রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১
বই আলোচনা

আলস্নামা ইকবালের আত্মদর্শন

নতুনধারা
  ২৩ জুন ২০২৩, ০০:০০

পৃথিবীতে সব কবিকে মহাকবি বলার অভ্যেস আমাদের গড়ে ওঠেনি। তবে আলস্নামা ইকবালকে আমরা মহাকবি হিসেবেই জানি। শুধু আমরা নয়, একসময় তাকে সারা ভারতবর্ষে মহাকবি হিসেবে তাকে সম্মান দেওয়া হতো। আজও মহাকবি আলস্নামা ইকবালকে জানার ও তার দর্শনকে চর্চা করার প্রয়োজন থেকে গিয়েছে।

ইকবাল ছিলেন একজন দার্শনিক, একজন সুফিবাদী, ব্রিটিশ ভারতে মুসলিম জাগরণের প্রেরণাদাতা, সর্বোপরি তিনি একজন মহাকবি। তিনি ছিলেন একজন রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, ছিলেন একজন ব্যারিস্টার। ৪৩২ পৃষ্ঠার বিশাল বইয়ে মোস্তাক আহ্‌মাদ ইকবালের দর্শন, কাব্যগ্রন্থ রুমুয-ই-ইলাহী, বিশ্বে তার দর্শনের প্রভাব, উপমহাদেশে মুসলিম রেনেসাঁর চেতনা সৃষ্টি, মহাকবির শিক্ষা ও অনুশীলন চিন্তা, সাহিত্য ও চারুকলা বিষয়, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের রাজনীতির বিষয়গুলো নিয়ে লিখেছেন। তবে ইকবালের বহুল পঠিত শিকওয়া এবং জবাব-ই-শিকওয়া বইটি নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা থাকা প্রয়োজন ছিল।

'খুদী কো কর বুলন্দ এতনা কে হার তাকদীর ছে পহলে/খোদা খোদ বান্দা ছে পুছে বাতা তেরি রেজা কিয়া হ্যায়', কবিতার চরণ দুটির মর্মকথা হচ্ছে মানুষকে সৃষ্টি করার আগে খোদা তার তকদির বা ভাগ্যকে কিভাবে লিখবেন, তার ভাগ্যকে ভরিয়ে দেবেন, না কী সে অন্য কিছু চায়!' এখানে গদ্যকার ইকবালের মন্তব্য লেখেন, 'ভিক্ষুক আজীবন ভিক্ষা করে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে পারে না। বরং ভিক্ষার ফলে গরিব আরও গরিব হয়।' (পৃ-১১)। এটি ঠিক, ইকবালের দর্শনের সবচেয়ে শক্তিশালী আবেদন, সংবেদনই হচ্ছে এটি। তবে, ইকবাল তার দর্শনকে মুহাম্মদ (সা.আ.)-এর দর্শনের অনুগামী বিবেচনা করেন। 'আসরারে খুদী' কাব্যগ্রন্থ এটিই ধারণ করে আছে। আসরারে খুদীতে তিনি বলেছেন, 'জীবনের সার্থকতাই হচ্ছে কাজের মধ্য দিয়ে। একমাত্র ব্যক্তিত্ববোধই পারে কাজের গতি সঞ্চার করতে এবং জীবনের সার্থকতা ফিরিয়ে আনতে।' (পৃ-১৫)।

ইকবালকে পাকিস্তানের স্বপ্নদ্রষ্টা বলা হয়ে থাকে। তারও আগে ইকবাল যখন ১৯০৫ থেকে ১৯০৮ সালে বিলেতে উচ্চতর শিক্ষা লাভের জন্য যান তখনি তিনি ইউরোপীয়দের সামনে মুসলিমদের আধ্যাত্মিক ও তাত্ত্বিক শিক্ষা এবং দর্শন তুলে ধরেন। এসব দর্শনতত্ত্বের গভীর জীবনবোধ ও মানবতাবোধ সম্পর্কে ইউরোপের চিন্তাবিদরা আলোকিত ও বিস্মিত হন। 'লন্ডনে ১৯০৮ সালে তার থিসিস উবাবষড়ঢ়সবহঃ ড়ভ গবঃধঢ়যুংরপং রহ চবৎংরধ, ১৯২০ সালে ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ডক্টর আর.এ. নিকলসন কর্তৃক 'আসরারে খুদী'র অনূদিত ঝবপৎবঃং ড়ভ ঝবষভ, ১৯৩৮ সালে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, লন্ডন থেকে ্তুঞযব ৎবপড়হংঃৎঁপঃরড়হ ড়ভ জবষরমরড়ঁং ঞযড়ঁমযঃং রহ ওংষধস্থ প্রকাশিত হলে পাশ্চাত্যের চিন্তা-জগতে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। তার খুদী-দর্শন পাশ্চাত্যের জড়বাদী মানসে এক নবতর জীবনবোধের সন্ধান দেয়।' (পৃ-১৪৮)।

'মুসলমানদের মতো শিখ ও হিন্দুরাও ইকবালকে শ্রদ্ধার চোখে দেখত। তার সাহিত্য সেবার স্বীকৃতি হিসেবে এ তিন জাতির পক্ষ থেকে লাহোরের বাসিন্দারা সাড়ম্বরে তাকে সংবর্ধিত করে যোগ্য মর্যাদার আসনে সমাসীন করে।' (পৃ-১৪৯)।

প্রবাস জীবনে বিশ্বদর্শনের আরও অনেক বিষয়ে অবগত হন মহাকবি ও স্যার ইকবাল। এ সময়ই তার মাঝে আগের দর্শনতত্ত্ব্ব মুছে গিয়ে নতুন যে বিশ্বমানবতত্ত্ব জাগ্রত হয় তাতে তিনি বিশ্ববাসীকে শোনান, 'স্মরণ রেখ যে, মুসলমান জাতি খাস কোনো স্থান বা দেশের সঙ্গে সীমাবদ্ধ নয় যে, যদি ওই ওতন বা বংশ বা দেশ ধ্বংস হয়ে যায় তবে মুসলমান ধ্বংস হয়ে যাবে। তুমি ইউসুফের মতো তোমার কেনান রাজত্বও আছে আবার তুমি মিসরের রাজ প্রাসাদেরও অধিকারী। সুতরাং সারা বিশ্ব মুসলমানের রাষ্ট্র। ইসলাম কখনো শেষ হতে পারে না পৃথিবী থেকে।' (পৃ-৩২২)। তিনি ইউরোপ ভ্রমণে বস্তুজগত থেকে সেখানকার মানুষদের বাস্তব জগতে, মানব সৃষ্টির মূল রহস্যের দিকে ফিরে আসার আহ্বান জানান। পাশ্চাত্যের ইন্টেলেকচুয়ালদের মধ্যে প্রথম তিনি গ্রানাডা নগরের পতনের পর নতুনকরে ভুলে যাওয়া ইসলামের মানবতত্ত্ব ও সৃষ্টিতত্ত্বের আদর্শ তুলে ধরেন। এমনকি আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ শাসক নাজ্জাসী যুগের কথাও তিনি তুলে ধরে নবী (সা.)-এর বিশ্বমানবতা ও ইসলামের আলোকোজ্জ্বল শিক্ষার কথা সবাইকে স্মরণ করিয়ে দেন।

তিনি পাকিস্তানের জাতীয় কবি বলে আমরা হয়তো কখনো নাক কোঁচকাই। কিন্তু আজও ভারতের বেশ কয়েকটি প্রদেশে 'সব সে বড়া হ্যায় আচ্ছা/হিন্দুস্তা আ হামারা' ইকবালের লেখা গানটি জাতীয় সঙ্গীত বিবেচনা করে গেয়ে সেখানকার মানুষ নিজেদের দেশপ্রেম প্রকাশ করে। সেই মহাকবিকে নিয়ে লিখেছেন মোস্তাক আহমাদ। বইটি মহাকবি ইকবালের বিবিধ জ্ঞানচর্চা, দর্শনতত্ত্ব ও কবিতা নিয়ে আমাদের আলোকিত হয়ে উঠতে প্রেরণা দেয়।

আলস্নামা ইকবালের আত্মদর্শন/মোস্তাক আহমাদ। প্রকাশক/রিয়াজ খান, রোদেলা প্রকাশনী, বাংলাবাজার, ঢাকা। প্রথম প্রকাশ/ বইমেলা ২০২৩। প্রচ্ছদ/অরূপ মান্দী। মূল্য/ ৬০০ টাকা।

-আতাতুর্ক কামাল পাশা

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে