অনেক বেশি সাশ্রয়ী। কিন্তু আমাদের নৌপথে প্রতিদিন হাজার হাজার যাত্রী যেভাবে প্রাণ হাতে নিয়ে চলাচল করে, সেটা সভ্যতার জন্য পরিহাসই বিবেচিত হচ্ছে।

প্রতিবছর লঞ্চ দুর্ঘটনায় মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ১৯৯১ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ২৯ বছরে ৫৭০টি দুর্ঘটনায় ৩ হাজার ৬৫৪ জন মারা গেছেন। এসব ঘটনায় ৫১৬ জন আহত ও ৪৮৯ জন নিখোঁজ হন। এসব দুর্ঘটনার মধ্যে যাত্রীবাহী নৌযানের সংখ্যা ২৩৬টি। ২০১৯ সালে ২৬টি নৌদুর্ঘটনায় তিনজন মারা গেছেন। ৩৩ জন আহত ও ২০ জন নিখোঁজ হন।

২০২০ সালে রাজধানীর সদরঘাটের শ্যামবাজার এলাকায় বুড়িগঙ্গা নদীতে অর্ধশত যাত্রী নিয়ে মর্নিং বার্ড নামে একটি লঞ্চডুবির ঘটনায় ৩৪ জন প্রাণ হারায়। শ্যামবাজার পয়েন্টে ময়ূর-২ নামের লঞ্চের সঙ্গে ধাক্কা লেগে ডুবে যায় মর্নিং বার্ড নামের লঞ্চটি। উক্ত ঘটনায় সাত জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। মামলায় বেপরোয়া লঞ্চ চালিয়ে মানুষ হত্যা ও ধাক্কা দিয়ে লঞ্চ দুর্ঘটনার জন্য দন্ডবিধির ২৮০, ৩০৪(ক), ৪৩৭ ও ৩৪ ধারার অভিযোগ আনা হয়।

সবশেষ গত ৪ এপ্রিল ২০২১ নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীতে মালবাহী জাহাজের ধাক্কায় 'সাবিত আল হাসান' নামে মুন্সীগঞ্জগামী লঞ্চ ডুবে যায়। যাতে ৩৫ জন প্রাণ হারায়। উক্ত ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। লঞ্চডুবির প্রকৃত কারণ অনুসন্ধান করে দুর্ঘটনার দায়দায়িত্ব নির্ধারণ করে সুপারিশসহ প্রতিবেদন দাখিলের জন্য নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয় সাত সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।

কমিটি দুর্ঘটনাস্থল এবং দুর্ঘটনা কবলিত নৌযান পরিদর্শন করে 'দি ইনল্যান্ড শিপিং অর্ডিন্যান্স ১৯৭৬' এর ৪৫(৩) ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে দুর্ঘটনার কারণ উদ্‌ঘাটন এবং দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তি বা সংস্থাকে শনাক্ত করবে। সঙ্গে দুর্ঘটনা প্রতিরোধে করণীয় নির্ধারণ উলেস্নখ করে সুনির্দিষ্ট সুপারিশ প্রদান করবে।

বিগত বছরগুলোয় বাংলাদেশের বিভিন্ন নদীতে সংঘটিত নৌ-দুর্ঘটনার প্রধান কারণ হিসেবে নৌযানের ত্রম্নটিপূর্ণ ডিজাইন, ডিজাইন না মেনে নৌযান নির্মাণ, ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত মালপত্র এবং যাত্রী বহন, মাস্টার-সারেংদের অদক্ষতা ও অসতর্কতা, সংঘর্ষ, নদীর নাব্য সংকট, দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া, নৌযান মালিকদের দায়িত্বহীনতা এবং নৌপরিবহণ কর্তৃপক্ষের অবহেলাকে চিহ্নিত করা হয়। দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হলো, দুর্ঘটনার এই কারণগুলো কিন্তু এখনো দৃশ্যমান।

বিআইডবিস্নউটির আইন ও নীতিমালা রয়েছে। তবে আইনগুলো সময়োপযোগী করে নেওয়া দরকার। 'দি ইনল্যান্ড শিপিং অর্ডিন্যান্স ১৯৭৬' অধ্যাদেশের ৫৫ ধারা বলছে, ঝড়ের সংকেত থাকাবস্থায় নৌযাত্রা নিষিদ্ধ। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ধারার শর্ত ভঙ্গ হলে অভ্যন্তরীণ নৌযান মাস্টারের তিন বছর পর্যন্ত কারাদন্ড বা ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদন্ডের বিধান রয়েছে। উক্ত অধ্যাদেশের ৫৮ (এ) ধারায় যাত্রী ও ক্রুদের জন্য জীবন বীমার কথা বলা থাকলেও, প্রয়োজনীয় আর্থিক কাভারেজের পরিমাণ উলেস্নখ নেই।

এ ছাড়া বিদ্যমান আইনে ফিটনেস সার্টিফিকেট ছাড়া যাত্রী পরিবহণ করা, প্রশিক্ষিত চালক বা ইঞ্জিনিয়ার ছাড়া জাহাজ চালানো অথবা ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী ও মালামাল বহন করার জন্য যে ধরনের শাস্তির পরিমাণ নির্ধারণ করা আছে তা অপর্যাপ্ত। ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী বহন করার শাস্তি হিসেবে ('দি ইনল্যান্ড শিপিং অর্ডিন্যান্স- ১৯৭৬' ধারা ৬৬-৬৭ অনুযায়ী) দুই থেকে তিন বছর জেল এবং পঞ্চাশ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে, তা অপ্রতুল।

অধ্যাদেশের ৭০ ধারায় অসদাচরণ ইত্যাদির কারণে জাহাজ বিপদাপন্ন করার শাস্তির বিষয়ে বর্ণনা রয়েছে। ধারাটির (২) অনুসারে যেখানে কোনো অভ্যন্তরীণ নৌযান দুর্ঘটনার ফলে প্রাণহানি বা কোনো ব্যক্তি আহত বা নৌযানের বা অন্য কোনো নৌযানের সম্পদ নষ্ট হয়ে থাকে এবং এ ধরনের কোনো নৌযানের ত্রম্নটি বা অভ্যন্তরীণ নৌযানের মালিক, মাস্টার বা কোনো কর্মকর্তা বা ক্রু সদস্যের অযোগ্যতা বা অসদাচরণ বা কোনো আইন ভঙ্গের দরুন ঘটে থাকে, তবে ওই নৌযানের মালিক বা অন্য কোনো কর্মকর্তা বা ক্রু সদস্য বা তাদের প্রত্যেকেই পাঁচ বছর পর্যন্ত কারাদন্ড বা এক লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা কিংবা উভয় দন্ডেই দন্ডিত হতে পারেন।

নৌযান দুর্ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের যথাযথভাবে বিচার করতে হবে। এদের শাস্তি প্রদান করা হলে বেপরোয়া নৌযান চলাচল রুখে দুর্ঘটনা কমিয়ে আসবে। দুর্ঘটনা ঘটা বন্ধ করতে প্রয়োজনীয় সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে।

আবহাওয়া মাঝে মাঝেই বৈরী হয়ে ওঠে। এদিকে নৌপথের সিগনালিং বা সংকেত ব্যবস্থা নাজুক। এর ওপর ফিটনেসবিহীন অসংখ্য নৌযান চলাচল করছে। ঈদের সময় পুরনো ও চলাচলের বৈধতা নেই এমন নৌযানগুলো পালিশ করে যাত্রী পরিবহণ করে ফলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি অনেকাংশে বাড়িয়ে তোলে। এটা কঠোর হাতে দমন করতে হবে।

নৌ নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার জন্য নৌপুলিশ, কোস্টগার্ড, বিআইডবিস্নউটিএর সমন্বয়ে একটি শক্তিশালী টাস্কফোর্স গঠন করা প্রয়োজন। ত্রম্নটিপূর্ণ, সার্ভেবিহীন ও অনিবন্ধিত লঞ্চসহ সব ধরনের অবৈধ নৌযান চলাচল বন্ধে নৌপরিবহণ অধিদপ্তর ও বিআইডবিস্নউটিএর নিয়মিত অভিযান পরিচালনা; দুর্যোগ মৌসুম বিবেচনায় ঈদের আগে অবৈধ নৌযান চলাচল বন্ধে নৌপথে ভ্রাম্যমাণ আদালত চালু রাখার বিকল্প নেই।

লঞ্চের চালক এবং স্টাফদের যথাযথ প্রশিক্ষিত ও লাইসেন্স প্রাপ্ত হতে হবে। তাদের শারীরিকভাবেও উপযুক্ত থাকতে হবে, যাতে বিপদকালীন সময়ে তারা যাত্রীদের সাহায্য ও দিকনির্দেশনা দিতে পারেন। নিরাপত্তাসংক্রান্ত বিষয়ে কারিগরি ও ব্যবহারিক জ্ঞান এবং শারীরিক উপযুক্ততা যাচাইয়ের জন্য নিয়মিত বিরতিতে পরীক্ষা করতে হবে।

সীমিতসংখ্যক যাত্রীবাহী লঞ্চের কারণে প্রতিনিয়ত লঞ্চে ওভারলোডিং হয়ে থাকে। এই ওভারলোডিং থেকে যাত্রীদের বিরত রাখা অত্যন্ত কঠিন। এ ক্ষেত্রে আইন রয়েছে তা অত্যন্ত দুর্বল। লঞ্চ দুর্ঘটনা এড়াতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের বিকল্প নেই। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় লঞ্চ চলাচল না করা। এক্ষেত্রে আবহাওয়া বার্তা মেনে চললে দুর্ঘটনার সমূহ সম্ভাবনা এড়ানো যাবে।

যাত্রীবাহী বৈধ লঞ্চের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। উন্নততর লঞ্চ সার্ভিস চালু করতে হবে। নৌ-পরিবহণের উন্নয়নের জন্য এই খাতে বরাদ্ধ বৃদ্ধি করতে হবে। নৌপথে ট্রাফিক সিস্টেমের ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে আরও আধুনিক করতে হবে। বিআইডবিস্নটিএর উপকূলীয় দ্বীপগুলো সার্ভিসের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। নৌযানের বিজ্ঞানসম্মত নকশা ও ধারণক্ষমতাসম্মত যাত্রী উত্তোলন নিশ্চিত করা গেলে নৌ দুর্ঘটনা অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণে আসবে। এ ব্যাপারে নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয় ও নৌপরিবহণ অধিদপ্তরের দৃষ্টি দেওয়া দরকার।

নৌপথের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য তাদের কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। অবশ্যই সার্ভেয়ারের সংখ্যা বাড়াতে হবে। সি-সার্ভে সনদ ছাড়া যাতে কোনো নৌযান চলাচল করতে না পারে, সে জন্য নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করতে হবে। নৌযান যারা পরিচালনা করেন এবং নৌপথ নিরাপদ রাখতে যারা দায়িত্ব পালন করেন তাদের সবার প্রশিক্ষণ আধুনিক, বাধ্যতামূলক ও যথাযথ কার্যকর করা উচিত।

নৌপথগুলোতে শৃঙ্খলা আনয়নের জন্য সরকারি নীতিমালার যথাযথ বাস্তবায়ন ও প্রচলিত নীতিমালার আধুনিকায়ন করতে হবে। যাত্রীদের নির্বিঘ্ন ও যাত্রাপথ সুন্দর করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী, লঞ্চ মালিক সমিতি, বিআইডবিস্নউটিএসহ নৌ-সংশ্লিষ্ট সবাইকে দায়িত্ব নিতে হবে।

লেখক : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে