রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

গণিকাদের নিয়ে একটি দুর্লভ সংগ্রহ ও যৌনাঙ্গ পরীক্ষায় বাধ্যগত আইন

ঔপনিবেশিক ভারতে শুধু যে যৌনকর্মীদেরই যৌনাঙ্গ পরীক্ষা করানো হতো তা নয়, বরং খোজা বা হিজড়াদেরও ১৮৭১ সালের একটি বিতর্কিত আইনের অধীনে যৌনাঙ্গ পরীক্ষা করানো হতো। শুধু তাই নয়, 'নিম্নবর্ণের সব নারীকেরই সম্ভাব্য যৌনকর্মী' হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। ঔপনিবেশিক ভারতের এক লজ্জাজনক অধ্যায় বলে মনে করা হয় এই আইনকে। অথচ পুরুষদের যৌন আচরণ রাষ্ট্রের আওতার সম্পূর্ণ বাইরে রাখা হয়। সংক্রামক ব্যাধি আইন নামে ওই আইনের বিধান ছিল যে, যৌনকর্মীদের থানায় গিয়ে নিজেদেরে নিবন্ধন করাতে হবে, তাদের ডাক্তারি পরীক্ষা করাতে হবে এবং পর্যবেক্ষণের আওতায় থাকতে হবে।
অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক
  ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০

এ উপমহাদেশে গণিকাদের জীবন চরিত্র নিয়ে একটি প্রকাশনী সংস্থা খুবই তাগিদ দিচ্ছিলেন। আমিও তাগিদ অনুভব করছিলাম 'একুশের গ্রন্থমেলা'-২০২৪ বইটি প্রকাশে। গণিকাদের নিয়ে একটি দুর্লভ সংগ্রহ 'চৌদ্দ আইন' নিয়ে আজকের নিবন্ধ।

এইতো সেদিনের কথা। ব্রিটিশ-শাসিত ভারতের কলকাতা শহরে সুখীমণি রাউর নামে এক নারীর কারাদন্ড দেয়া হলো। তার অপরাধ তিনি তার যৌনাঙ্গ পরীক্ষা করাতে অস্বীকার করেছিলেন। সে সময় নিবন্ধিত যৌনকর্মীদের জন্য বাধ্যতামূলক একটি আইন ছিল যে, তার যৌনাঙ্গ পরীক্ষা করাতে হবে।

সুখীমণি সেই আইন লঙ্ঘন করেছিলেন, কারণ তার দাবি ছিল- তিনি যৌনকর্মী নন।

ঔপনিবেশিক যুগের দলিলপত্র ঘেঁটে স্পষ্টই দেখা যায় যে, সে সময় হাজার হাজার নারীকে তাদের যৌনাঙ্গ পরীক্ষার মাধ্যমে রেজিস্ট্রেশনের নিয়ম লঙ্ঘনের অভিযোগে সে যুগে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছিল। এ থেকে বোঝা যায়, কীভাবে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ এবং ভারতের বুদ্ধিজীবীরা আধুনিক ভারতের সমাজকে নিয়ন্ত্রণ ও সংগঠিত করতে নারীদের যৌন বিচু্যতির ধারণা গড়ে তুলেছিলেন।

যারা পুলিশের হাতে ধরা পড়ত তাদের ডাক্তার ও তার অধীনস্থ লোকদের কাছে নিজেদের উলঙ্গ করতে হতো। ১৮৬৮ সালে এই অ্যাক্ট বা চৌদ্দ আইন চালু হয়। ১৮৬৮ সালের 'ইন্ডিয়ান কন্টাজিয়াস ডিজিসেস আ্যক্ট' চালু হওয়ার পর ওই বছরই সেই আইনকে বাংলায় অনুবাদ করে বই আকারে প্রকাশ করা হয়। নাম দেওয়া হয় 'বেশ্যা গাইড'। শ্রীগিরীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় সংগৃহীত ৩১ পৃষ্ঠার আইনি খুঁটিনাটিসহ যৌনকর্মীদের কর্তব্য বিস্তারিতভাবে আলোচিত হয়েছে এই বইতে।

এই বইকে কেন্দ্র করে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যে আলাপ-আলোচনা তর্ক বিতর্কের ঝড় বয়ে গিয়েছিল।

১৮৭০ থেকে ১৮৮৮ সালের মধ্যে এই আইন লঙ্ঘনের জন্য শুধু কলকাতাতেই দৈনিক ১২ জন নারীকে গ্রেপ্তার করা হতো। নজরদারির ব্যাপারটা টের পেলে অনেক নারীই শহর থেকে পালিয়ে যেতেন। নারীদের প্রতিবাদ অব্যাহত থাকলেও আইন বিশেষজ্ঞরা বললেন, যে, যৌনাঙ্গ পরীক্ষা বাধ্যতামূলকভাবে করা না হলে ধর্ষণ ও গর্ভপাতের মিথ্যা অভিযোগ বেড়ে যাবে। আরেকজন যুক্তি দেন যে, মেয়েদের সম্মতি নিতে হলে তা বিচার প্রক্রিয়াকে পঙ্গু করে দেবে।

ঔপনিবেশিক ভারতে শুধু যে যৌনকর্মীদেরই যৌনাঙ্গ পরীক্ষা করানো হতো তা নয়, বরং খোজা বা হিজড়াদেরও ১৮৭১ সালের একটি বিতর্কিত আইনের অধীনে যৌনাঙ্গ পরীক্ষা করানো হতো। শুধু তাই নয়, 'নিম্নবর্ণের সব নারীই সম্ভাব্য যৌনকর্মী' হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। ঔপনিবেশিক ভারতের এক লজ্জাজনক অধ্যায় বলে মনে করা হয় এই আইনকে। অথচ পুরুষদের যৌন আচরণ রাষ্ট্রের আওতার সম্পূর্ণ বাইরে রাখা হয়। সংক্রামক ব্যাধি আইন নামে ওই আইনের বিধান ছিল যে, যৌনকর্মীদের থানায় গিয়ে নিজেদেরে নিবন্ধন করাতে হবে, তাদের ডাক্তারি পরীক্ষা করাতে হবে এবং পর্যবেক্ষণের আওতায় থাকতে হবে। পরীক্ষা পদ্ধতিটিও ছিল খুব যন্ত্রণাদায়ক। ২০ এপ্রিল, ১৮৬৯ সালের 'সম্বাদ ভাস্কর' পত্রিকায় 'চৌদ্দ আইনের ব্যাপার' শিরোনামের প্রতিবেদনে জানানো হচ্ছে, 'তাহারা ওই পরীক্ষিত বেশ্যাগণকে প্রথমত টবে বসাইয়া দেন, তাহারই জলের সহিত জ্বালাকর পদার্থ থাকে, ওই পরীক্ষার পর গর্ভ দর্শনীয় বিশাল যন্ত্র দ্বারা দর্শন হয়, পরে উগ্রতর পিচকারি দেওয়া হইয়ে থাকে। এই পিচকারিতে অনেকের উদর ফুলিয়া জীবন সংশয় হইয়াছে।' এখানে জানিয়ে রাখি, ব্রিটিশ সরকারের কাছে তাদের সৈন্যরা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সেনা ছাউনিগুলোতে সেনাবাহিনীদের জন্য তৈরি হলো আলাদা যৌনপলস্নী। যৌনকর্মীদের সংস্পর্শে আসার জন্য তাদের মধ্যে হঠাৎ করে যৌনরোগের প্রার্দুভাব বেড়ে যায়। তাই সমস্ত দিক বিচার করে সরকার পাস করলেন 'ক্যান্টনমেন্ট আ্যক্ট'-১৮৬৪। সেখানে যেসব যৌনকর্মীরা আসতেন তাদের রেজিস্ট্রিভুক্ত পরিচয়পত্রসহ কার্ড দেওয়া হতো।

সুখীমণি রাউর সেই আইনের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। তিনি আদালতে আবেদন করলেন তাকে মুক্তি দেওয়ার দাবি জানিয়ে। তিনি আদালতে বললেন 'আমি যৌনকর্মী ছিলাম না, তাই আমি এক মাসে দুবার সেই পরীক্ষা করাতে যাইনি।' শেষ পর্যন্ত ১৮৬৯ সালের মার্চ মাসে কলকাতা হাইকোর্ট সুখীমণির পক্ষে রায় দেন। বিচারকরা রায়ে বলেন, সুখীমণি রাউর একজন 'নিবন্ধিত গণ যৌনকর্মী ছিলেন না'। আদালত পর্যবেক্ষণে বলেন, যৌনকর্মী হিসেবে নিবন্ধন হতে হবে স্বেচ্ছামূলক, অর্থাৎ নিবন্ধন করানোর জন্য কারো ওপর জোর খাটানো যাবে না। সব ভেবেচিন্তে ১৮৮৮-তে এই আইনটি সরকার বাতিল করে দেন। পেশা হিসেবে যৌনকর্ম ভালো না মন্দ, গ্রহণযোগ্য না অগ্রহণযোগ্য বা স্বীকৃতিযোগ্য, না পরিত্যাজ্য, কতটুকু স্বাস্থ্যকর, না ক্ষতিকর- আমি এসব দিকে যাচ্ছি না। পাঠকের কাছে প্রশ্ন রেখে নিবন্ধের ইতি টানলাম।

লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইন গবেষক ও আইনগ্রন্থ প্রণেতা।

ইমেইল: ংবৎধল.ঢ়ৎধসধহরশ@মসধরষ.পড়স

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে