সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

শামসুর রাহমানের কবিতায় পুরাণের ব্যবহার

আহমদ মতিউর রহমান
  ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০

বাংলা ভাষার সর্বকালের স্মরণীয় কবিদের একজন কবি শামসুর রাহমান। বাংলা কবিতার ঐতিহাসিক পরিক্রমায় তিনি অনন্য-অসাধারণ। তিনি কবিতায় নানা বর্ণের ফুল ফুটিয়েছেন। কখনো উদ্ভাসিত করেছেন পাঠককে কখনো বা নৈরাশ্যের আঁধারে ডুবিয়েছেন। সমালোচকরা তাকে বলে থাকেন 'বাংলা কবিতার শুদ্ধতম ধারার গর্বিত উত্তরাধিকার।' কবি শামসুর রাহমান বাংলা কবিতার পথ-পরিক্রমায় তিরিশের আধুনিকতা পেরিয়ে চলিস্নশের অভিনবত্বে স্নাত হয়ে পঞ্চাশের দশকের বাতাবরণে নিজেকে নির্মাণ করেছেন একজন স্বতন্ত্র কবিকণ্ঠ হিসেবে। তার কবিতায় উপমা উৎপ্রেক্ষাসহ নানান রসের ব্যবহার হয়েছে কবিতার বাক নির্মিতির প্রয়োজনানুসারে। আর তিনি ব্যবহার করেছেন নানা প্রতীক। করেছেন ইউরোপীয় মিথের যথেচ্ছ ব্যবহার। তার ইকারুসের আকাশ কাব্যগ্রন্থসহ বিভিন্ন গ্রন্থে এই মিথের ব্যবহার চোখে পড়বে। ইকারুসের আকাশ গ্রন্থের ১৯৯৪ সালের অনন্যা প্রকাশিত সংস্করণে এই কথাটি এসেছে এভাবে- 'সম্ভবত তিনিই আমাদের সর্বশেষ ইয়োরোপ-মনস্ক কবি। তার কবিতায় কোনো কোনো বাক্যবন্ধ এখন আমাদের প্রতিদিনের গদ্যের অন্তর্ভুক্ত; তার কোনো কোনো পদ এখন আমাদের অভিজ্ঞতার উচ্চারণে পর্যবসিত। তার কবিতায় গ্রিক পুরাণ গত তিরিশ বছর থেকে ব্যবহার হয়ে এসেছে। --- এভাবেই ইকারুস, ডেডেলাস, এন্টিগোনি, আর আগামেমনন বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে নতুন জন্ম নিয়েছে এবং তাদের মুখ আমাদের মুখ হয়ে উঠেছে।' [ ভূমিকা : ইকারুসের আকাশ, পৃষ্ঠা-৫ ] আর এভাবেই ইউরোপীয় মিথের মুখগুলো আমাদের মুখ হিসেবে দেখি কবিতায়।

শামসুর রাহমানের জন্ম ২৩ অক্টোবর, ১৯২৯। বাংলাদেশ ও আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি। জীবদ্দশাতেই তিনি বাংলাদেশের প্রধান কবি হিসেবে মর্যাদা লাভ করেছিলেন। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগ তথা পঞ্চাশের দশকে তিনি আধুনিক কবি হিসেবে বাংলা কবিতায় আবির্ভূত হন। এবং অল্প সময়ের ভেতরেই দুই বাংলায় (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম বাংলায়) কবি হিসেবে পরিচিতি পান। আধুনিক কবিতার অনন্য পৃষ্ঠপোষক বুদ্ধদেব বসুর 'কবিতা' পত্রিকায় 'রূপালি স্নান' কবিতাটি প্রকাশিত হলে কবি হিসেবে শামসুর রাহমান সুধীজনের দৃষ্টিলাভ করেন। পরবর্তী সময়ে উভয় বাংলাতেই তার শ্রেষ্ঠত্ব এবং জনপ্রিয়তা প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি নাগরিক কবি হিসেবে খ্যাত, তবে নিসর্গ তার কবিতায় খুব কম ছিল না। তিনি ১৭ আগস্ট, ২০০৬ সালে ইন্তেকাল করেন। মৃতু্যর এত বছর পরও তার কবিতা মানুষকে আলোড়িত করে। তার কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা প্রায় ৭০টি।

২.

শুদ্ধ ধারার কাব্যচর্চায় নিয়োজিত শামসুর রাহমান এক সময় মূলত ব্যক্তিকেন্দ্রিক চিন্তাচেতনায় বা ব্যক্তি নির্ভর অভিজ্ঞতা ও আবেগের উচ্চারণে আবদ্ধ ছিলেন। নাগরিক কবি হিসেবে আমরা তাকে পাই তখন। এই কাব্য সংলগ্নতা থেকে বের হয়ে তিনি হয়ে ওঠেন পুরাণনির্ভর। এভাবেই এসেছে ইউরোপীয় পুরাণ। পরিবেশ-প্রতিবেশ ও পৃথিবীর সঙ্গে নিজেকে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত করায় তার কবিতা বিষয়-বৈচিত্রে সমৃদ্ধ হয়ে আত্মমগ্নতার বৃত্ত থেকে বেরিয়ে সমাজমুখী হয়ে ওঠে। বিশেষ করে তিনি কবিতায় বাংলাদেশের মুক্তি-সংগ্রামের ইতিকথা অত্যন্ত মমতার সঙ্গে কবিতায় উপস্থাপন করেছেন। কবিতায় শামসুর রাহমান নিজেকে প্রগতিশীল, মানবতাবাদী এবং জাতীয়তাবাদী হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। তার কাব্য ভান্ডারে সঞ্চিত হয়েছে যুদ্ধের ক্ষতি-ধ্বংস, মন্বন্তরকবলিত মানুষের আর্তনাদ-ক্রন্দনধ্বনি, দেশ-বিভাজনের রাজনৈতিক প্রতিহিংসা। ভাষা-আন্দোলন ও ঊনসত্তরের শহীদদের কথাও পাই। বেশি করে পাই স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ বাঙালির স্বপ্ন এবং স্বপ্নভঙ্গের দুঃসহ যন্ত্রণা, প্রত্যাশা ও অচরিতার্থতার বেদনা। শামসুর রাহমানের কাব্য-ভুবন নির্মিত হয়েছে এসব পরিবর্তিত বাস্তবতায়। স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে অস্থির রাজনীতি, নীতিনৈতিকতার অবক্ষয়ের অন্তরালে তিনি নির্মাণ করেছেন আশাবাদী কাব্য-প্রকরণ। আত্মকেন্দ্রিকতার খোলস ছেড়ে তার কবিতা যখন সামষ্টিক চেতনায় উদ্ভাসিত হলো তখন তিনি হয়ে ওঠেন নাগরিক কবি। তার কাব্যভাষায় উপমা-প্রতীক-চিত্রকল্পের পাশাপাশি পুরাণ প্রসঙ্গ শিল্পিত সুষমায় প্রকাশ পেয়েছে।

পুরাণ বা মিথ প্রকৃতপক্ষে সমাজ ও জাতির সাংস্কৃতিক মৌলিক উপাদান। মানব সভ্যতার বিবর্তনের মিথের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। 'মিথ' বা পুরাণের সঙ্গে মানবসমাজের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। সভ্যতার ক্রমবিকাশের ধারাক্রম অনুসরণ করেই শামসুর রাহমানও কবিতায় মিথ বা পুরাণের ব্যবহার করেছেন। তিনি সমকালীন জগৎ ও জীবন থেকেই পুরাণের ধারণা সংগ্রহ করেছেন। জাতির মানবিকবোধ, ব্যক্তি-চেতনার গভীরতা, প্রেমের বিচিত্র রূপ আবিষ্কারে শামসুর রাহমান মিথের সহায়তা গ্রহণ করেছেন বলতে পারি। শুধু ইউরোপীয় মিথ কেন, কবিতায় তিনি অকৃপণভাবে প্রাচ্যের মিথও ব্যবহার করেছেন আর এভাবেই আধুনিক জীবন-যন্ত্রণার নানা বাঁক তার কবিতায় উন্মোচিত হয়েছে। কবি শামসুর রাহমান প্রতীক ব্যবহারের মধ্য দিয়েও কাব্য-সৌন্দর্য নির্মাণে প্রয়াসী হয়েছেন। ফলে তার কবিতার অলি-গলিতে প্রবেশ করতে হলে প্রতীকের হাত ধরেই প্রবেশ করতে হয় বলে সমালোচকদের অভিমত। রূপক-উপমা-প্রতীকের মধ্য দিয়ে তিনি কবিতার বিষয়কেও আত্মস্থ করে নিয়েছেন। তবে শামসুর রাহমানের এই কাব্য-প্রকরণে মিথের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একজন সমালোচক লিখেছেন- 'তার প্রথম দিকের কাব্যগ্রন্থগুলোতে পুরাণের ব্যবহার খুব একটা লক্ষ্য করা যায় না। উপরন্তু তিনি বিধ্বস্ত নীলিমা (১৯৬৬) কাব্যগ্রন্থের 'পুরাণ' কবিতায় মিথকে বাতিল হিসেবে উলেস্নখ করে লিখেছেন, 'আমাকে জড়ায় সত্য, অর্ধসত্য কিংবা প্রবচন,/ তবু জানি কিছুতে মজে না মন বাতিল পুরাণে।'(পুরাণ, বিধ্বস্ত নীলিমা) তারপরও শামসুর রাহমান শেষাবধি আধুনিক জীবনের সামগ্রিক দিক তুলে ধরতে গিয়ে পুরাণের কাছে হাত পেতেছেন। তিনি কবিতায় পুরাণ ব্যবহারের মাধ্যমে একাধারে ব্যক্তিজীবন এবং সামাজিক-রাজনৈতিক সংকট-সমস্যার কথাও অবলীলায় উপস্থাপন করেছেন। তার কবিতায় প্রাচ্য-প্রতীচ্যের পুরাণের ব্যবহার থাকলেও তিনি পাশ্চাত্য তথা গ্রিক পুরাণের ব্যবহারে অধিকতর আগ্রহী ছিলেন। ওই সমালোচক তার কথার সমর্থনে উদ্ধৃতি দিয়েছেন কাব্যতত্ত্ব কবিতার-

রাত্রির পীড়নে উড়ে উন্মথিত আমি নক্ষত্রের ঝড়ের মতো

শব্দপুঞ্জ থেকে ছিঁড়ে আনি কবিতার অবিশ্বাস্য শরীর

সৌন্দর্যের মতো রহস্য ঢাকা, নগ্ন আর উন্মীলিত।

আমার সেই নির্মাণে মাননীয় পক্বকেশ পন্ডিত

হন্তদন্ত হয়ে খোঁজেন গ্রিক পুরাণের উলেস্নখ, [কাব্যতত্ত্ব, প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃতু্যর আগে]

নিঃসঙ্গ শেরপা গ্রন্থে ড. হুমায়ুন আজাদ দেশাত্মবোধক কবিতা হিসেবে শামসুর রাহমানের টেলেমেকাস কবিতাটিকে বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ বলে উলেস্নখ করেছেন। কালের সংকট থেকে উত্তরণের জন্য এভাবেই কবি শামসুর রাহমান বীরের কাছে নতজানু হয়ে প্রার্থনা করেছেন। নিরালোকে দিব্যরথ (১৯৬৯) কাব্যগ্রন্থের 'টেলেমেকাস' কবিতায় অসাধারণভাবে গ্রিক পুরাণের সঙ্গে সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামলা বাংলার জনগণের সংগ্রামকে প্রতীকায়িত করেছেন। এ কবিতায় অবরুদ্ধ ও সংক্ষুব্ধ বাংলার চিত্র ফুটে উঠেছে। সমকালীন বাংলাদেশের উত্তাল রাজনৈতিক পরিস্থিতির উজ্জ্বল স্বাক্ষর রয়েছে। বীর-বন্দনার এই রীতি শামসুর রাহমানের সম্ভবত চলিস্নশের কবি ফররুখ আহমদের (১৯১৮-'৭৪) কাছ থেকে গ্রহণ করেছিলেন। শামসুর রাহমানের পূর্বসূরি একটি বিশেষ জাতির পুনরুজ্জীবন কামনা করলেও উপকথার 'সিন্দবাদ'কে তিনি যেভাবে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসার আকুল আহ্বান জানিয়েছেন, তেমনি শামসুর রাহমানও গ্রিক পুরাণের অডিউসকে আহ্বান করেছেন। -রয়েছি দাঁড়িয়ে

দরজা আগলে, পিতা, অধীর তোমারই প্রতীক্ষায়।

এখনো কি ঝঞ্ঝাহত জাহাজের মাস্তুল তোমার

বন্দরে যাবে না দেখা? অস্ত্রাগারে নেবে না আয়ুধ

আবার অভিজ্ঞ হাতে? তুলবে না ধনুকে টঙ্কার? [টেলেমেকাস, নিরালোকে দিব্যরথ]

ফররুখের সঙ্গে শামসুর রাহমানের বীর-বন্দনার সাদৃশ্য লক্ষ্যণীয় -

তুমি জাগো, কখন সকালে ঝরেছে হাসনাহেনা/ এখনো তোমার ঘুম ভাঙলো না? তবু, তুমি জাগলে না?/ দুয়ারে সাপের গর্জন শোনো নাকি?/ কত অসংখ্য ক্ষুধিতের সেথা ভিড়,/ হে মাঝি! তোমার বেসাতি ছড়াও, শোনো,/ নইলে যে সব ভেঙে হবে চৌচির। (সাত সাগরের মাঝি, সাত সাগরের মাঝি)। 'সিন্দবাদ' কবিতায় ফররুখ আহমদ আরো চমৎকারভাবে বলেছেন-

ভেঙে ফেলো আজ খাকের মমতা আকাশে উঠেছে চাঁদ

দরিয়ার বুকে দামাল জোয়ার ভাঙছে বালুর বাঁধ

ছিঁড়ে ফেলে আজ আয়েশী রাতের মখমল অবসাদ,

নতুন পানিতে হাল খুলে দাও হে মাঝি সিন্দবাদ। [সিন্দবাদ, সাত সাগরের মাঝি]

কবি শামসুর রাহমানের এই বীর বন্দনার সঙ্গে ভাষাগত সাদৃশ্য রয়েছে ফররুখ আহমদের। তবে তিনি কবিতায় পুরাণ ব্যবহারের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ধারা অনুসরণ করেছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কবিতায় গ্রিক পুরাণ ব্যবহার করেছেন।

৩.

শামসুর রাহমানে ইকারুসের আকাশ (১৯৮২) কাব্যগ্রন্থের কথা আগেই উলেস্নখ করেছি। এই গ্রন্থের অধিকাংশ কবিতায় পুরাণ বা মিথ ব্যবহার করা হয়েছে। ডেডেলাসের পুত্র ইকারুস আত্ম-আবিষ্কারের নেশায় এবং তারুণ্যের স্পর্ধায় মোমের পাখা নিয়ে উঁচুতে উড়তে গিয়ে প্রখর সূর্যতাপে পাখা গলে গিয়ে নির্মম মৃতু্যবরণ করেছিল। ইকারুসের এই পরিণতি শামসুর রাহমান নিজ সত্তায় অনুভব করেছেন এভাবে-

জেনেও নিয়েছি বেছে অসম্ভব উত্তপ্ত বলয়

পাখা মেলবার, যদি আমি এড়িয়ে ঝুঁকির আঁচ

নিরাপদ নিচে উড়ে উড়ে গন্তব্যে যেতাম পৌঁছে

তবে কি পেতাম এই অমরত্বময় শিহরণ? [ইকারুসের আকাশ, ইকারুসের আকাশ]

ইকারুসের তারুণ্য দীপ্ত মন এবং ট্র্যাজিক পরিণামের মধ্যে শামসুর রাহমান মূলত নিজেকে আবিষ্কার করেছেন। 'ডেডেলাস' কবিতায় ইকারুসের মৃতু্যর জন্য পিতা ডেডেলাস শোকার্ত হৃদয়েই পুত্রের স্বাধীনচেতা মনোবৃত্তির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেছে-

\হ'পরিণাম বিষয়ে কেমন

\হউদাসীন, ক্রুর, রৌদ্রঝলসিত, সাহসী, স্বাধীন।' [ডেডেলাস, ইকারুসের আকাশ]

ডেডেলাসের মধ্য দিয়ে মূলত কবি শামসুর রাহমান তারুণ্যকে আহ্বান করেছে এবং স্বাধীনতার স্বপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন।

এই গ্রন্থের 'ইলেকট্রার গান' কবিতায় শামসুর রাহমান স্বাধীনতাপরবর্তী বাংলাদেশের রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের কথা প্রতীকের মধ্য দিয়ে বলতে চেয়েছেন। এ কবিতার আগামেমনন প্রতীকের ভেতর দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে উপস্থাপন করেছেন কবি। দিনের পর দিন স্ব-গৃহে পিতৃহন্তারকের সঙ্গে বসবাসের যন্ত্রণা ভোগ করেছে আগামেমননের মেয়ে ইলেকট্রা। অতঃপর ইলেকট্রা বড় হয়ে পিতৃহত্যার প্রতিশোধ গ্রহণে ভ্রাতা ওরেস্টেসের সহায়তা নেন। ষড়যন্ত্রকারী ক্লাইটেমনেস্ট্রা ছিলেন তার মা। কিন্তু এ সত্ত্বেও তিনি তাকে ক্ষমা করেননি।

সেই দিন আজও জ্বলজ্বলে স্মৃতি, যেদিন মহান

বিজয়ী সে বীর দূর দেশ থেকে স্বদেশে এলেন ফিরে।

শুনেছি সেদিন জয়ঢাক আর জন-উলস্নাস;

পথে-প্রান্তরে তারই কীর্তন, তিনিই মুক্তিদূত।

বিদেশি মাটিতে ঝরেনি রক্ত; নিজ বাসভূমে,

নিজ বাসগৃহে নিরস্ত্র তাকে সহসা হেনেছে ওরা। [ইলেকট্রার গান, ইকারুসের আকাশ]

'ইলেকট্রার গান' কবিতাটি একটি রাজনৈতিক কবিতাই শুধু নয়, শোকগাঁথাও। ইলেকট্রার এই বেদনার্ত উচ্চারণের মধ্য দিয়ে প্রকৃতপক্ষে একাত্তর পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতাই ফুটে উঠেছে। কারণ, আগামেমননের মতো বীর বেশেই বঙ্গবন্ধু স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন। তিনি বিদেশি শত্রম্নর হাত থেকে মুক্ত হয়ে স্ব-গৃহে ফিরে এসেও ক্লাইটেমনেস্ট্রাদের (স্বজনদের) হাতেই নিহত হয়েছিলেন।

সেটা তিনি বলেছেন এভাবে-

শ্রাবণের মেঘ আকাশে আকাশে জটলা পাকায়,/মেঘময়তায় ঘনঘন আজ একি বিদু্যত জ্বলে।/মিত্র কোথাও আশপাশে নেই, শান্তি উধাও;/নির্দয় স্মৃতি মিতালী পাতায় শত করোটির সঙ্গে।/নিহত জনক, আগামেমনন্‌?, কবরে শায়িত আজ।/সে কবে আমিও স্বপ্নের বনে তুলেছি গোলাপ,

শুনেছি কত যে প্রহরে প্রহরে বন দোয়েলের ডাক।

অবুঝ সে মেয়ে ক্রাইসোথেমিস্‌? আমার সঙ্গে

মেতেছে খেলায়, কখনো আমার বেণীতে দিয়েছে টান।

নিহত জনক, আগামেমনন্‌?, কবরে শায়িত আজ। [ইলেকট্রার গান : ইকারুসের আকাশ]

ইলেকট্রা গ্রিক ট্র্যাজেডির একটি প্রধান চরিত্র। উইকিপিডিয়া বলছে : 'ঊষল্কশঃৎ? রং ড়হব ড়ভ :যব সড়ংঃ ঢ়ড়ঢ়ঁষধৎ সুঃযড়ষড়মরপধষ পযধৎধপঃবৎং রহ ঃৎধমবফরবং. ঝযব রং :যব সধরহ পযধৎধপঃবৎ রহ :ড়ি এৎববশ :ৎধমবফরবং, ঊষবপঃৎধ নু ঝড়ঢ়যড়পষবং ধহফ ঊষবপঃৎধ নু ঊঁৎরঢ়রফবং. ঝযব রং ধষংড় :যব পবহঃৎধষ ভরমঁৎব রহ ঢ়ষধুং নু অবংপযুষঁং, অষভরবৎর, ঠড়ষঃধরৎব, ঐড়ভসধহহংঃযধষ, ধহফ ঊঁমবহব ঙ'ঘবরষষ.' সফোক্লিসের 'ইলেকট্রা' ও ইউরিডিডিসের 'ইলেকট্রা'- দুটিরই প্রধান চরিত্র এই ইলেকট্রা। আরো অনেক কাহিনীর তিনি চরিত্র। শামসুর রাহমান তাকে ভিন্নভাবে উপস্থাপনা করে আমাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। এই ইলেকট্রা প্রতীক মাত্র নয়, সেও চরিত্র হয়ে উঠেছে, পেয়েছে ভিন্ন মাত্রা। বাংলা কবিতা পেয়েছে নতুন একটি রস।

সক্রেটিস ২ কবিতায় দার্শনিক সক্রেটিস হয়ে উঠেছেন কবির প্রিয় একজন -

এবং সত্যের মুখ দেখেছিলেন ব'লেই তিনি,/সক্রেটিস, সয়েছেন নির্যাতন, অকাতরে পান/করেছেন হেমলক- এই আত্মাহুতির পুরাণ/চিরঞ্জীব; বিশ্বচরাচরে এভাবেই ছিনিমিনি/খেলা খেলে যুগে যুগে পরাক্রান্ত কবন্ধ সমাজ/চক্ষুষ্মানদের নিয়ে। আপসের ক্লিন্ন যষ্ঠি হাতে

এখানে সেখানে ঘোরা কখনো ছিল না তার ধাতে,

তাই আজো আমাদের ভাবলোকে তিনি মহারাজ। [সক্রেটিস ২ : ইকারুসের আকাশ]

৪.

শামসুর রাহমানের কবিতায় নিজের কথা, ব্যক্তিজীবনের কথা এসেছে বারবার। ইচ্ছে হয় একটু দাঁড়াই (১৯৮৫) কাব্যগ্রন্থে 'অ্যাকিলিসের গোড়ালি' কবিতায় অসাধ্য বীর অ্যাকিলিসের দুর্বল স্থানের প্রতীকে নিজেকে রূপায়িত করেছেন কবি। অতিক্রান্ত যৌবনে কবি শামসুর রাহমানের ভেতরে প্রবলভাবে মৃতু্যচেতনা জেগে ওঠে। মাত্র পঞ্চাশ পেরিয়ে কবির মনে যে মৃতু্যভীতি জেগেছিল, তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে 'অ্যাকিলিসের গোড়ালি' কবিতায়। প্যারিসের নিক্ষিপ্ত শর যেভাবে অ্যাকিলিসের গোড়ালিতে বিদ্ধ হয়ে তার মৃতু্য ঘটেছিল; তেমনি কবির দুর্বলতা খুঁজে চলেছে মৃতু্যদূত। তাই কবি লেখেন যমের 'ঈগলদৃষ্টিতে খোঁজে খালি/ আমার ধস্ত এ অস্তিত্বের অ্যাকিলিসের গোড়ালি।' (অ্যাকিলিসের গোড়ালি, ইচ্ছে হয় একটু দাঁড়াই) হোমারের স্বপ্নময় হাত (১৯৮৫) কাব্যগ্রন্থের নাম কবিতায় (হোমারের স্বপ্নময় হাত) মহাকবি হোমারের নামে প্রচলিত পুরাণ-কথার সঙ্গে শামসুর রাহমান স্বীয় অস্তিত্বের যোগসূত্র খুঁজেছেন। মহাকবি হোমারের মতো তিনিও (শামসুর রাহমান) অমর কাব্য সৃষ্টি করতে চেয়েছেন। কাব্য-সৌন্দর্য নির্মাণের অগ্রপথিক হিসেবে হোমারকে গ্রহণ করে তাই শামসুর রাহমান লিখেছেন : 'যদি এখন/ আমি খাতার শাদা পাতা স্পর্শ করি, তা'হলে সেখানে/ বইবে অলকানন্দা, গড়ে উঠবে আর্ডেনের বন, লতাগুল্মে/ ঝলসে উঠবে হোমারের স্বপ্নময় হাত।' (হোমারের স্বপ্নময় হাত/ হোমারের স্বপ্নময় হাত) হোমার বন্দনার মধ্য দিয়ে শামসুর রাহমান প্রকৃতপক্ষে স্বীয় কাব্যসুষমায় নান্দনিকতা আরোপ করতে চেয়েছেন।

শামসুর রাহমান কবিতায় পাশ্চত্য পুরাণ ব্যবহারে সাবলীল ও দক্ষ একথা অনস্বীকার্য; তবে প্রাচ্যের পুরাণ-প্রসঙ্গ তিনি কবিতায় একেবারে এড়িয়ে যাননি। ভারতীয় পুরাণ কথা তিনি কবিতায় ব্যবহার করে সমকালীন জীবনের ধ্বংসাত্মক দিকের প্রতীকায়নের পাশাপাশি ব্যক্তি-জীবনের সাফল্য-ব্যর্থতাকেও চিহ্নিত করেছেন। উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ (১৯৮২) কাব্যগ্রন্থের 'চাঁদ সদাগর' কবিতায় ব্যক্তিকে মহিমান্বিত করে তুলেছেন। অন্যায়ের কাছে নত না হয়ে স্বীয় আদর্শে দৃঢ়-সংকল্প ব্যক্তি জীবনকে প্রতিকায়িত করেছেন। যেমন-

যতদিন হিন্তাল কাঠের

লাঠি আছে হাতে, আছে

ধমনিতে পৌরুষের কিছু তেজ, যতদিন ঠোঁটে

আমার মুহূর্তগুলো ঈষৎ স্পন্দিত হবে, চোখে

নিমেষে উঠবে ভেসে কোনো শোভাযাত্রার মশাল,

করব না আন্ধারের বশ্যতা স্বীকার ততদিন,

যতই দেখাক ভয় একশীর্ষ, বহুশীর্ষ নাগ,

ভিটায় গজাক পরগাছা বারংবার, পুনরায়

ডিঙার বহর ডোবে ডুবুক ডহরে শতবার,

গাঙ্গুড়ের জলে ফের যাক ভেসে লক্ষ লখিন্দর। [চাঁদ সদাগর, উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ]

শামসুর রাহমান কবিতায় প্রাচ্য পুরাণের খুব একটা ব্যবহার করেননি। কোন কোন কবিতায় তিনি ভারতীয় পুরাণের নানা অনুষঙ্গ-প্রসঙ্গ, চরিত্র ও ঘটনা অসামান্য শিল্প-সৌকর্যে কাব্যে সংযোজন করেছেন। 'মায়ামারীচ', 'খান্ডবদাহন', 'জতুগৃহ', 'কালকূট', 'বাল্মিকী', 'ধৃতরাষ্ট্র', 'প্রজ্ঞাপারমিতা', 'শিখন্ডী', 'ঋষ্যশৃঙ্গ' প্রভৃতি শামসুর রাহমানের কবিতায় শিল্প সুষমাসহ উপস্থিত হয়েছে। তিনি উপমহাদেশীয় পৌরাণিক ঘটনা ও চরিত্রগুলো দক্ষতার সঙ্গে জীবনের সঙ্গে একাত্ম করে তুলেছেন। তবে শামসুর রাহমান কবিতায় পাশ্চাত্যের বিশেষ করে গ্রিক-পুরাণ ব্যবহারে অধিকতর দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন, এ কথা বলাই যায়।

কবি শামসুর রাহমান বাংলা কবিতাঙ্গনে আত্মমগ্ন ব্যক্তিচেতনা নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলেন; কিন্তু পরিবেশ-প্রতিবেশ, বিশ্ব ও কাল প্রবাহ তার কাব্য-অভিজ্ঞানে যোগ করেছে রাজনৈতিক ঘটনাবলি, অস্থিরতা, জাতীয় জীবনের সংকট ও সংগ্রাম এবং রক্তপাতের মতো ভয়াবহ সব ঘটনা। তার আত্মমগ্ন কবিসত্তা এক সময় বহির্গামী হয়ে উঠেছিল, হতে পারে তা বোধ হয় কবি নিজেও বুঝতে পারেননি। তিনি নিজ অভিজ্ঞানকে প্রাচ্য-প্রতীচ্যের মিথের বা পৌরাণিক ইঙ্গিতে তার কবিতায় প্রকাশ ঘটিয়েছেন। কবিতায় আধুনিক জীবন-জটিলতা যত সহজে পুরাণ ব্যবহারের মাঝে বাঙ্‌ময় করে তোলা যায় তা সাধারণ প্রতীক-রূপক-উপমা কিংবা চিত্রকল্প দিয়ে সম্ভব হয় না। ফলে কবি শামসুর রাহমান তার কবিতায় পুরাণ বা মিথ দক্ষতার সঙ্গে জুড়ে দিয়ে আধুনিক জীবন-জিজ্ঞাসাকে শৈল্পিক সুষমামন্ডিত করেছেন বলে সমালোচকদের অভিমত।

শামসুর রাহমানের দুঃসময়ের মুখোমুখি (১৯৭৩) কাব্যগ্রন্থের 'স্যামসন' পুরাণের প্রতীকে আবৃত কবিতা। স্যামসন বন্দি হওয়ার পর তার চোখ উপড়ে নেয়া হয়, চুল কেটে দেয়া হয়; তারপরও মাতৃভূমি রক্ষার্থে এই বীর দৃঢ়-সংকল্প ছিল। টেলেমেকাস যেভাবে তার পিতার আগমনের অপক্ষো করে তেমনি স্যামসন বন্দি জীবনের যন্ত্রণা সহ্য করেও আশাবাদ ব্যক্ত করেছে মাতৃভূমি রক্ষায়। কবি শামসুর রাহমান 'স্যামসন'কে বাংলাদেশের শাসকদের অত্যাচার-নির্যাতনের বিপক্ষে জনগণের সারিতে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন নতুন বাকপ্রতিমা। যেমন-

আমার দুরন্ত কেশরাজি পুনরায় যাবে বেড়ে,

ঘাড়ের প্রান্তর বেয়ে নামবে দুর্দমনীয়, তেড়ে

আসা নেকড়ের মতো। তখন সুরম্য প্রাসাদের সব স্তম্ভ

ফেলবে উপড়ে, দেখো কদলী বৃক্ষের অনুরূপ। দম্ভ চূর্ণ হবে তোমাদের, সুনিশ্চিত করব লোপাট

\হসৈন্য আর দাস-দাসী অধু্যষিত এই রাজ্যপাট। [স্যামসন, দুঃসময়ে মুখোমুখি]

শাসকের অত্যাচার-নির্যাতন যখন বাংলাদেশের জনগণের ওপর চলছিল তখন কবি স্যামসনের মতোই আশাবাদী ভূমিকা গ্রহণ করে অপেক্ষা করেছেন সুদিনের। তিনি বিশ্বাস করেন সুদিন একদিন আসবেই; এই অত্যাচার-নির্যাতনের অবসান ঘটবে, শেষ পর্যন্ত জনগণই জয়ী হবে। কবি শামসুর রাহমান নিজের বাস্তবতা চিত্রিত করেছেন বাংলাদেশ স্বপ্ন দ্যাখে (১৯৭৭) কাব্যগ্রন্থের 'নেকড়ের মুখে আফ্রোদিতি' কবিতায়। ডায়োমিডিসের আঘাতে যেভাবে প্যারিসকে উদ্ধার করতে গিয়ে দেবী আফ্রোদিতি আহত হয়েছিলেন, কবি নিজেকেই আহত দেবী আফ্রোদিতির সমান্তরাল। যেমন-

হে নিশীথ, আজ আমি কিছুই করতে পারব না।

আমার মগজে ফণীমনসার বন বেড়ে ওঠে,

দেখি আমি পড়ে আছি যুদ্ধধ্বস্ত পথে কী একাকী;

ভীষণ আহত আমি, নেকড়ের মুখে আফ্রোদিতি। [নেকড়ের মুখে আফ্রোদিতি, বাংলাদেশ স্বপ্ন দ্যাখে]

শামসুর রাহমানের এই প্রতীকনির্ভর কাব্য-প্রকরণ আর পুরাণের নান্দনিক ব্যবহার পাঠকদের অবাক না করে পারে না। পুরাণ ব্যবহারের মাধ্যমে একাধারে ব্যক্তিজীবন এবং সামাজিক-রাজনৈতিক সংকট-সমস্যার কথাও অবলীলায় উপস্থাপন করেছেন, আগেই বলেছি। পুরাণ প্রাবল্যে বা বলা যায় ইউরোপীয় মিথের যথেচ্ছ ব্যবহারে এবং তা থেকে উৎসরিত কবিতামালা নির্দিষ্ট পথের সন্ধান দেয় কবিকে। যেখানে আবহমান বাংলার প্রকৃতির রূপ, রস, শব্দ, গন্ধ, স্পর্শ মিলেমিশে থাকে। আধুনিক জীবনের প্রাত্যহিকতা, মোহগ্রস্ত মনোজাগতিক জটিলতা ও বিভ্রম কবি শামসুর রাহমানকে বিচলিত করে তুলেছিল। তাই তাকে দেখা যায় তিরিশের কাব্যাদর্শ বের হয়ে নতুন কাব্যকলা ও কাব্যভাষা নির্মাণ করতে। তিনি একদিকে যেমন বাংলা কবিতার ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন, তেমনিভাবে ইউরোপীয় মিথ ব্যবহার করে তার সঙ্গে আন্তর্জাতিকতাও যুক্ত করেছেন। তার এই প্রচেষ্টা বৃথা হওয়ার নয়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে