শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

জাপানি বন্ধু আহমেদ ফরিদ

নতুনধারা
  ২৩ জুন ২০২৩, ০০:০০

খোদাতায়ালা মানুষকে বিচিত্র আকার, প্রকার ও বর্ণে তৈরি করেছেন। আফ্রিকানদের তিনি স্পেশাল কোন জায়গার কালো মাটি দিয়ে হয়তো তৈরি করেছেন। সেজন্য এরা কালো, চায়না ক্লে দিয়ে ইউরোপিয়ানদের হয়তো তৈরি করা হয়েছে, এ জন্য এরা সাদা। বাদ বাকিদের কালো সাদার মিশ্রণে পিত, বাদামি গাত্রবর্ণ দিয়েছেন। চেহারায়ও দিয়েছেন ভিন্নতা। কারও মুখ লম্বা, কেউ গোলগাল, কারও মুখ ত্রিকোণাকার, কিংবা চেপ্টা, কারও নাক উঁচা, কারও বোঁচা। সুন্দর চেহারা নিয়ে কেউ গর্ব করে, কেউ কেউ একটু দুঃখে থাকে। কেউ নিজেকে উত্তম কুমার, সুচিত্রা সেন ভাবে, কেউ হয়তো ভাবে সে কেন উত্তম সূচিত্রা হলো না- ইত্যাদি।

নিজের চেহারা নিয়ে রসিকের কোন খেদ নেই। রসিক খোদাতায়ালার প্রতি কৃতজ্ঞ তিনি তাকে সাধারণ একটা চেহারা দান করেছেন। তবে এ সাধারণ চেহারা নিয়েও কখনো বিব্রত বোধ করেছে সে, কখনো বা মজাদার ঘটনা ঘটেছে। রসিক যখন ক্লাস সেভেনে পড়ে তখন তাদের ক্লাস টিচার ছিলেন আমির উদ্দিন স্যার। স্যারের স্বাস্থ্য ছিল অনেক ভালো। তার হাতের থাবা ছিল অনেক বড়। ছাত্ররা মনে করত তার হাতের থাবাগুলি কুশা নৌকার মতো। ওই হাতের থাবা যে একবার খেয়েছে সে জীবনেও ভুলবে না। স্যার ছাত্রদের খুবই আদর করতেন আবার মারতেনও। স্যার মাঝে মধ্যেই রসিককে বলতেন ওই রসিক, তুই হাসছ, না কান্দসরে? বুঝুন অবস্থা। ক্লাস ভর্তি মেয়ে, তন্দ্রা, শোভার মতো সুন্দুরী মেয়েরা যখন মুখ টিপে হাসে তখন কেমন লাগে বলুন! রসিক আবার কিনা ক্লাস ক্যাপ্টেন।

এর একটা কারণও ছিল। রসিকের স্বাস্থ্য ছিল তখন যথেষ্ট নাদুস নুদুস, গাল টোবলা টোবলা। হাসলে চোখগুলো মাংসের ভেতরে ঢুকে যেত। এ কারণে রসিক যথাসম্ভব স্যারের সামনে হাসত না। হাসি আর চেহারা নিয়ে কলেজে কোনো সমস্যা হতো না রসিকের। সমস্যা হলো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে। সে থাকে জহুরুল হক হলে। এক বড় ভাই তাকে একদিন ডাকল, এই নরোদম সিহানুক, এদিকে শোন তো। রসিক এদিক ওদিক তাকায়। কেউ নেই আশপাশে। অগত্যা রসিক এগিয়ে গেল তার দিকে। রসিক বলল, আমাকে ডাকছেন?

তো কাকে? এ হলে কি নরোদম সিহানুক দ্বিতীয় আর কেউ আছে? কিন্তু ভাই, আপনি আমাকে কী এ নাম ধরে ডাকছেন! আমার নাম তো.......

আ রে মিয়া রাখ তোমার নাম। বাপ মা ভুল করে হয়তো তোমার নাম রসিক রেখেছে। তোমার নাম রাখা উচিত ছিল নরোদম সিহানুক পত্রিকার পাতা খুললেই কী কারণে যেন কম্বোডিয়ার প্রেসিডেন্ট নরোদম সিহানুকের ছবি দেখা যেত।

রসিক বলল ভাই, আপনি দয়া করে এভাবে আমাকে সিহানুক নামে জনসম্মুখে ডাকবেন না। দরকার হলে আমি আপনাকে মাঝে মধ্যে নীলক্ষেতে নিয়ে গিয়ে খাসির পায়া খাওয়াব। রসিক মনে করল, বিষয়টা হয়তো চাপা পড়ে যাবে। পড়ল তো না-ই পুরো হলে চাউর হয়ে গেল যে, এ হলে নরোদম সিহানুক নামে একজন আছে। সিহানুক না হয় ঠিক আছে। তাই বলে নরোদম মানে নরের অধম!

রসিকের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু তাকে ডাকা শুরু করল জাপানি বন্ধু নামে। তার দেখা দেখি অন্য কয়েকজনও। রসিক একটু খুশি হলো মনে মনে। আপাতত কম্বোডিয়া থেকে তো বের হওয়া গেল। উন্নত জাপানের মানুষ হতে তার তেমন আপত্তি নেই।

কর্ম জীবনে প্রবেশের পর চেহারা নিয়ে কোনো বিব্রতকর অবস্থায় তাকে পড়তে হলো না। স্বাস্থ্যটা তখনও যথেষ্ট ভালো তার। এজন্য পাত্রীপক্ষ পিছিয়েছে- তেমনটা ঘটেনি।

বিয়ের পর রসিক বান্দরবান গেল সস্ত্রীক। উদ্দেশ্য বনে জঙ্গলে দুয়েক দিন কাটিয়ে আসা। একদিন বান্দরবান উপজেলা পরিষদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে, স্ত্রী যথেষ্ট দূরে দাঁড়িয়ে কার সঙ্গে যেন কথা বলছে। এমন সময় যথেষ্ট সুন্দরী এক চাকমা তরুণী রসিকের সামনে এসে হাজির। শুদ্ধ বাংলায় সে তাকে জিজ্ঞেস করল রসিক তাদের জাত অর্থাৎ চাকমা কিনা। তার সঙ্গে রসিকের একটু মজা করতে ইচ্ছা হলো। রসিক উপরে নিচে মাথা নাড়াল অর্থাৎ হঁ্যা।

তুমি কোথায় থাক? মেয়েটি রসিককে জিজ্ঞেস করল। রসিক তার গাল দুটি ফুলিয়ে মুখ বন্ধ করে ইশারায় বলল ওদিকে। মেয়েটি তার দুকানে আঙুল ঢুকাল, বলল শুনতে পাচ্ছ? রসিক মাথা দোলাল- যার অর্থ হঁ্যা। গলা এবং মুখের দিকে ইঙ্গিত করল যার মানে হলো সে কথা বলতে পারছে না। তুমি সুস্থ হয়ে আর একদিন এখানে এসো, আমি পাশের অফিসে কাজ করি বলে মেয়েটি চলে গেল। স্ত্রী পুরো ঘটনাটাই প্রত্যক্ষ করেছে দূর থেকে। তুমি নাক বুঁচির সঙ্গে কী ঘুটুর ঘুটুর করলা এতক্ষণ? স্ত্রী বলল। ঘুটুর ঘুটুর করলাম কোথায়? ও আমাকে কোথায় থাকি, কী করি ইত্যাদি জিজ্ঞেস করল। তুমি কি বললে? আমি বললাম, আশপাশেই থাকি। আগামী রোববার এখানে আসব। আর কিছু বলেনি? হঁ্যা বলেছে, বলেছে আমাকে ওর ভালো লেগেছে। সুস্থ হয়ে আর একদিন এখানে আসার জন্য সে আমাকে অনুরোধ করেছে।

তুমি আবার অসুস্থ হলে কবে? তোমার বাঁদরামিটা গেল না আর। বান্দরবান এসেছি, একটু বাঁদরামি না করলে মানায়! রসিক বলল। 'রসিকের স্ত্রী ভীষণ রেগে গেল। নুতন বিয়ে তো, সে রাগ ভাঙাতে কত যে কাঠ খড় পোড়াতে হয়েছিল রসিককে সেদিন।

২০০২ সালে রসিক ইংল্যান্ডে যায়। বিভিন্ন দেশের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে অবকাশে কাজ করে। এক বিশ্ববিদ্যালয়ের ডরমেটরি পরিষ্কারের কাজে তাদের ডাকা হয়। সেখানে পরিচয় হয় নাজিয়ার সঙ্গে। অবিকল দেখতে বাঙালি মেয়েদের মতো। রসিক চমকে ওঠে তাকে দেখে কোনো বাঙালি মেয়েকে এ জাতীয় কাজে রসিক পায়নি। মেয়েটি রসিকের দিকে এগিয়ে এলো। তুমি কি মালয়েশিয়ান? সে রসিককে জিজ্ঞেস করে? রসিক হাসে যার মানে হলো হতে পারে নাও হতে পারে। তোমার নাম কী? রসিক! এটা আবার কী ধরনের নাম? এ নামের মানে কী? আসলে আমি বাঙালি, বাংলাদেশ থেকে এসেছি। আমার নামের মানে হলো 'তামসার রাজা'।

তুমি সবকিছু নিয়ে তামাশা করো? আশা করি, আমাক নিয়ে তুমি তামাশা করবে না। তামাশা সহ্য করার মতো আমার মনের অবস্থা নেই। আমি মনে করেছিলাম, তুমি মালয়েশিয়ান। রসিক, তুমি কিছু মনে করো না। আমি একটু রেস্ট নেব। ততক্ষণ তুমি কাজ চালিয়ে যাও। একটু পরে আমি তোমার সঙ্গে হাত লাগাব। আমি সকালেই আমার ইউনিটে কাজ করেই তবে এখানে এসেছি। টিউশন ফি দিতে পারিনি তো তাই রেজাল্ট আটক। এক্সটা কাজ করছি তাই। তার চেহারায় ক্লান্তির ছাপ। আমি তাকে বললাম, তুমি চুপচাপ শুয়ে রেস্ট নাও। পুরো রুম আমি ক্লিন করছি।

না, তা হয় না, রসিক। আমি পাঁচ মিনিট রেস্ট নেব। আমি তাকে বারণ করি। তখন বয়সটাই এমন, একজন যুবতীর জন্য অনেক কিছুই করতে মন চায়। আমি দ্বিগুণ বেগে কাজ করতে শুরু করলাম। ঠিক পাঁচ মিনিট পরে সে আমার সঙ্গে কাজে হাত লাগাল। সবচেয়ে কঠিন কাজটিতেই সে হাত লাগাল। কোন অবস্থাতেই তাকে নিবৃত করা গেল না। মালয়েশিয়া তো এমনি এমনিই এশিয়ান টাইগারে পরিণত হয়নি।

সিঙ্গাপুরে চায়না টাউনে ঘুরছে রসিক। এক দোকানে ঢুকেছে টুকিটাকি কিছু কেনার জন্য। তোমার বাড়ি কি কম্বোডিয়ায়? রসিককে এক যুবতী জিজ্ঞেস করল। রসিক হাসিমুখে মাথা নাড়ে কি নাড়ে না। সে যা বুঝার বুঝে নিক। রসিক তার দোকান থেকে কী একটা জিনিস কিনে। ওই পণ্যের জন্য সম্ভবত ওই দিন যুবতীটি তার কাছ থেকে দুই ডলার সে কম রেখেছিল।

চেহারাটাই কী আসল? মানুষের আসল চেহারাটা কি সব সময় দেখা যায়? আজ রোহিঙ্গারা আরাকানে মার খাচ্ছে। তারা দেখতে বাঙালিদের মতো। তাদের চেহারা যদি রাখাইন বৌদ্ধদের মতো হতো তা হলে কী তারা এভাবে মার খেতো? শুধু ভিন্ন চেহারার কারণে মানুষ কেন মার খাবে? তার চেহারা তো সে বানায়নি। হায় মানবতা! তুমি চেহারার খোলসে আর লুকিয়ে থেকো না।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে