শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১
জন্মদিনের শুভেচ্ছা

কবি আরিফ মঈনুদ্দীন

মাইন সরকার
  ০৫ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
কবি আরিফ মঈনুদ্দীন

'এখানে জিন্দাবাদ ভাড়া পাওয়া যায়' কাব্যগ্রন্থ খ্যাত কবি আরিফ মঈনুদ্দীনের ৬৪তম জন্মদিন ছিল ১ জানুয়ারি। আমরা তার কর্মময় দীর্ঘায়ু কামনা করছি। তিনি কবিতা এবং কথাসাহিত্য দুই ক্ষেত্রেই একজন সফল সৃষ্টিশীল মানুষ। শুদ্ধতম কবি, নন্দিত কথাসাহিত্যিক আরিফ মঈনুদ্দীন। জাগরণের কবি ও কথাশিল্পী আরিফ মঈনুদ্দীন স্বদেশ, প্রেম আর মানবতায় উজ্জীবিত হয়ে লেখালেখিতে অতিশয় দীপ্তিমান। তার লেখালেখির জীবন শুরু হয়েছে ১৯৭৩ সালে স্কুল জীবন থেকে। সেই থেকে তিনি অনবরত লিখে চলেছেন। তিনি ইতোমধ্যে রোটারি ইন্টারন্যাশনাল সম্মাননা ও কবি আবু জাফর ওবায়েদুলস্নাহ স্মৃতি পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। নিয়মিত লেখালেখির পাশাপাশি তিনি বর্তমানে জীবন সদস্য, ফেনী সমিতি ও ইয়াকুবপুর সমিতি, ঢাকা। এছাড়া দাগনভূঞা সমিতি, ঢাকার সঙ্গেও জড়িত আছেন।

মেধাবী এই কলমযোদ্ধা ১ জানুয়ারি, ১৯৬১ সালে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈতৃক নিবাস: ফেনী জেলার দাগনভূঞা উপজেলার ৫ নম্বর ইয়াকুবপুর ইউনিয়নের চন্ডিপুর গ্রামে। সেখানকার দুধমুখা বাজার থেকে সেবারহাট রোডে এক কিলোমিটারের মাথায় মুন্সীপাড়ায় 'চন্ডিপুর মুন্সীবাড়ি'তে। কবির প্রকৃত নাম কাজী মাইনউদ্দিন চিশতিয়া। তার পিতা: নজীর আহাম্মদ (বড় মিঞা), পেশায়: ছিলেন নাবিক। মাতা: মাফিয়া খাতুন। পেশায় হলেন গৃহিণী। বোন : ৪ জন। এদের মধ্যে আরিফ মঈনুদ্দীনের অবস্থান চতুর্থ। দাদা: মুন্সী মুজাফফর আলী শাহ। দাদি: রাবেয়া বানু। নানা: হামিদ আলী। নানি: কুলসুম বেগম। নানাবাড়ি: নোয়াখালী জেলার কোম্পানীগঞ্জ উপজেলাধীন মোহাম্মদনগর গ্রামে।

স্বনামধন্য কবি আরিফ মঈনুদ্দীনের প্রপিতামহ মুন্সী আহাম্মদ আলী শাহ অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমদিকে নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার মানিকপুর গ্রামের কেঞ্জাতলী মুন্সীবাড়ি (আমজাদ মুন্সীবাড়ি) থেকে ফেনী জেলার দাগনভূঞা উপজেলাধীন বর্তমান চন্ডিপুর গ্রামে এসে চন্ডিপুর মুন্সীবাড়ির গোড়াপত্তন করেন। কথিত আছে আমজাদ মুন্সী এবং মুন্সী আহাম্মদ আলী শাহের পূর্ব পুরুষ হজরত হেচ্ছার শাহ (রহ.) তৎকালে সুদূর আরব দেশ থেকে এ দেশে এসে ধর্ম প্রচারের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। আমজাদ মুন্সীবাড়ির কবরস্থানে একটি কেঞ্জাগাছ ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে। ওই কেঞ্জাগাছের নামানুসারে জায়গাটির নাম হয় কেঞ্জাতলী এবং মুন্সীবাড়ির নাম হয় 'কেঞ্জাতলী মুন্সীবাড়ি'। বর্তমানে কেঞ্জাতলীতে একটি হাট গড়ে উঠেছে, যার নাম কেঞ্জাতলী তাজুমিঞার হাট সংক্ষেপে কেটিএম হাট।

আরিফ মঈনুদ্দীন নোয়াখালী জেলার সেনবাগ উপজেলাধীন ছমির মুন্সিরহাটের অদূরে অবস্থিত ইয়ারপুর খন্দকারবাড়ির অধিবাসী বেগম শাহীন আক্তারের সঙ্গে শুভ পরিণয়ে আবদ্ধ হন। স্ত্রী গৃহিণী ও বিদূষী নারী। তাদের ঘর আলোকিত করে এসেছেন দুই পুত্র। বড় ছেলে আব্দুলস্নাহ আল মঈনী (জিনান)। দ্বিতীয় পুত্র: গানিম আল মঈনী (দিহান)।

শিক্ষা জীবনে তিনি দুধমুখা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৭৬ সালে এসএসসি পাস করেন। তারপর সরকারি মুজিব মহাবিদ্যালয় (বসুরহাট) কোম্পনীগঞ্জ থেকে ১৯৭৮ সালে এইচএসসি পাস করেন। অতঃপর ফেনী সরকারি কলেজে বিকম ক্লাসে এক বছর অধ্যয়ন করেন। তারপর ফেনী কলেজের পাঠে ইস্তফা দিয়ে ১৯৭৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এখান থেকেই ১৯৮২ সালে মার্কেটিং বিষয়ে সম্মানসহ স্নাতক এবং ১৯৮৩ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।

পেশাগত জীবনে তিনি ১৯৮৮ সাল থেকে প্রায় ২৬ বছর বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেডে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকরি করেন। চাকরি জীবনে কখনো কোনো অনিয়মের সঙ্গে আপস করেননি। চাকরি ছেড়ে দেওয়ার অব্যবহিত আগে তিনি ওই ব্যাংকের অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে কার্ড ডিভিশনে হেড অব মার্কেটিং বা কার্ড মার্কেটিং প্রধান হিসেবে কাজ করেন। এরপর যুগপৎ লেখালেখির নিরবচ্ছিন্ন চর্চা এবং অনিয়মের সঙ্গে আপস না করে ২০১৫ সালের ২০ অক্টোবর থেকে তিনি চাকরি ছেড়ে দিয়ে পুরোপুরি লেখালেখিতে আত্মনিয়োগ করেন।

জাগরণের কবি ও কথাশিল্পী আরিফ মঈনুদ্দীন স্বদেশপ্রেম আর মানবতায় উজ্জীবিত হয়ে লেখালেখিতে আজও নিবিষ্ট আছেন। ইতোমধ্যে তার ২৭টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে এর মধ্যে কাব্যগ্রন্থ ১২টি, গল্পগ্রন্থ পাঁচটি এবং উপন্যাস ১০টি।

কাব্যগ্রন্থ: 'এখানে জিন্দাবাদ ভাড়া পাওয়া যায়', আগামী প্রকাশনী (২০০৬)। 'নাছোড়বান্দা' (খোলা কবিতা) (১৯৮৭)। 'সকাল ভাঙা দিন', অন্যপ্রকাশ (২০১২)। 'আলো খুঁজছো আলো', অন্যপ্রকাশ (২০১৫)। 'ভালোবাসার দিনে প্রেমের পঙ্‌ক্তিমালা', অন্যপ্রকাশ (২০১৬)। 'একজন রোহিঙ্গার স্বগতোক্তি', সব্যসাচী পাবলিকেশন্স (২০১৮)। 'জনকের জন্য কবিতা', কবিতাচর্চা (২০১৮)। 'দ্য প্রফেট (সা.)', অন্যপ্রকাশ (২০২০)। 'দ্য গ্রেট', অন্যপ্রকাশ (২০২২), একজন কবি হেঁটে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রীর বাড়ির পাশ দিয়ে (২০২৩), একজন ফিলিস্তিনির স্বগতোক্তি (২০২৩), দুঃসময়ে বড়ো একা হয়ে যেতে হয় (২০২৪)।

গল্পগ্রন্থ: 'অপ্সরা', কাকলী প্রকাশনী (১৯৯৮)। '৭১ নম্বর গুলশান এভিনিউ', অন্যপ্রকাশ (২০০২)। 'নোঙ্গরে নিয়তির হাত', অন্যপ্রকাশ (২০১০)। 'নির্বাচিত প্রেমের গল্প', মুক্তদেশ (২০১১)। 'গ্রহণলাগা রাতে', ঊষারদুয়ার প্রকাশনা (২০১৭)।

উপন্যাস: 'সূর্য শিখর দিন', অন্যপ্রকাশ (২০০১)। 'দহনলাগা তৃষ্ণা', অন্যপ্রকাশ ২০০৩)। 'দুধমুখা যেতে যেতে', অন্যপ্রকাশ (২০০৪)। 'নিভৃত নিলয়ে', অন্যপ্রকাশ (২০০৫)। 'মেঘ এসে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়', কাকলী প্রকাশনী (২০০৫)। 'হাত বাড়িয়ে দাও', অন্যপ্রকাশ (২০০৮)। 'হৃদয় গহীনে যে সুর বাজে', অন্যপ্রকাশ (২০০৯)। 'আকাশ ছুঁয়েছে মন', শিল্পতরু প্রকাশনী (২০০৯)। 'জুরানপুরের গল্প', বিশ্বসাহিত্য ভবন (২০২০)। 'অন্য ভুবনের মেয়ে', শিল্পতরু প্রকাশনী (২০২৩), অন্য ভুবনের মেয়ে (২০২৩)।

তিনি এ পর্যন্ত অনেক অনেক পদক, পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন, তন্মধ্যে উলেস্নখযোগ্য হলো: ২০০৪ সালে রোটারি ইন্টারন্যাশনালের সম্মাননা। ২০০৬ সালে ফেনী জেলার সিলোনিয়ার যুই সোসাইটি কর্তৃক আলোকিত মানুষ সম্মাননা পদকে ভূষিত হয়েছেন। ২০০৭ সালে কবি আবু জাফর ওবায়দুলস্নাহ স্মৃতি পুরস্কার, বাসপ সম্মাননা পদক, নক্ষত্র সাহিত্য পরিষদ সম্মাননা পদক। ২০০৮ সালে শব্দশীলন সাহিত্য পুরস্কার, ইয়াকুবপুর তরুণ সংঘ কর্তৃক তারুণ্য গুণিজন সম্মাননা, ঢাকা ব্যাংকের সৌজন্যে নবীনকণ্ঠ সাহিত্যি-সাংস্কৃতিক পুরস্কার। ২০১০ সালে ফুলকলি ফাউন্ডেশন কর্তৃক কাব্য সাহিত্যে বিশেষ সম্মাননা, সত্যজিৎ রায় পুরস্কার, স্বাধীনতা সংসদ কর্তৃক শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক স্মৃতি সম্মাননা। ২০১১ সালে অনির্বাণ সাহিত্য পুরস্কার। ২০১২ সালে শ্যামল ছায়া খেলাঘর আসর সম্মাননা পদকে ভূষিত হন। ২০১৫ সালে বাংলাদেশ রাইটার্স ফাউন্ডেশন কর্তৃক 'দুধমুখা যেতে যেতে' উপন্যাসের জন্য বেস্টবুক অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন। ২০১৯ সালে দাগনভূঞা উপজেলা প্রশাসন কর্তৃক প্রদত্ত সম্মাননা পুরস্কার। ২০২১ সালে ঝিনাইদহের মহেশপুর সাহিত্য পরিষদ কর্তৃক প্রদত্ত সম্মাননা পদক। ২০২২ সালে লক্ষ্ণীপুর জেলা সাহিত্য পরিষদ কর্তৃক প্রদত্ত সম্মাননা স্মারক। ২০২৩ সালে 'আধুনিক বাংলা কবিতায় আলস্নাহ্‌ প্রশস্তি'র জন্য 'কাব্যকথা' সাহিত্য সম্মাননা।

এছাড়াও তিনি ২০০৫ সালে ওয়ার্ল্ড এক্সপোজিশন-২০০৫ উপলক্ষে জাপান সরকারের আমন্ত্রণে ১০ সদস্যের এক সাংস্কৃতিক দলের সদস্য (কবি) হিসেবে জাপান সফর করেন।

আরিফ মঈনুদ্দীন আজও লেখালেখিতে সদা অগ্রসরমান। তিনি অতিশয় ভদ্রলোক ও মিষ্টভাষী মানুষ। তার লেখার হাত চমৎকার। তিনি মানবিক চেতনায় উদ্ভাসিত সুস্থ সংস্কৃতি বিকাশে ক্লান্তিহীন কর্মবীর। শুদ্ধ সমাজ নির্মাণের আলোকদীপ্ত কবি প্রতিভা। বিশেষ করে কাব্যশিল্প ও কথাসাহিত্যে নিরলস কলমযোদ্ধা তিনি। তার 'এখানে জিন্দাবাদ ভাড়া পাওয়া যায়' কাব্যগ্রন্থটি আশির দশকে বোদ্ধা পাঠক সমাজকে দারুণভাবে নাড়া দিয়েছে। গ্রন্থটিতে ক্ষয়িষ্ণু সমাজের অচলায়তন ভাঙার ভাষাচিত্র ফুটে উঠেছে প্রকৃষ্ট ব্যঞ্জনায়। এই কুশীলব আমাদের সমকালীন শিল্পের জগতে একজন বরেণ্য কবি, সাহিত্যিক।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে