শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

বৈষম্যমুক্ত সমাজ গড়তে প্রবেশন ব্যবস্থা

বর্তমানে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় (এসডিজি-৪) মানসম্মত ও সর্বজনীন শিক্ষা নিশ্চিত করা এবং জীবনব্যাপী শিক্ষা প্রসারের অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে। ইউনেসকোর তথ্যমতে, পৃথিবীর প্রায় ৮ বিলিয়ন মানুষের মধ্যে ৭১১ মিলিয়ন মানুষ নিরক্ষর। তার মধ্যে অধিকাংশ নারী- যারা লিখতে ও পড়তে পারে না। আমাদের দেশেও সাক্ষরতার পরিসংখ্যানে পুরুষরা নারীদের চেয়ে এগিয়ে। বিবিএসের তথ্যানুসারে এখনো দেশের ২৫.৩৪ শতাংশ মানুষ নিরক্ষর
ম সাইফুল ইসলাম পলাশ
  ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০০:০০

এজলাসে সবার মুখে হাসির চিহ্ন। কেউবা জোরেই হাসছেন, কেউবা মুচকি। হাসির যে কোনো কারণ ঘটেনি তা কিন্তু নয়।

পঞ্চাশোর্ধ মমতা একজন বিধবা নারী। ১০ বছর আগে স্বামী মারা যাওয়ার পর দিশেহারা হয়ে পড়েন। তখন তিনি অন্যের বাড়িতে কাজ নেন। কিন্তু কুড়িগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে নূ্যনতম মজুরিটুকুও পেতেন না। জীবন ধারনের জন্য অগত্যা মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন। পুলিশ তার বাড়ি থেকে ৪ বোতল ফেন্সিডিল উদ্ধার করে মামলা করেন। এ বছরের জানুয়ারিতে বিচারে তার বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণিত হয়। কিন্তু আমি তাকে জেলে না পাঠিয়ে শর্তসাপেক্ষে বাড়িতেই সংশোধনের সুযোগ দেই।

অন্যান্য শর্তের মধ্যে প্রধান শর্ত দুটো হচ্ছে নতুন করে অপরাধ করতে পারবে না এবং শুদ্ধভাবে বাংলা পড়া ও লেখা শিখতে হবে। এজন্য প্রবেশন অফিসারকে প্রথম শ্রেণির বাংলা ও গণিত বই সরবরাহ করার নির্দেশ দিয়েছিলাম।

আজ আদালতে মমতা হরহর করে ছড়া পড়ছেন। 'আয় ছেলেরা আয় মেয়েরা ফুল তুলিতে যাই...., আয় আয় চাঁদ মামা টিপ দিয়ে যা..।'

এটা শুনতে অনেকের কাছে অস্বাভাবিক লাগলেও আমার কাছে আমার ৫ বছর বয়সি সন্তানের মতই মিষ্টি লেগেছে। আট মাস আগে যে মমতা টিপসহি দিতেন আজ সে হাজিরায় স্বাক্ষর করেছে। জানালেন সে এখন 'বাংলাদেশ' লিখতে পারেন।

বর্তমানে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় (এসডিজি-৪) মানসম্মত ও সর্বজনীন শিক্ষা নিশ্চিত করা এবং জীবনব্যাপী শিক্ষা প্রসারের অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে। ইউনেসকোর তথ্যমতে, পৃথিবীর প্রায় ৮ বিলিয়ন মানুষের মধ্যে ৭১১ মিলিয়ন মানুষ নিরক্ষর। তার মধ্যে অধিকাংশ নারী- যারা লিখতে ও পড়তে পারে না। আমাদের দেশেও সাক্ষরতার পরিসংখ্যানে পুরুষরা নারীদের চেয়ে এগিয়ে। বিবিএসের তথ্যানুসারে এখনো দেশের ২৫.৩৪ শতাংশ মানুষ নিরক্ষর।

আমার আদালতে শুধু মমতা নয়, মমতার মতো এমন অনেকে আর টিপসহি করেন না। গত সাড়ে আট মাসে ৮৬ জন বিভিন্ন মামলায় দন্ডিত হলেও এমন সুযোগ পেয়েছেন মাত্র ১৯ জন। এদের অধিকাংশ হতদরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষ। শর্তসাপেক্ষে মুক্তি পেয়ে এদের মধ্যে কেউ পড়ালেখা শিখে নিরক্ষরমুক্ত হচ্ছে, কেউবা মুক্তিযুদ্ধ ও ধর্মীয় বই-পুস্তক পড়ছে, কেউবা বৃক্ষরোপণ করে নিয়মিত পরিচর্যা করছে, কেউবা পাওনাদারদের পাওনা পরিশোধের জন্য অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়েছে, কেউবা কম্পিউটারের বেসিক ট্রেনিং করছে।

যে ছেলেটা নিয়মিত মাদক সেবন করত, সে এখন বিকাল হলেই কম্পিউটার ট্রেনিং সেন্টারে যাচ্ছে। এই সুযোগ দেওয়ার উদ্দেশ্য একটাই। নতুন করে অপরাধ না করা, নিজেকে সংশোধন করা। তাকে সমাজের মূল ধারায় ফিরিয়ে নিয়ে আসা। আর এভাবেই প্রবেশন ব্যবস্থা একটি বৈষম্যমুক্ত সমাজ গড়তে পারে।

মমতা পেশাদার অপরাধী নন। তিনি পরিস্থিতির কারণে অপরাধী হয়েছেন। আজ আদালতে মমতা প্রথম শ্রেণির বাংলা বই নিয়ে এসেছেন। বইয়ের শুরুতে লেখা- 'মমতা, প্রথম শ্রেণি,............ প্রাথমিক বিদ্যালয়, কুড়িগ্রাম।'

নতুনভাবে শিক্ষার আলোয় আলোকিত হওয়ার প্রচেষ্টায় মমতা এখন জীবনের প্রথম শ্রেণিতে। শুরু হয়েছে নতুন করে পথচলা।

[বি. দ্র. ঘটনা সত্য। অপরাধীর ছদ্মনাম ব্যবহার করা হয়েছে]

সাইফুল ইসলাম পলাশ, বিচারক

(যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ), প্রাবন্ধিক

ও আইনগ্রন্থ' প্রণেতা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে