সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১
জন্মদিনের শুভেচ্ছা

নির্মলেন্দু গুণ ও কবিতার সংগ্রাম বাসার তাসাউফ

বাসার তাসাউফ
  ২৩ জুন ২০২৩, ০০:০০

শামসুর রাহমান-আল মাহমুদের পর দেশের কবিদের মধ্যে অন্যতম প্রধান কবির নাম নির্মলেন্দু গুণ। প্রেমাংশুর রক্ত চাই, চাষাভুষার কাব্য, বাংলার মাটি বাংলার জল, না প্রেমিক না বিপস্নবী ইত্যাদি কাব্যগুলো তাকে এ মর্যাদা প্রদান করে। তার অনেক জনপ্রিয় কবিতা আছে। আছে অনেক বিখ্যাত কবিতাও। জনপ্রিয়তা আর বিখ্যাত ব্যাপারটা কাছাকাছি মনে হলেও দু'টোতে বিস্তর ব্যবধান আছে। একটি উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টা আরেকটু পরিষ্কার করা যাক। কবি নির্মলেন্দু গুণের 'তোমার চোখ এত লাল কেন' কবিতাটি জনপ্রিয়; আর 'স্বাধীনতা, এ শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো' কবিতাটি বিখ্যাত।

আমি একজন শিক্ষক। কুমিলস্নায় হোমনা আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে বাংলা পড়াই। দশম শ্রেণির বাংলা পাঠ্যবইয়ে কবি নির্মলেন্দু গুণের 'স্বাধীনতা, এ শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো' কবিতাটি অন্তর্ভূক্ত হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই কবিতার সঙ্গে কবির জীবনীও দেওয়া আছে। ক্লাসে পড়ানো শুরুর আগে আমি কবি সম্পর্কে একটু আলোচনা করে নিই এবং কথা প্রসঙ্গে একদিন শিক্ষার্থীদের বলে ফেলেছিলাম, 'এ কবিতাটি যে কবি লিখেছেন তার সঙ্গে আমার পরিচয় আছে, আমাকেও তিনি চেনেন।'

কবি নির্মলেন্দু গুণের সঙ্গে আমাদের স্যারের পরিচয় আছে! ভেবেছিলাম, এ কথা জেনে শিক্ষার্থীরা বিস্মিত হবে। তারা বিস্মিত হয়েছে বটে; কিন্তু এ কালের ছেলেরা শুধু বিস্মিত হয়ে থেমে থাকার পাত্র নয়। তারা পরখ করতে চায়, তাদের 'স্যার' সত্যি বলেছেন নাকি মিথ্যে।

'মানলাম কবির সঙ্গে আপনার পরিচয় আছে কিংবা কবি আপনাকে চেনেন সেটাও মানলাম, এবার আমাদের এটা বলেন তো, কবির সঙ্গে আপনার এখন যোগাযোগ আছে কি না?' শিক্ষার্থীরা জানতে চাইল।

আমি জবাব দিলাম, 'হঁ্যা, আছে। তোমরা চাইলে তোমাদের সঙ্গেও আলাপ করিয়ে দিতে পারি।'

এবার শিক্ষার্থীরা একটু নড়েচড়ে বসল। কিছুটা কৌতূহলীও হলো। যার কবিতা পড়ে তারা মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস করবে তার সঙ্গে আলাপ করা হবে তাদের জন্য পৃথিবীর অত্যাশ্চর্য ঘটনাগুলোর একটি। শিক্ষার্থীদের মুখের দিকে তাকিয়ে তাদের চোখের ভাষা অনুবাদ করে এ রকমই মনে হলো আমার! তারা বেশ অধীর হয়ে পড়ল আর তাতে আমি একটু চিন্তিত হলাম। মনে মনে ভাবলাম, কবিকে কি পারব তাদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিতে? কবি কি রাজি হবেন? বর্তমানে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি তিনি। বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৮২) থেকে শুরু করে একুশে পদক (২০০১) স্বাধীনতা পদক (২০১৬) দেশের প্রায় সব পুরস্কার তিনি অর্জন করেছেন কবিতা লিখে।

২০১৬ সালে তাকে স্বাধীনতা পদক দেওয়ার সময় ঘটেছিল একটা অভূতপূর্ব ঘটনা। পদক প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সঙ্গে কিঞ্চিত খুনসুটি করেছিল।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৬০-এর দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে নির্মলেন্দু গুণের সহপাঠী ছিলেন। ১৯৬৮ সালের ৪ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের নেতা মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র নিহত হওয়ার পর নির্মলেন্দু গুণ ও কয়েকজন বন্ধু মিলে একটি কবিতা সংকলন প্রকাশ করেছিলেন। দাম ছিল দুই টাকা। সেই সংকলনটি কেনার জন্য তিনি তার সহপাঠী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অনুরোধ করেছিলেন। তবে শেখ হাসিনা তখন সেই সংকলন না কিনে কবিকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী কবির গলায় স্বাধীনতা পুরস্কার ২০১৬-এর স্বর্ণপদক পরিয়ে দেওয়ার পর তার হাতে একটি দুই টাকার কয়েন ধরিয়ে দিয়েছিলেন। নির্মলেন্দু গুণ পরে জানিয়েছিলেন, প্রধানমন্ত্রী সেই সংকলনের দাম দিয়েছেন।

স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যার এত সখ্য, তার সঙ্গে শিক্ষার্থীদের আলাপ করিয়ে দিতে পারব তো? এত বড় কবি আমার মতো সাধারণ একজন মাস্টারের অনুরোধ রাখবেন? আমিও একটু-আধটু লেখালেখি করি। অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রতি বছর দু-একটা করে বই প্রকাশিত হয়। বিভিন্ন পত্রিকার সাহিত্য পাতায়ও নিয়মিত লিখে থাকি। সেই সূত্রে কবি আমাকে চেনেন। আর আমার এইটুকু পরিচিতির ওপর ভরসা করেই পরদিন কবির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব বলে শিক্ষার্থীদের প্রতিশ্রম্নতি দিলাম।

স্কুল শেষে বাসায় এলাম। রাতে কবিকে ফোন করলাম। শিক্ষার্থীদের আগ্রহের কথা জানাতেই কবি সানন্দে রাজি হয়ে গেলেন। পরদিন দুপুরে ক্লাস টেনের বাংলা ক্লাসে কবির সঙ্গে হোয়াটসআপ কলে সংযুক্ত হলাম। শিক্ষার্থীরা বেশ উত্তেজিত হয়ে কবির সঙ্গে কথোপকথনে মেতে উঠল। এক শিক্ষার্থী প্রশ্ন করল, 'স্বাধীনতা, এ শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো' কবিতাটি কোন প্রেক্ষাপটে লিখেছিলেন?'

কবি তার স্বভাবসুলভ ধীর গলায় জবাব দিলেন, '১৯৭১ সালে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণটি মঞ্চের সামনে থেকে শোনার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। আমি একটি পত্রিকার জন্য রিপোর্ট লিখতে গিয়েছিলাম সেখানে। তখন ময়দানে বসে কবিতাটি শুনে মনে হয়েছিল, এটি কোনো ভাষণ নয়, এটি একটি সমৃদ্ধ কবিতা। অবশ্য পরে মার্কিন সাপ্তাহিক 'টাইমস' পত্রিকায় 'পয়েট অব পলিটিকস' শিরোনামে একটি প্রচ্ছদ স্টোরি করেছিল। মার্কিনরাও এই ভাষণ স্টাডি করে তার মধ্যে কবিতার সন্ধান পেয়েছিল। এই ভাষণে ১০৩টি লাইন আছে। ১৯ মিনিট দৈর্ঘ্য। ভাষণটি তিনি এমন চমৎকারভাবে দিয়েছিলেন, প্রথমেই 'ভায়েরা আমার' বলে যে সম্বোধন করলেন, মনে হলো যেন হাজার বছরের বাঙালিরা যে ভালোবাসার তৃষ্ণা এবং যে প্রত্যয় নির্ভরতায় নিমগ্ন সেই নেতা এসে আমাদের সামনে দাঁড়িয়েছেন। ভাষণের শেষের দিকে এসে যখন বঙ্গবন্ধু দৃপ্তকণ্ঠে উচ্চারণ করলেন, 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম' তখন ১০ লাখ লোক একসঙ্গে লাফিয়ে উঠছিল। সব মানুষ আনন্দে-উত্তেজনায় একাকার হয়ে পড়েছিল। তখন আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম বলে আমার মধ্যে যে উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল সেটাই কবিতাটি লিখতে উদ্বুদ্ধ করেছিল আমাকে। এ কারণেই কবিতাটি লিখতে আমি পেরেছিলাম।

ক্লাসে যতবার আমি কবিতাটি পড়াতে যাই ততবারই মনে মনে উত্তেজনা বোধ করি। যদিও শিক্ষক হিসেবে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল কিংবা জীবনানন্দ দাশের কবিতা পড়াতে গিয়েও আমি কম-বেশি উত্তেজিত হই। নির্মলেন্দু গুণের এ কবিতাটি পড়াতে গিয়ে যে রকম উত্তেজনা আমার মধ্যে কাজ করে তা কেবল বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ শোনার পর জেগে ওঠা উত্তেজনার সঙ্গে তুলনা চলে। কবিতাটি আবৃত্তি করা যত সহজ দশমে পড়া শিক্ষার্থীদের মানসিক সঙ্গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে বোঝানো তত সহজ হয় না। তাই কবিকে আমি প্রশ্ন করলাম, 'কবির বিরুদ্ধে কবি' কিংবা 'বিকেলের বিরুদ্ধে বিকেল' ইত্যাদি লাইনগুলো বুঝিয়ে দিতে। কবি সবিস্তারে বুঝিয়ে দিলেন। পাঠ্যবইয়ে থাকা কবিতা স্বয়ং কবির কাছ থেকে পাঠগ্রহণ করা এ যেন কেবল রূপকথার গল্পে সম্ভব। রূপকথার গল্পের মতো শিক্ষার্থীদের জীবনে স্মরণীয় ঘটনাটির জন্ম দিয়ে কবি ফোন রেখেছিলেন সেদিন। এমনই অহংকারহীন রাবীন্দ্রিক আকৃতির এক কবির নাম নির্মলেন্দু গুণ।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে