শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে আইনের প্রয়োগ

অ্যাডভোকেট মো. সাইফুদ্দীন খালেদ
  ০৫ অক্টোবর ২০২১, ০০:০০

নারীর প্রতি সহিংসতা যেন একটি নিয়মিত ঘটনা। গণমাধ্যমে চোখ রাখলেই দেখা যায় দেশের কোথাও না কোথাও নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটাচ্ছে। বাবার কাছ থেকে মেয়েকে কিংবা স্বামীর কাছ থেকে স্ত্রীকে ছিনিয়ে নিয়ে নৈতিকতাহীন কিছু অমানুষ ধর্ষণের মতো ঘটনাও ঘটায়। একের পর এক সংবাদ এসে হাজির হচ্ছে বর্বরতার বর্ণনা নিয়ে।

বাদ যায়নি প্রতিবন্ধী কিংবা ছয় বছরের শিশুও। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দলবেঁধে ধর্ষণ করা হয়েছে এসব নারী ও শিশুকে। এক এলাকার ধর্ষণের ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতে গণমাধ্যম কেঁপে ওঠে নতুন আরেক ঘটনায়। নারীরা প্রতিদিনই নির্যাতিত হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে থাকছে না বয়স, স্থান, কাল, পাত্রের ভেদ। রাত-বিরাতে নয় শুধু, দিন-দুপুরে প্রকাশ্যে ধর্ষণের ঘটনাও ঘটছে।

ঘরে, বাইরে, রাস্তাঘাটে, যানবাহনে, কর্মক্ষেত্রে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। শুধু ধর্ষণই নয়, রীতিমতো গণধর্ষণ হচ্ছে। অনেক সময় ধর্ষণ করার ঘটনা ধর্ষক বা তার সহযোগী কর্তৃক মোবাইলে ভিডিও করে রাখে। পরবর্তী সময়ে ইন্টারনেটে ছেড়ে দেওয়ার ভয়ভীতি দেখিয়ে পুনরায় ধর্ষণ কিংবা টাকা দাবি করা হচ্ছে।

আধুনিক সমাজে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবারই মৌলিক অধিকার সমান ও অভিন্ন। প্রত্যেক নারী-পুরুষের স্বাধীনভাবে চলা ফেরা করা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা রয়েছে। একুশ শতকে পদার্পণ করে বর্তমান বিশ্ব যে সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক পালাবদলে অংশ নিচ্ছে নারী সেখানে এক অপরিহার্য অংশীদার, জীবন যুদ্ধেও অন্যতম শরিক ও সঙ্গী। আর নারীকে মুক্তি দেওয়ার জন্য, নারীর উন্নয়নের জন্য, এক কথায় নারীর ক্ষমতায়নের জন্য দরকার সব ধরনের প্রতিবন্ধকতার অবসান।

প্রয়োজন শিক্ষার প্রসার ও সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি। বর্তমান সভ্য সমাজে শিক্ষা ছাড়া সবই অচল। তাছাড়া কোনো স্বাধীন জাতির পক্ষে নিরক্ষর ও মূর্খ থাকা এবং বিশ্বজগৎ, জীবন ও পারিপার্শ্বিকতা সম্পর্কে অজ্ঞান থাকা জাতীয় মর্যাদার পক্ষে হানিকর। যদিওবা দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাতীয় জীবনে নতুন উদ্দীপনার সৃষ্টি হয় এবং সমাজে নারী-পুরুষের সমান মৌলিক অধিকার স্বীকৃতি পায়।

মানবাধিকার ও অগ্রগতির এই একুশ শতকে সামাজিক কুসংস্কার কাটিয়ে নারীরা এগিয়ে আসছিল মানুষের ভূমিকায়, আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে। কিন্তু তাদের অগ্রযাত্রায় যৌন নির্যাতন, ইভটিজিং কিংবা ধর্ষণ বিশাল প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করছে- যা নারী শিক্ষা ও তাদের জীবনযাত্রায় প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। নারী নির্যাতন কিংবা ধর্ষণের সংখ্যা দ্রম্নত হারে যেন বেড়ে যাচ্ছে। ঘরের বাইরে নারীদের নিরাপত্তাহীন অবস্থায় থাকতে হচ্ছে।

মাঝে মধ্যে খবরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন নিপীড়নের মতো ঘটনাও আসে। আসলে সংলাপগুলো একদিক দিয়ে লজ্জাজনক অন্যদিক দিয়ে বেদনাদায়ক। পবিত্র শিক্ষাঙ্গনগুলো অপবিত্র করতে যাচ্ছে এক শ্রেণির নিপীড়ক, কিছু কুচক্রিলোক। দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন নিপীড়নের খরব পত্রপত্রিকায় ছাপা হচ্ছে। দেশবাসী এসব সংবাদ দেখে- যা অপ্রত্যাশিত। একের পর এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এমন ঘটনা ঘটে চলছে। মাঝে মধ্যে শিক্ষক দ্বারাও নির্যাতিত হয়। বর্ণিত এই ধরনের শিক্ষককে কি সত্যিই মানুষ গড়ার কারিগর বলা যায়?

আমি দৃঢ়তার সঙ্গে বিশ্বাস করি, শিক্ষাঙ্গন হচ্ছে জ্ঞান চর্চার সর্বোৎকৃষ্ট অঙ্গন। এই অঙ্গন গড়ে তোলে জাতির ভবিষ্যৎ স্বপ্ন ও সম্ভাবনা। পৃথিবীর যে কোনো বড় সামাজিক দায়িত্বপালন করে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। কিন্তু দুঃখজনক হলে অপ্রিয় সত্য যে, এধরনের কুচক্রি লোকদের কবলে শিক্ষা ব্যবস্থার মেরুদন্ড ভেঙে যাচ্ছে। জাতির আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলক শিক্ষাঙ্গন যোগ্য নাগরিক উপহার দিতে গিয়ে ব্যর্থ হচ্ছে। প্রতি বছর কোনো না কোনো শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষা গ্রহণে যাওয়া ছাত্রী ধর্ষিতা হয়ে, যৌন নিপীড়নের শিকার হয়ে ফিরে আসছে। অথচ এদের কাছ থেকে পরিবার যেমন অনেক কিছু আশা করে তেমনি জাতিও অনেক কিছু আশা করে থাকে। কিন্তু সেই স্বপ্নকে চিরতরে ধ্বংস করে দিচ্ছে। শিক্ষাঙ্গনকে এদের কবল থেকে মুক্ত করে শিক্ষা এবং জাতির মেরুদন্ডকে শক্তিশালী করা আবশ্যক।

অপরদিকে ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে যেসব বিষয় সমাজে বহুদিন ধরে অস্থিত্ব বজায় রেখেছে তার মধ্যে ইভটিজিংও রয়েছে। এ অমানবিক বিষয়টি মানুষকে অবমূল্যায়ন করছে। বৃদ্ধি করছে সামাজিক সমস্যা, নিয়ে আসছে সমাজ জীবনে অনাকাঙ্ক্ষিত বিপুল দুঃখ দুর্দশা। চলার পথে কিংবা কর্মক্ষেত্রে কিশোরী ও তরুণীদের বিরক্ত করা, কুপ্রস্তাব দেওয়া, শ্লীলতাহানির চেষ্টা করা ইত্যাদি অবৈধ ও অনৈতিক কর্মকান্ডের প্রস্তাব করা হচ্ছে ইভটিজিং- যা আমাদের সমাজে উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বর্তমান সমাজের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে ইভটিজিং একটি মারাত্মক রূপে পরিগণিত হচ্ছে। ব্যক্তিগতভাবে এর শিকার কিশোরী ও তরুণীরা লজ্জা গোপন করার জন্য কত আত্মদান লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে যাচ্ছে তারও কোনো ইয়াত্তা নেই। ভিকটিমরা এই সম্বন্ধে পুলিশের কাছে অভিযোগ করতে ভয় পান।

আইন আছে, সমাজে ঘৃণাও আছে। তবুও দুষ্ট ক্ষতের মতো এই বিষয়টি সমাজজীবনে নিরাময়ের অযোগ্য হয়ে আছে। কত নিরপরাধ কিশোরী-তরুণীর জীবন যে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই। আজ আমাদের সমাজটা অবক্ষয়ে নিমজ্জিত হতে যাচ্ছে। এগুলোর জন্য দায়ী আমাদের যুব সমাজের সঠিক মনুষ্যত্ববোধের অভাব। যখন তাদের চরিত্র থেকে মহৎ গুণ বিদূরিত হয়ে অন্যায় অনাচার আশ্রয় নেয়।

জীবনের কোনো মহৎ লক্ষ্য থাকে না তখন এই অবস্থার সৃষ্টি হয়। তারা বখাটে হিসেবে পরিচিত হয়ে যায় এবং বখাটেদের সমস্ত বৈশিষ্ট্য ধারণ করে থাকে তারা সুস্থ জীবন থেকে আলাদা হয়ে ঝুঁকে পড়ে অবক্ষয়ের গহিন আবর্তে। তাছাড়া সমাজজীবনে চলতে গেলে বন্ধুত্ব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। সেই বন্ধুত্বের মধ্যে যদি 'ছেলে' এবং 'মেয়ে' এই শব্দের দূরত্ব থাকে তখন মেয়েদের সঙ্গে বন্ধুত্বটা ছেলেদের কাছে আড্ডার, আলোচনার দুফোঁটা রস জোগানোর বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। অর্থাৎ এই দিক দিয়ে একটি ছেলের বখাটেপনা শুরু। আমাদের এও জেনে রাখা দরকার যে, একটি নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত ছেলেরা পিতামাতার বাধ্য থাকে।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে দেখা যায়, ছেলেরা আড্ডার টেবিলেই সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে- কে কার চেয়ে বেশি মেয়েদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে বা তারা নির্দিষ্ট একটি এলাকায় বা স্থানে দাঁড়িয়ে থেকে স্কুল বা কলেজের সুন্দর মেয়েদের বিরক্ত করতে পারবে। এর ফলে যা হয় তা মুখে বলতে হয় না। আর তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করার সাহস দেখায় কে? যদি কোনো রাজনৈতিক নেতার আশ্রিত হয়। ফলে অভিযোগ করলেও সেটার আর গুরুত্ব থাকে না।

কত মেধাবী ছাত্রী অকালে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে থাকে- কারণ তার ঘরের মধ্যেই তার বৈষম্যের কারণে সে বিষয়টা পরিবারে আলোচনা করার সাহস পায় না। যদি করেও থাকে সে ক্ষেত্রে তার পরিবার তার বিয়ে দেওয়ার মতো নজির আমাদের সামনে আছে। সচেতন পিতামাতা হলে অনেক সময় তাদেরও লাঞ্চিত হতে হয় এই বখাটেদের হাতে। তাছাড়া অনেক সময় আপত্তি করলেও আরো বেশি করার নজিরও আমরা দেখেছি। ছাত্রীদের প্রতি এই ধরনের আচরণের দিকে তাকালে দেখি বিভিন্ন বিদ্যালয় থেকে নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত ছাত্রীরা নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এতে করে ছাত্রীরা বিদ্যালয় বা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার শেষ ভরসাটুকু হারিয়ে ফেলে- এমনকি অভিভাবকরা পর্যন্ত হতাশ হয়ে পড়ে।

এসব কিছু থেকে উত্তরণের জন্য আইনের যথাযথ প্রয়োগ জরুরি।

লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে