শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১
জোবায়ের আলী জুয়েল

লোক সঙ্গীতের প্রবাদ পুরুষ আব্বাসউদ্দীন

নতুনধারা
  ০৫ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
লোক সঙ্গীতের প্রবাদ পুরুষ আব্বাসউদ্দীন

আব্বাসউদ্দীন বাংলার লোক সঙ্গীতের এক প্রবাদ পুরুষের নাম। গায়ক আব্বাসউদ্দীন আহমদের জন্ম কোচবিহার জেলার তুফানগঞ্জ মহকুমার অন্তর্গত বলরামপুর গ্রামে। তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১৯০১ সালের ২৭ অক্টোবর। বাবার নাম মোহাম্মদ জাফর আলী। কোচবিহার জেলার একজন স্বনামধন্য আইনজীবী ও জোতদার ছিলেন। মা' হিরামন নেসা।

আব্বাসউদ্দীন আহমদ শৈশব কাল থেকেই তীক্ষ্ন বুদ্ধি ও মেধা সম্পন্ন ছিলেন। লেখাপাড়ায় তিনি খুবই ভালো ছাত্র ছিলেন। তিনি ছিলেন শিক্ষকদের খুব আদরের। মাটির পৃথিবীর চিরন্তন ঐকতান তার কণ্ঠে বাসা বেঁধেছে শৈশব কাল থেকেই। তিনি একজন ভালো শিল্পী ছিলেন শিশুকাল থেকেই। কিন্তু শৈশবে তিনি কোনো ওস্তাদের কাছে গান শেখার সুযোগ পাননি। তিনি গান শিখেছেন গ্রাম্য গায়ক এবং ক্ষেতে কর্মরত কৃষকের মুখের গান শুনে শুনে। বাড়ির সামনে দিগন্ত বিস্তৃত মাঠে কৃষকের উদাত্ত কণ্ঠের ভাওয়াইয়া গান তার শিশুমনে আলোড়ন তুলত। তাকে ভাওয়াইয়া শিখতে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল তারই গ্রামের শিল্পী পাগারু এবং নায়েব আলী টেপুর ভাওয়াইয়া গান ও দোতারার ডাং। স্কুলে যাওয়ার সময় এবং স্কুল থেকে ফেরার পথে তিনি গলা ছেড়ে গাইতেন ভাওয়াইয়া।

কোচবিহারের বলরামপুর প্রাইমারি স্কুলে তার লেখাপড়ার হাতে খড়ি। পঞ্চম শ্রেণিতে তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন। তুফানগঞ্জে অধ্যয়নকালে স্কুলের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে তিনি প্রথম পুরস্কার পেয়েছিলেন।

আব্বাসউদ্দীন আহমদ ১৯২০ সালে ম্যাট্রিক পাস করেছিলেন তুফানগঞ্জ হাইস্কুল থেকে। ম্যাট্রিক পাস করার পর তিনি ভর্তি হয়েছিলেন কোচবিহারের ভিক্টোরিয়া কলেজে। কৃতিত্বের সঙ্গে আইএ পাস করার পর তিনি বিএ পড়তে আসেন রংপুর কারমাইকেল কলেজে এবং পরবর্তী সময়ে রাজশাহী কলেজেও ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে তিনি এ দুটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বেশি দিন লেখাপাড়ার সুযোগ পান নাই। এরপর তিনি বিএ ভর্তি হন কোচবিহার কলেজে। কিন্তু এখানে বিএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেননি।

কলকাতা মহানগরীতে বিশের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে শুরু করেন সংগ্রামী শিল্পী জীবন। বাংলাদেশের মুসলমানের হৃদয়ে পৌঁছানোর ছিল সে সময় দুটি পথ। তার একটি তাদের মনের কথা এ দেশের লোকগীতি, অপরটি তাদের প্রাণের কথা ইসলামী গান। আব্বাসউদ্দীন অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে এবং সুকৌশলে বেছে নিয়েছিলেন এই দুটি পথ। বাংলা গানের ইতিহাসে নজরুল ও আব্বাসউদ্দীন এ দুটি নাম যেদিন যুক্ত হলো সেদিন থেকে সঙ্গীতে অনুপস্থিত বাঙালি মুসলমানের দীনতা ঘুচলো।

হিন্দু সমাজে যখন মুসলমান শিল্পীরা ছিলেন অস্পৃশ্য তখন বাংলার সঙ্গীত জগতে এক নতুন দিগন্তের সৃষ্টি হলো। এ নব দিগন্তের স্রষ্টা হলেন অমর কণ্ঠশিল্পী আব্বাসউদ্দীন আহমদ। নজরুল এলেন সঙ্গীতের জগতে ধূমকেতুর মতো কালবৈশাখী তুলে, আব্বাসউদ্দীন এলেন সুরের রঙ্গ মশাল নিয়ে।

১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্টের পর তিনি তৎকালীন রেডিও পাকিস্তানে গান গাওয়া শুরু করেছিলেন। চাকরি নিয়েছিলেন পাবলিসিটি ডিপার্টমেন্টে।

কোচবিহারের এক অনুষ্ঠানে আব্বাসউদ্দীনের গান শুনে কাজী নজরুল ইসলাম বিমোহিত হয়েছিলেন। তাকে তিনি কলকাতায় আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন।

আব্বাসউদ্দীন আহমদ মাত্র ২৩ বছর বয়সে কলকাতায় গ্রামোফন কোম্পানিতে দুটি আধুনিক গান রেকর্ড করেছিলেন বিমল দাশ গুপ্তের সহায়তায়। গান দুটি ছিল 'কোন বিরহীর নয়ন জলে বাদল ঝরে গো' এবং 'স্মরণ পারের ওগো প্রিয়'। গান দুটি সে সময় যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়েছিল।

এরপর আব্বাসউদ্দীন আহমদ কলকাতায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। এ সময় কাজী নজরুল ইসলামের গভীর সান্নিধ্যে আসেন আব্বাসউদ্দীন। কাজী নজরুল ইসলামের অনুপ্রেরণা এবং সহযোগিতায় আব্বাসউদ্দীনের কণ্ঠে ইসলামী গানের পাশাপাশি একাধিক ভাওয়াইয়া গানের রেকর্ড হয়েছিল। বলাবাহুল্য এই গানগুলো সে সময় যথেষ্ট জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। পরবর্তী সময়ে রেকর্ডে আব্বাসউদ্দীনের কী গান বাজারে আসছে সেই গান শোনার জন্য অধীর আগ্রহ অপেক্ষা করতেন গ্রামোফন কোম্পানির লাখো লাখো শ্রোতা।

নজরুল গান লিখছেন, সুর দিয়েছেন। আব্বাসউদ্দীনের বলিষ্ঠ দরদি কণ্ঠে সে গান রেকর্ড, জনসভা ও মিলাদ মাহফিলের মাধ্যমে বাংলা দেশের ঘরে ঘরে পৌছে দিয়েছে। ভাওয়াইয়া গানে বাংলা দেশের মানুষের অন্তর আবহমান কাল থেকে হয়েছে সমৃদ্ধ। শিল্পী আব্বাসউদ্দীন ভাওয়াইয়া গানকে জনপ্রিয় করে তোলেন। তিনি ভাওয়াইয়া গানকে প্রত্যন্ত অঞ্চলের অশিক্ষিত ও অর্ধ শিক্ষিত মানুষের মুখ থেকে তুলে এনে শহরের শিক্ষিত মানুষের ড্রইংরুমে জায়গা করে দিয়েছিলেন। ভাওয়াইয়া গানকে যারা গ্রামের অভব্য শ্রেণির গান বলে ঘৃণা করতেন তারাও গোপনে তাদের ড্রইং রুমে বসে বিমুগ্ধ হয়ে শুনতেন আব্বাসউদ্দীন আহমদের মধুঝরা কণ্ঠের ভাওয়াইয়া।

আব্বাসউদ্দীন আহমদের কণ্ঠে গীত গ্রামোফন কোম্পানিতে তার বহুগানের রেকর্ডের সন্ধান পাওয়া গেছে এর মধ্যে ৮৪টি ইসলামী গান, পলস্নীগীতি ৫৮টি, ভাওয়াইয়া ৩৭টি, কাব্যগীতি ৩১টি এবং তার আধুনিক গানের সংখ্যাও অজস্র। এমনকি ইসলামী গানকে তিনি কণ্ঠে ধারণ করেছিলেন বলেই তৎকালীন মুসলিম রেঁনেসার সূত্রপাত হয়েছিল। যে মুসলমানরা গানকে হারাম বলে কানে আঙ্গুল দিতেন, তারাই পরবর্তী সময়ে আব্বাসউদ্দীনের কণ্ঠে অবাক বিস্ময়ে শুনতেন 'মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ', 'ত্রি ভুবনের প্রিয় মোহাম্মদ এলোরে দুনিয়ায়' প্রভৃতি বিখ্যাত ইসলামী গান। পরবর্তী সময়ে নজরুলের লেখা ও সুর করা রোজা, নামাজ, হজ্ব, যাকাত, শবেবরাত, ঈদ, ফাতেহা, নাতে রসূল, ইসলামী গজল প্রভৃতি অনেক কণ্ঠ দিয়েছিলেন আব্বাসউদ্দীন।

বাংলার মুসলিমসমাজে যেখান থেকে আসত আহ্বান, তা উপেক্ষা না করে আব্বাসউদ্দীন শত কষ্ট জেনে ও ছুটে যেতেন তাদের আহ্বানে। ছাত্রদের মিলাদের সভায়, স্কুল-কলেজের চ্যারিটি শো, দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপনের জন্য বিচিত্রানুষ্ঠানে। এছাড়াও হাজার রকমের জনসমাবেশে সারাদেশের সভায় গায়কের সম্মান পেয়েছিলেন তিনি। ভাওয়াইয়া ও ইসলামী গানের পাশাপাশি তিনি গেয়েছেন অসংখ্য পলস্নীগীতি, মুর্শিদী, মর্শিয়া, জারি, সারি, ভাটিয়ালি, হামদ, নাত, পালাগান ইত্যাদি।

শুধু গান গেয়েই তিনি ক্ষান্ত হননি। গায়কের পাশাপাশি একজন শক্তিশালী অভিনেতাও ছিলেন। তিনি সেকালের বিষ্ণুপ্রিয়, মহানিশা, একটি কথা এবং ঠিকাদার ছবিতেও অভিনয় করেছিলেন।

শুধু দেশ নয়, শিকাগো, নিউইয়র্ক, লল্ডন, প্যারিস, টোকিও, মেলবোর্নসহ পৃথিবীর বহুদেশে তিনি ইসলামী গান, ভাওয়াইয়া, পলস্নীগীতি পরিবেশন করে বিশ্বসভায় আমাদের বাংলা গানকে সম্মানের আসনে অলংকৃত করে গেছেন। ১৯৫৫ সালে ফিলিপাইনের রাজধানী ম্যানিলায় দক্ষিণ এশিয়া সঙ্গীত সম্মেলনে এবং ১৯৫৬ সালে জার্মানি আন্তর্জাতিক লোকসঙ্গীত সম্মেলনসহ আরও নানা সম্মেলন ও উৎসবে অংশ নিয়ে তিনি এ দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছিলেন।

আব্বাসউদ্দীন আহমদ যখন গায়ক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন তখন মুসলমানদের গান গাওয়া ছিল হারাম। কিন্তু আব্বাসউদ্দীন আহমদ মুসলমান নাম নিয়েই গান গেয়েছেন এবং তার বিশেষ গায়কি ঢং ও সুরেলা কণ্ঠ জয় করেছিল অসম্ভব সে যুগের প্রতিকূল অবস্থাকে। এটি ছিল আব্বাসউদ্দীন আহমদের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব।

পলস্নীগীতি, ইসলামী গান ও ভাওয়াইয়া গানের জনক আব্বাসউদ্দীন আহমদ দীর্ঘদিন পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগ ভোগের পর ১৯৫৯ সালের ৩০ ডিসেম্বর সকাল ৭-৩০ মিনিটে ঢাকায় মৃতু্যবরণ করেন। মৃতু্যকালে তার বয়স হয়েছিল ৫৮ বছর (১৯০১-১৯৫৯ খ্রি:) তাকে ঢাকার আজিমপুর কবর স্থানে সমাহিত করা হয়।

বহু জাতি, বহু ভাষাভাষী, বহু মতাবলম্বী বাংলার মুসলমানকে তার কৃষ্টি, ধর্ম ও তার স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে বেঁচে থাকবার জন্য আব্বাসউদ্দীন তার গানের মাধ্যমে এই মুসলমান সমাজকে সজাগ করে দিয়েছিলেন। তাই আব্বাসউদ্দীন আমাদের মুসলমান সমাজে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে