সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

ক্রশ দ্যা বর্ডার

ইরানী বিশ্বাস
  ২৮ জুলাই ২০২৩, ০০:০০

কর্কশ সুরে মোবাইলটা বেজে উঠেছে। হাতঘড়িটার ফিতে বাঁধতে বাঁধতে মোবাইলটার কাছে এগিয়ে যায় জ্যোতি। বর্ডার ক্রশ করে মোবাইল সিম পাল্টে গেছে। নতুন নম্বরটি সম্পর্কে অফিসের লোকজন ছাড়া আর তেমন কেউ জানে না। এমনই হয়ত হয়ে যায় জীবনের নিয়মে। বিয়ের পরে বা বিয়ে বিচ্ছেদের পর মানুষ এমন করেই প্রাকৃতিক নিয়মে পাল্টে যায়। মানুষের জীবনে কেন এত পরিবর্তন! কেন জীবন চলতে পারে না একই নিয়মে! বেশ কিছুদিন হলো এসব প্রশ্ন ঘুরতে থাকে জ্যোতির মনে।

এক দেশ ছেড়ে অন্য দেশে যেতে এত বাধাবিপত্তি। যদি বাংলাদেশের গন্ডি পেরিয়ে ভারতে না আসত তবে জ্যোতিও এ কথাটা কিছুতেই জানতে পারত না। একই মানুষ আমরা তবু কত হানাহানি, কত কাড়াকাড়ি দেশের সীমা, শাসন, অধিকার নিয়ে। দেশের সীমারেখার মত সংস্কৃতি, ধর্মীয় অনুশাসন রক্ষায় মরিয়া প্রতিটি মানুষ। নিয়মের তারকাঁটার বেড়া ডিঙিয়ে তবু মানুষ যায় এক দেশ ছেড়ে অন্য দেশে। মানুষে মানুষে এত ভেদাভেদ, এত সমস্যা, কেন? অনেক ভেবে মনটা ভারী হয়ে ওঠে। নিশ্চয়ই অফিস থেকে ফোন করেছে, ভেবে রিসিভ করে,

-হ্যালো কে বলছেন? অপেক্ষায় থাকে জ্যোতি। ওপাশ থেকে কণ্ঠ ভেসে আসতেই আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়ে জ্যোতি।

-আন্টি আপনি ফোন করবেন আমি ভাবতে পারিনি। সত্যি আন্টি এত ভালো লাগছে, যা বলে বোঝাতে পারব না। জ্যোতির উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা শুনে কমলীকা বুঝতে পেরেছে, জ্যোতি সত্যি খুব অভিভূত। অনেক কথা বলে মোবাইলের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

\হতবুও হাতে মোবাইল ধরে রাখে কয়েক মিনিট। নিজের মনে হেসে ওঠে আর ভাবে, সে বাংলাদেশ থেকে মোটেই দূরে নয়। মোবাইলের অপর প্রান্ত থেকে যখন কমলীকার কণ্ঠ ভেসে আসছে। জ্যোতি শিহরিত হয়। কি অদ্ভুত এক ভালোলাগা আবিষ্ট করে তাকে। দেশকে কতটা ভালোবাসে তা এদেশে না এলে জ্যোতি বুঝতেই পারত না। দূরত্ব মানুষকে স্মৃতিকাতর করে, বিরহ বাড়িয়ে জন্ম দেয় প্রেমের। এ কারণেই দেশ থেকে যতদূরে যায় তত যেন দেশের প্রতি মায়া বেড়ে যায়। মনে মনে হেসে ওঠে জ্যোতি, সত্যি-ই তো কাছে থাকলে টের পাওয়া যায় না। দেশকে সে কতটা ভালোবাসে।

কমলিকার মাধ্যমে জ্যোতি এনজিওর কাজটা পেয়েছে। শুধু এটুকুই তার পরিচয় নয়। জ্যোতি যখন স্বাবলম্বী হতে মরিয়া হয়ে দিনের পর দিন ছোটাছুটি করছিল, তখন কমলিকা তার পাশে দাঁড়িয়েছিল। তাই তো অঘোষিত মা-মেয়ের সম্পর্ক ওদের। মানুষ যখন আশ্রয়হীন হয়ে পড়ে তখন খড়কুটো ধরেই বাঁচতে চায়। জ্যোতির জীবনে কমলিকা যেন এমনই একজন। কমলিকা অবিবাহিত, বাংলা একাডেমিতে চাকরি করেন। নিজের সন্তানের মা হতে পারেননি কিন্তু জ্যোতিকে মায়ের মমতা থেকে বঞ্চিত করেননি। তাই তো দেশ ছেড়ে এতদূরে এসেও মায়ের মমতার টানে ফোন করতে ভুল করেননি। এসব কথা ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে জ্যোতি।

সময় হয়ে গেছে সেমিনারে উপস্থিত হতে হবে। কিন্তু জার্নির কষ্ট তাকে একেবারে ক্লান্ত করে দিয়েছে। তবুও গুছিয়ে নিয়েছে প্রয়োজনীয় সবকিছু। কাগজ-পত্র, পাসপোর্ট, হ্যান্ডব্যাগ, টাকা-পয়সা সব ঠিকঠাক আছে দেখে তবেই আশ্বস্ত হয়। সে এখন ভিন দেশে বসবাস করছে। পাসপোর্টই তার পরিচয়পত্র। তা না হলে যে কোনো মুহূর্তে তাকে বিপদে পড়তে হতে পারে।

হোটেল থেকে সেমিনার খুব বেশি দূরে নয়। সম্ভবত গাড়ি আসবে তাদের নেওয়ার জন্য। এরই মধ্যে রেডি হয়ে পায়চারি করতে থাকে জ্যোতি। বাংলাদেশ থেকে তার সহকর্মী লিটন এসেছে তার সঙ্গে। লিটন পাশের রুমে আছে। ইন্টারকম তুলে তাকে একবার ফোন করে জ্যোতি।

-লিটন আপনি কি রেডি? জ্যোতি অপেক্ষা করে উত্তরের। কিন্তু ও পাশ থেকে ঘুম জড়ানো কণ্ঠে লিটন উত্তর দেয়,

-কয়টা বাজে?

-কয়টা বাজে মানে? আপনি এখনো ঘুম থেকেই ওঠেননি!! জ্যোতির কণ্ঠে উৎকণ্ঠা প্রকাশ পায়।

-ম্যাডাম আপনি কি রেডি হয়েছেন?

-রেডি মানে! আমাদের তো এক্ষুণি নিতে আসবে। লিটন আপনি এক্ষুণি রেডি হয়ে নিন।

-ওকে। লিটন ধড়ফড় করে বিছানা ছেড়ে ওঠে। জ্যোতি ইন্টারকম রেখে আবার পায়চারি করে। ভেতরে ভেতরে একটা চাপা উত্তেজনা কাজ করছে। জীবনে প্রথম দেশের গন্ডি পেরিয়ে অন্য দেশে আসা। শুধু কী ভারত! এখানে দেখা হবে, সার্কভুক্ত সবকটি দেশের মানুষের সাথে। সেমিনারে তাদের সাথে মতবিনিময় হবে।

মহারাষ্ট্রে অনেকেই আছেন বাঙালি। তবে সরাসরি বাংলাদেশি নয়। এদের বেশির ভাগ ওয়েস্ট বেঙ্গলের মানুষ। জীবিকার তাগিদে মহারাষ্ট্রে এসে স্থায়ী বসতি হয়েছে। তাদের মধ্যে আছেন গৌর লাল সোম। গতকাল তিনি হোটেলে এসেছিলেন। রিসিপশনে বসে অনেক কথা বললেন জ্যোতির সাথে। বেশ ভালো মনে হলো তাকে। মহারাষ্ট্রের হয়ে তিনি কাজ করছেন। তার সাথে কথা বলে অনেক কিছু জানা গেল, ভেবে জ্যোতি বেশ খুশি অনুভব করে।

মানবাধিকার বিষয়টি সম্পর্কে বেশির ভাগ মানুষই আসলে সচেতন না। তাদের কাছে এ নিয়ে একটি বদ্ধ ধারণা আছে। মৌলিক অধিকার খর্ব করাই হলো মানবাধিকার খর্ব। আমরা অনেকেই মানবাধিকারের সংজ্ঞা জানি না। এতে নারী-পুরুষ উভয়ই ভিক্টিম হতে পারে। গৌর লালের কথাগুলো বার বার কানে বেজে চলছে। জ্যোতি চিন্তা করছে, সত্যিই তো মানুষের কাছে অনেক তথ্য থাকে। হয়তো এজন্য সেমিনারের আয়োজন করা। যাতে তথ্য বিনিময়ের মাধ্যমে মানুষ তার মানবাধিকার সম্পর্কে আরও বেশি সচেতন হতে পারে। বেশ লাগছে তার। কত নতুন কিছু জানতে পারছে। আরও হয়তো তার জন্য নতুন অজানা অনেক কিছু অপেক্ষা করছে। টেবিলে রাখা জলের বোতলের ঢাকনা খুলে গস্নাসে ঢালে। না খেতে ইচ্ছে হচ্ছে না। আবার পায়চারি করছে। কি সব আবোল-তাবোল মনে আসছে। সেই ঢাকার কথা।

রুমির কথা আজ অনেকদিন পর মনে পড়ছে। বিয়ের পর রুমি অনেক বদলে গেছে। তার সাথে দেখা হওয়ার কোনো উপায় নেই। একেবারে গৃহবধূ হয়েছে। জ্যোতি অবাক হয়ে যায় রুমির কথা ভেবে। কী করে একটা মাস্টার্স পাস করা মেয়ে পাল্টে যায়। এ বিষয়ে রুমির অবশ্য অন্য যুক্তি। সে মনে করে, ঘরের বাইরে গেলে সংসার টেকে না। সবকিছুর বিনিময়ে সংসার টেকানোই যেন রুমির প্রধান কাজ। ভেবে অবাক হয় জ্যোতি। এই রুমি আর সে একদিন পণ করেছিল, নিজেদের পাল্টাতে হবে। পাল্টাতে হবে প্রাচীন ধ্যান-ধারণা। জ্যোতির বিয়ের পর সে নিজেও পাল্টে গেছে। আর রুমির বিয়ের পর সেও পাল্টে গেছে। দুজনের পাল্টে যাওয়ার ধরন ঠিক বিপরীত।

তবে আর যা-ই হোক, স্বামী-সন্তান নিয়ে ও খুব সুখেই আছে বলা যায়। একটা ফুটফুটে ছেলে হয়েছে রুমির। ভাবতেই বুকের ভেতর খালি করে একটি বড় নিশ্বাস বেরিয়ে আসে।

জ্যোতি নিজেও স্বপ্ন দেখত, তার সন্তান হবে। তাকে মা বলে ডাকবে। ছোট ছোট হাত-পা নেড়ে কান্নাকাটি করবে। পুরো ঘরটি জুড়ে থাকবে তার শব্দ, তার উপস্থিতি। জ্যোতি অনেক ব্যস্ত হয়ে পড়বে তাকে নিয়ে। সন্তান আর সংসারের ঝামেলায় স্বামীর দিকে নজর দেওয়ার অবসর থাকবে না। সে অভিমান করে বলবে,

-তুমি তো আমাকে ভুলেই গেছ। ও-ই হয়েছে তোমার সব।

-তুমি কি ওকে হিংসা করছ? জ্যোতির এ কথা শুনে হেসে উঠবে। আর জ্যোতিকে জড়িয়ে ধরে বলবে,

-তোমরাই তো আমার ভালোবাসা। তারপর বাচ্চাটাকে গাল টিপে বলবে, কি জুনিয়র সজল? আমার ভালোবাসায় ভাগ বসালে তাই না?

এসব কল্পনা এখন আর তাকে তাড়িয়ে বেড়ায় না। মা হওয়ার স্বাদ অনেক আগেই সে বিসর্জন দিয়েছে। এখন শুধু বেঁচে থাকা, মানুষ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করাটাই তার কাজ।

ইন্টারকম বেজে ওঠে। গাড়ি এসেছে তাদের নেওয়ার জন্য। দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে লিটন। সকাল থেকে লিটনের ওপর মনে মনে প্রচন্ড রেগে আছে। জীবনের প্রথম এত দূরে আসা।

সারাক্ষণ টেনশন কাজ করছে জ্যোতির মনে। এমনিতেই একা মেয়ে মানুষ, তার ওপর অফিসের হয়ে এসেছে। দেশের মধ্যে হলে কোনো ব্যাপার ছিল না। একেবারে দেশ ছেড়ে দেশের বাইরে অন্য দেশে। এ ছাড়া শুধু তো আর ভারত নয়, এখানে সার্কভুক্ত দেশের মানুষগুলোর সাথে নিজেকে শেয়ার করবে। অনেক অস্বস্তি হলে জ্যোতির মাথাব্যথা হয়। তাছাড়া সকালে ব্র্রেকফাস্ট করা হয়নি।

ভোর ৫টায় সাধারণত জ্যোতির ঘুম ভাঙে না। তবে আজ কেন এমন হলো সে নিজেও বুঝতে পারছে না। এত ভোরে ঘুম ভেঙে গেলেও আর ঘুমাতে পারেনি সে। ঘুমানোর প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও আজ কি হচ্ছে কে জানে। কিছুতেই দুচোখের পাতা এক করতে পারছে না। বাংলাদেশ থেকে আসতে অনেক ঝক্কি-ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। এই দুই/তিন দিনের জার্নিতে জ্যোতি একেবারে ভেঙে পড়েছে। টেবিলে ব্রেকফাস্ট পড়ে আছে। খুলে দেখা হয়নি পর্যন্ত। কয়েকবার দরজায় ধাক্কা দিয়ে না পেয়ে কলিং বেলে চাপ দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে লিটন। চটপট বের হবে ভেবেও সবকিছু রেখে ওয়াশরুমে যায় জ্যোতি। এটা জ্যোতির ছোটবেলার অভ্যাস। কাপড় পরে রেডি হওয়ার পর একবার ওকে ওয়াশরুমে যেতেই হবে। রুমি বলত, কোথাও যাওয়ার সময় তোর টেনশন বেড়ে যায়, তাই তোর এ অবস্থা।

প্রয়োজনীয় সবকিছু নিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে আসে জ্যোতি। লিটনকে রেডি দেখে আশ্বস্ত হয়। দুজনে লিফটে নেমে আসে।

হলভর্তি মানুষজন। বেশকিছু মানুষ এসেছে এখানে। প্রতিনিধিদের ব্যাজ পরিয়ে দিচ্ছে একজন কনভেনার। জ্যোতির গায়ে যে ব্যাচটি লাগানো আছে, তাতে ইংরেজিতে লেখা আছে 'জ্যোতি, বাংলাদেশ'। বেশ ভালোই লাগছে, তার। সবার সামনে ঘুরছে, ব্যাজটি যেন তার পরিচয় বলে দিচ্ছে। হঠাৎ ভিড়ের মধ্যে একটি কণ্ঠ শুনে অবাক হয়ে যায়,

-জ্যোতি!! আপ বাঙগালা দেশমে আগায়া?

ভিড় ঠেলে একটি বয়স্ক লোক এসে জ্যোতির সামনে দাঁড়িয়েছে। তার চোখে বিস্ময়! জ্যোতি কিছু বোঝার আগেই লোকটি জ্যোতির হাত ধরে কেঁদে ফেলে। আশপাশের অনেকের দৃষ্টি তখন তাদের দিকে। লোকটি কেন কাঁদছে, উপস্থিত কেউ-ই ব্যাপারটা বুঝতে পারছে না। কান্না থামিয়ে লোকটি যে বিবরণ দিল তাতে জ্যোতির বিস্ময় আরও বেড়ে গেল।

বয়স্ক লোকটির নাম চৈতন্য নাথ সিংহ। তিনি বাংলাদেশের অধিবাসী ছিলেন। তার বয়স যখন ১২/১৪ বছর তখন তিনি বাবা-মায়ের সাথে ভারতের মহারাষ্ট্রে চলে আসেন। বাড়ি ছিল বাংলাদেশের বৃহত্তর বরিশাল জেলার কোনো এক গ্রামে। তারপর দেশ ভাগ হয়ে যাওয়ার পর আর কখনো তাদের পূর্ব বাংলায় যাওয়া হয়নি। এমনকি তাদের বিষয়-সম্পত্তি কি হয়েছে, তাও বলতে পারছেন না। মহারাষ্ট্রে এসে শুধু তার ভাষার পরিবর্তন হয়নি। তিনি চৈতন্য নাথ সিংহ থেকে হয়েছেন চমন সিন্‌হা। সবাই তাকে এখন চমন জি বলেই চেনেন। সেই ছোট্ট চৈতন্য আজ বার্ধক্যে দাঁড়িয়েছেন। চেহারায় অনেক পরিবর্তন। কিন্তু দেশের প্রতি, জন্মস্থানের প্রতি মমতার এতটুকু পরিবর্তন হয়নি।

আবেগে আপস্নুত চৈতন্য জ্যোতিকে এক নিশ্বাসে জিজ্ঞেস করে সব কথা। বরিশাল কি এখনো আগের মতো আছে? বাংলাদেশের আকাশে কি তেমন মেঘ ভেসে যায়, ভেজা তুলার মতো! আর মহালয়ার রাতে শিউলিফুল ফোটে? জান এই রাতের আগের দিন আমার বাবা বড় একটা রেডিও মুছে পরিষ্কার করে রাখত বারান্দায়। ভোর পাঁচটায় জোরে শব্দ করে আকাশবাণী কোলকাতা থেকে মহালয়া শোনানো হতো। 'যা দেবী সর্বভূতেসু সংস্থতিতা....'

এই বন্দনা শুনতে শুনতে পুব আকাশ ফর্সা হতো। মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসতাম দিদিদের হাত ধরে। তারপর শিউলিতলায় ফুল কুড়াতাম। সাদা পাপড়ির নিচে কমলা রং যেন ছাপিয়ে যেত আমাদের মনে। অধিক আগ্রহে তাকায় জ্যোতির দিকে। নির্বাক জ্যোতি দেখছে হলদেটে হওয়া কোটরের দুটি চোখে যেন বাংলাদেশের মানচিত্র। চমন সিনহা আবার তেমনি করে বলতে থাকে, বিষখালী নদী, কথাটা বলতেই, যেন চোখের কোণে স্বপ্ন দুলছে। গল্পের মতো বলছে, বরিশালের একটি গ্রামে আমার জন্ম হয়েছিল, নাম বেতাগী। বিষখালী নদীর ঠিক পাড়ে। আমরা স্কুল ছুটি হলে নদীর পাড়ে ঘুড়ি ওড়াতাম। গরমের দুপুরে বিষখালীতে ঝাপাঝাপি করতাম। আর দুর্গাপূজার সময় ভাসানো দেখতে যেতাম। নৌকাবাইচ, এখনো কানে বাজে সেই শব্দ, মাঝিদের ভাটিয়ালী সুর।

অবাক হয়ে জ্যোতি তাকিয়ে আছে লোকটির দিকে। ছোটবেলার সোনালি স্বপ্ন দুলছে দুচোখের দৃষ্টিতে। হঠাৎ যেন ১২/১৪ বছরের তরুণ বয়সে ফিরে গেছেন তিনি। কথার এক পর্যায়ে তিনি হঠাৎ করে জ্যোতির হাত ধরে বললেন, তোমাকে কিন্তু একবার আমাদের বাড়িতে যেতে হবে। আমি আমার নাতিনাতনিদের দেখাব বাংলাদেশের মানুষ। আমার কাছে এখন বাংলাদেশ মানে আমার পরিবার মনে হয়। আর তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি সেই আমাদের বাড়ির পাশের মেয়েটি। যে ছিল আমার খুব চেনা।

জ্যোতির মনে একটি দোলা লাগল। ভালোলাগার দোলা। মানুষটির কাছে বাংলাদেশ এখনো কত আপন হয়ে আছে। সত্যিই তাহলে বাংলাদেশ মানে মমতার বন্ধন।

এ বন্ধনে যে একবার জড়িয়েছে সে কিছুতেই ভুলতে পারে না।

সেমিনার শেষে, চৈতন্য সিংহের মতো আরও অনেকেই এসেছেন জ্যোতির কাছে।

তাদের চোখেও বিস্ময়। কারও দুই পুরুষ আগে বাংলাদেশে ঘরবাড়ি ছিল। কারও বাবা-ঠাকুর দাদা ছিলেন বাংলাদেশে। সেমিনারে এখন বাংলাদেশ নিয়ে একটি হইচই পড়ে গেছে।

ভারতের সাথে বাংলাদেশের যে সম্পর্ক, বোধ করি অন্য কোনো দেশের সাথে তা নেই।

মাত্র কয়েক বছর আগে ১৯৪৭ সালের আগেও এ দুটি দেশ ছিল একই মানচিত্রের সীমারেখায়। এ সেমিনারে অংশগ্রহণ করেছেন ভুটান, মালদ্বীপ, শ্রীলংকা, পাকিস্তানসহ অন্যান্য দেশে বসবাসরত কয়েকজন বাঙালি। এখানে পাকিস্তানের যে লোকটি এসেছেন, তার চোখেও বিস্ময়। আসলে, পাকিস্তান আর ভারতে এখনো অনেক মানুষ ছড়িয়ে আছে, যাদের শিকড় রয়ে গেছে বাংলাদেশে। দেশের গন্ডি পেরিয়ে এতদূরে এসে জ্যোতি যেন নতুন করে উপলব্ধি করছে দেশপ্রেম।

কিছুতেই না নিয়ে ছাড়বে না জ্যোতিকে। অগত্যা চমন সিনহার বাড়িতে যেতেই হলো সাথে লিটনও আছে। জ্যোতিকে নিয়ে বাড়ির গেটে ঢুকতেই একটা হইচই পড়ে গেল। বিরাট বাড়ির গেটে দারোয়ান দাঁড়িয়ে আছে। সবাই মারাঠি ভাষায় কথা বলছে। শুধুমাত্র চমন সিনহা আধা বাংলায় কথা বলছে। জ্যোতি মোটামুটি হিন্দিটা বুঝতে পারে। তবে বলতে পারে না। তাই চমন সিনহা হিন্দি এবং বাংলার সংমিশ্রনটাই বলতে চেষ্টা করছে। এ বাড়ির সবাই তার দিকে এমন করে তাকিয়ে আছে যেন

সে জঙ্গল থেকে এসেছে।

চমন সিনহার ব্যবহারে জ্যোতি সত্যি অবাক হয়ে গেছে। এ বাড়িতে আসার পর থেকে নিজেই এদিক সেদিক ছোটাছুটি করছে। খাবার এনে দিচ্ছে, আবার পাশে বসে বাংলাদেশের অনেক স্মৃতি রোমন্থন করছে।

ছোট ছোট বাচ্চারা দূর থেকে তাকে দেখে উঁকি দিচ্ছে। চোখে-মুখে তাদের রাজ্যের কৌতূহল।

একটি বড় স্টিলের থালায় কত রকমের মিষ্টি। এর অধিকাংশই জ্যোতির নাম না জানা। একজন বয়স্ক মহিলা তার খুব কাছে এসে বসেছে। জ্যোতি তাঁর আপাদ মস্তক একবার ভালকরে দেখে নিল। মাথায় কাঁচাপকা চুল। চেহারায় বয়সের ছাপ পড়লেও মনের দিকে এখনো যুবতী বলা যায়। দুহাত ভর্তি সোনার চুড়ি। গায়ে বড় বড় গয়না, যা সাধারণত বাংলাদেশের বিয়ের কনেরাই পরে থাকে।

জ্যোতিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে মহিলা একটু লজ্জা লজ্জা ভঙ্গিতে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। চমন সিনহা বেশ উৎফুলস্ন ভঙ্গিতে জ্যোতিকে বললেন,

-জ্যোতি বেটিয়া, এ মেরা বিবি। জ্যোতি দুহাত তুলে নমস্কার জানিয়ে মুখে হাসি ঝুলিয়ে রাখে।

তিনি অবাক চোখে জ্যোতিকে দেখছে। তার দুচোখে কত কথা। জ্যোতি যেন তা পড়ে শেষ

করতে পারছে না।

স্বামীর পূর্বপুরুষের দেশ, তার ছোটবেলার স্মৃতিবিজড়িত বাংলাদেশ থেকে এসেছে। যেন তাদের প্রত্যেকের কৌতূহল এখানেই।

চমন সিনহার স্ত্রী মারাঠী। বাঙালি চৈতন্য সিংহের সাথে বিয়ে হয়ে কেমন সুখে আছে। কোনো দিন প্রশ্ন জাগেনি মনে সে একজন মারাঠী আর চৈতন্য সিংহ একজন বাঙালি। তাদের তিন ছেলে দুই মেয়ে। মেয়েদের বিয়ে হয়েছে। এক মেয়ে কানাডা থাকে স্বামীর সাথে। অন্যজন প্রেম করে এক পাঞ্জাবি শিখ বিয়ে করেছে। সেও আমেরিকায় থাকে।

ছেলেদের মধ্যে মহারাষ্ট্রে থাকে কেবল বড় ছেলে। মেঝ ছেলে দিলিস্নতে সরকারি চাকরি করে। পরিবার নিয়ে সেখানেই স্যাটেল্ড। ছোট ছেলে জার্মানি থাকে। এখনো বিয়ে করেনি।

জ্যোতির বাংলাদেশ থেকে আসার খবর শুনে, চমন সিনহার শ্বশুরবাড়ি থেকে অনেকেই এসেছেন। এ বাড়িতে যেন উৎসবের আমেজ কাজ করছে। এই পরিবেশটা জ্যোতি মোটেই আশা করেনি। এ বাড়িতে থাকার প্রতিটি মুহূর্ত সে বেশ এনজয় করছে। প্রতিটি মুহূর্তে নতুন নতুন কিছু ঘটে যাচ্ছে।

রাতে খাবার সময় জ্যোতি বুঝতে পারে, এ বাড়িতে আজ একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন ছিল। বাড়িতে লোক সমাবেশ হয়েছে প্রায় কয়েকশ হবে। বুঝতে বাকি নেই, এই অনুষ্ঠানটা কেবলই তাকে ঘিরে। নিজেকে খুব গর্বিত মনে হচ্ছে জ্যোতির। সে অন্তত একটি পরিবারকে তার কৌশোরের স্মৃতি ফিরিয়ে দিতে পেরেছে। এদেশে না আসলে হয়তো এ পরিবারে এখনো অনেক অজানা কথা রয়েই যেত।

খেতে খেতে চমন সিনহার সাথে জ্যোতির অনেক কথা হলো। শেষ পর্যন্ত যা এসে দাঁড়াল, তা হলো জ্যোতির মায়ের বাবা ছিলেন চমন সিনহার সহপাঠি। ছোটবেলার বন্ধু অমর নাথের নাতনি জ্যোতি।

এত বছর পর বন্ধুর নাতনিকে কাছে পেয়ে চমন সিনহা যেন নিজের ছোট বেলাকে খুঁজে পেয়েছে। জ্যোতির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে চমন সিনহা। তার বুকের ভেতর থেকে যেন কান্না ডুকরে উঠছে।

চোখ দুটো ভিজে উঠছে আর আলোর সামনে চকচক করছে।

শুন্যে দৃষ্টি ছুড়ে চমন সিনহা আপন মনে বলছে। গলা শুনে মনে হচ্ছে সিক্ত হয়ে আছে। কথা বের

হতে বেশ কষ্ট হচ্ছে।

-জ্যোতি বেটিয়া, অমর নাথ খুব শান্ত ছিল। কখনো বেশি কথা বলত না। সারাক্ষণ পড়ালেখায় মনোযোগ ছিল। দাদুর কথা বলতেই জ্যোতির কৌতূহলের যেন অন্ত নেই। দমকা বাতাসে হাসি মিলিয়ে জ্যোতি বলে ওঠে,

-দাদু মরার আগের দিন পর্যন্ত ওরকম শান্তই ছিল। আমি অবশ্য বেশিদিন পাইনি তাকে। তবে মায়ের মুখে অনেক শুনেছি। মাকে দাদু খুব ভালোবাসত। আমার মায়ের নাম জোছনা। দাদু

আদর করে ডাকতেন, কিরণ বলে। কারণ দাদু বলতেন, জোছনা হচ্ছে ধারকরা আলো। কিরণ

হচ্ছে তেজ। তাইতো পরে মায়ের নামের সাথে মিল রেখে আমার নাম রেখেছে জ্যোতি।

\হচমন সিনহার চোখ চকচক করে ওঠে জ্যোতির কথা শুনে। মনে হচ্ছে তিনি চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে ছোটবেলার সহপাঠি অমর নাথের সংসার। সেই ছোট্ট অমর নাথ মাথায় টোপর পরে বিয়ে

করতে যাচ্ছে।

তার সন্তান, নাতি-নাতনি। অমর নাথ এখন আর বেঁচে নেই। কিন্তু চমন সিনহা এখনো বেঁচে আছে কথাটা ভাবতেই মনের মধ্যে ঢিপ করে একটি শব্দ হলো। বাইরে থেকে কেউ শুনতে না পেলেও চমন সিনহা খুব ষ্পষ্ট শুনতে পেল।

রাত বেড়ে চলছে। একে একে আমন্ত্রিত অতিথিরা যে যার গন্তব্যে ফিরে যেতে লাগল। জ্যোতি আর লিটন যাওয়ার জন্য তাড়াহুড়া করতে লাগল। গেটের কাছে এসে ভিড় করেছে বাড়িসুদ্ধ লোক। ছোট ছোট ছেলেমেয়ে পর্যন্ত ঘুমায়নি। তাদের চোখে কৌতূহল। সবাই সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

জ্যোতি পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম জানিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে চমন সিনহার সামনে। একে

একে সবার কাছে বিদায় নেওয়া হয়ে গেছে। চমন সিনহার স্ত্রী জ্যোতির মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করেছেন। ভাষা বুঝতে পারুক আর না-ই পারুক, আন্তরিকতা আর শ্রদ্ধা কখনো আলাদা হয় না।

আসার সময় কিছু টাকা জ্যোতির হাতে গুজে দিয়ে নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে করলেন চমন সিনহা। লিটনের জন্য শার্ট-প্যান্ট, জ্যোতির জন্য সালোয়ার-কুর্তা উপহার হিসাবে দিয়েছেন।

জ্যোতি অন্ধকার গলে এগিয়ে যায় সামনে, পেছনে পড়ে থাকে চমন সিনহার বাঙালি থেকে মারাঠি হওয়ার গল্প।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে