শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

মানসম্মত খাদ্য নিশ্চিতকরণে আইনের প্রয়োগ

অ্যাডভোকেট মো. সাইফুদ্দীন খালেদ
  ১৮ মে ২০২১, ০০:০০

আধুনিক রাষ্ট্রে নাগরিকের পাঁচ মূল অধিকারের মধ্যে একটি খাদ্যের অধিকার। নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তা এর মধ্যেই পড়ে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (ঋঅঙ) মতে খাদ্য নিরাপত্তা হলো এমন একটি অবস্থা পৃথিবীর সব স্থানের সব মানুষের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিন্তে পর্যাপ্ত প্রয়োজনীয় পছন্দের খাবার পাওয়ার দৈহিক ও আর্থিক সুযোগ সৃষ্টি করা। যে খাদ্যে কোনো ক্ষতিকারক কেমিক্যালস নেই, জীবাণু দ্বারা দুষ্ট নয়, প্রয়োজনীয় সব পুষ্টি উপাদানে সমৃদ্ধ ও প্রাকৃতিকভাবে তৈরি সেটাই নিরাপদ খাবার।

সম্প্রতি খাদ্যের মানের বিষয় একটি বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাড়ছে ভেজালের ব্যাপকতা। মানুষ কেন খাদ্যে ভেজাল দেয় তার কারণ পর্যালোচনা করলে মানুষের ভোগী মনোবৃত্তির পরিচয় মেলে। স্বল্প সময়ে যাতে অধিক উপার্জন করা যায় সেদিকেই ভেজালকারীদের প্রধান লক্ষ্য থাকে। এতে পরিশ্রম কম হয় কিন্তু রাতারাতি বিত্তবান হয়ে ওঠা যায়।

স্বার্থান্ধ মানুষ নিজেদের স্বার্থের কথা মনে রেখে ভেজাল দিতে গিয়ে মানুষের যে চরম সর্বনাশ সাধন করে তা কখনই তারা ভেবে দেখে না। ভেজাল মিশ্রিত জিনিস খাওয়ার ফলে নানা প্রকার রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনার যথেষ্ট নিদর্শন সহজেই পাওয়া যায়।

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় যে সব রাসায়নিক পদার্থ নিরাপদ খাদ্যের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে তার অন্যতম ফরমালিন। এটি ব্যবহার করা হয়ে থাকে মূলত মানুষের মৃতদেহ সংরক্ষণসহ নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে। কিন্তু দ্রম্নত পচন রোধে সহায়ক বিধায় অসাধু ব্যবসায়ীরা ফরমালিনকে এক রকম সহজ মুনাফার পদ্ধতি হিসেবে খাদ্যদ্রব্য ব্যবহার করছে। ফলমূল, শাক-সবজি ও মাছ-মাংসে এর ব্যবহার যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। বস্তুত বর্তমানে এর অপব্যবহারই হচ্ছে বেশি।

জটিল প্রক্রিয়ায় তৈরি ফাস্টফুড, রাস্তার খোলা খাবার এবং অন্যান্য প্রক্রিয়াজাত খাদ্য তৈরি করছে ক্যান্সারের মতো দুরারোগ্য ব্যাধি। কিন্তু ভেজাল ও ক্ষতিকর খাদ্য মানুষের সুস্থতার বদলে অসুস্থ করছে। জনস্বাস্থ্যের জন্য তা হুমকি হয়ে দেখা দিচ্ছে।

সরকার ২০০৯ সালে 'ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯' এবং নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ২০১৩ সালে 'নিরাপদ খাদ্য আইন, ২০১৩' প্রণয়ন করেছে। নিরাপদ খাদ্য আইনে- মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর অথবা বিষক্রিয়া সৃষ্টিকারী রাসায়নিক দ্রব্য বা তার উপাদান বা বস্তু, কীটনাশক বা বালাইনাশক, খাদ্যের রঞ্জক বা সুগন্ধি বা অন্য কোনো বিষাক্ত সংযোজন দ্রব্য বা প্রক্রিয়া সহায়ক কোনো খাদ্যদ্রব্য বা খাদ্যোপকরণে ব্যবহার বা অন্তর্ভুক্তি অথবা উক্তরূপ দ্রব্য মিশ্রিত খাদ্যদ্রব্য বা খাদ্যোপকরণ মজুত, বিপণন বা বিক্রয় করলে অনূর্ধ্ব ৫ বছর কিন্তু অনূ্যন চার বছর কারাদন্ড বা অনূর্ধ্ব ১০ লাখ টাকা অনূ্যন পাঁচ লাখ টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডের বিধান রাখা হয়েছে। পুনরায় একই অপরাধ সংঘটন করলে ৫ বছর কারাদন্ড বা ২০ লাখ টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ড।

এ ছাড়া খাদ্য নিয়ে মিথ্যা বিজ্ঞাপন, নিবন্ধন ছাড়া খাদ্যপণ্য বিপণন, ছোঁয়াচে রোগে আক্রান্ত কাউকে দিয়ে খাদ্য বিক্রি করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন মেয়াদের কারাদন্ডের বিধান রাখা হয়েছে। ভেজালবিরোধী তৎপরতা কিছুদিন লক্ষ্য করা গেলেও পরবর্তীতে তা অনেকটা ভাটা পড়ে।

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯-এ যে সব কার্যকলাপকে অপরাধ গণ্য করা হয়েছে তা হলো- আইন ও বিধি দ্বারা নির্ধারিত হওয়া সত্ত্বেও পণ্যে মোড়ক ব্যবহার না করা; মূল্যের তালিকা প্রদর্শন না করা; সেবার মূল্যের তালিকা সংরক্ষণ ও প্রদর্শন না করা; ধার্যকৃত মূল্যের অধিক মূল্যে পণ্য, ওষুধ বা সেবা বিক্রি করা; ভেজাল পণ্য বা ওষুধ বিক্রি করা; খাদ্যপণ্যে নিষিদ্ধ দ্রব্য মিশ্রণ করা; মিথ্যা বিজ্ঞাপন দিয়ে ক্রেতাসাধারণকে প্রতারিত করা; প্রতিশ্রম্নত পণ্য বা সেবা যথাযথভাবে বিক্রি বা সরবরাহ না করা; ওজনে কারচুপি করা; বাটখারা বা ওজন পরিমাপক যন্ত্রে প্রকৃত ওজন অপেক্ষা অতিরিক্ত ওজন প্রদর্শন করা; পরিমাপে কারচুপি করা; দৈর্ঘ্য পরিমাপক কার্যে ব্যবহৃত পরিমাপক ফিতা বা অন্যকিছুতে কারচুপি করা; পণ্যের নব প্রস্তুত বা উৎপাদন করা; মেয়াদ উত্তীর্ণ কোনো পণ্য বা ওষুধ বিক্রি করা; সেবাগ্রহীতার জীবন বা নিরাপত্তা বিপন্নকারী কার্য করা এবং অবহেলা, দায়িত্বহীনতা বা অসতর্কতা দিয়ে সেবাগ্রহীতার অর্থ, স্বাস্থ্য বা জীবনহানি ঘটানো।

ভোক্তা অধিকার আইন ও নিরাপদ খাদ্য আইনের যথাযথ প্রয়োগ করতে পারলে খাদ্যে ভেজাল দেওয়ার এ অপরাধ কমিয়ে আসবে। পাশাপাশি দেশের প্রধান খাদ্য নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউট (বিএসটিআই)-কে আরও সতর্ক ও সক্রিয় হয়ে ভেজাল খাদ্য নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখতে হবে। শহরের দোকান ও রেস্টুরেন্টে ভেজালবিরোধী অভিযান চালানোর পর কিছুদিন ভেজালমুক্ত খাদ্যদ্রব্য পাওয়া যায় কিন্তু পরে যেই- সেই হয়ে যায়। এর থেকে পরিত্রাণের জন্য আমাদের সামাজিকভাবেও নীতি-নৈতিকতা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। আর এর জন্য দরকার ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা।

ধর্মীয় নীতি অনুসারে নৈতিক দায়িত্ববোধ থেকে সততা, জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতার আলোকে ব্যবসা পরিচালনা করতে হবে। মনে রাখতে হবে যারা ভেজাল খাদ্য তৈরি করে তাদের তৈরি ভেজাল দ্রব্যের ফাঁদে তারা নিজেরা কিংবা তাদের পরিবার-পরিজনও পতিত হতে পারে কোনো না কোনো সময়। পরিশেষ বলব ভেজাল প্রতিরোধে প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের নৈতিকতাবোধ। উৎপাদক, বিপণনকারীসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে সচেতনতা ও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। পাশাপাশি রাষ্ট্রকে আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।

লেখক : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে