সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

নারী নির্যাতনের মিথ্যা মামলা

আবদুর রহিম
  ১৪ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০

নারী-পুরুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় গড়ে উঠেছে এই সভ্যতা। সভ্যতাকে সাজাতে-গোছাতে পুরুষ দিয়েছে শ্রম। আর তাতে সর্বদা অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে নারী। নারী তার সেবা, মায়া-মমতা ও কর্তব্যনিষ্ঠ দায়িত্ব পালন করে পুরুষকে জুগিয়েছে অনুপ্রেরণা ও সাহস। কখনো কখনো পুরুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে করেছে কাজ। গড়ে তুলেছেন পৃথিবীর সব মহামানবদের। তাই পৃথিবীতে যত বড় মহান ব্যক্তি এসেছেন, তাদের পেছনে রয়েছে কোনো না কোনো নারীর অনুপ্রেরণা। এজন্য কবি বলেছিলেন,

'কোনকালে একা হয়নি ক'জয়ী, পুরুষের তরবারী;

প্রেরণা দিয়াছে, শক্তি দিয়াছে, বিজয়লক্ষ্ণী নারী'

নারী-পুরুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এই সভ্যতা গড়ে উঠলেও সমাজে নারীরা হয়ে এসেছে যুগ যুগ ধরে বঞ্চিত, অবহেলিত ও নির্যাতিত। পরিবার থেকে শুরু করে সর্বক্ষেত্রে তারা বঞ্চনা ও নির্যাতনের শিকার। তাই নারীর প্রতি সর্ব প্রকার বৈষম্য বিলোপ ও নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে ১৯৭৯ সালের ১৮ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত হয় সিডও সনদ। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ সরকার নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে ১৯৯৫ সালের ১৭ জুলাই প্রণয়ন করে নারী ও শিশু নির্যাতন (বিশেষ বিধান) আইন। পরবর্তী সময়ে ২০০০ সালের ১৪ ফেব্রম্নয়ারি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন নামে নতুন আরেকটি আইন করা হয়- যার নাম 'নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০'।

বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন প্রণয়নের মাধ্যমে দেশে নারী নির্যাতনের হার অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব হলেও বর্তমানে এটির অপব্যবহারও লক্ষ্য করা যাচ্ছে বহুলাংশে। অনেকে এটাকে ব্যবহার করছে পুরুষ নির্যাতনের হাতিয়ার হিসেবে। স্বামী কর্তৃক স্ত্রীর উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপন, পরকীয়া, স্ত্রী কর্তৃক স্বামীর প্রতি নির্যাতন ইত্যাদির বিরুদ্ধে স্বামী কথা বললেই ঘটছে স্বামীর বিরুদ্ধে নারী নির্যাতনের মামলা দেওয়ার মতো ঘটনা। ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের উপ-কমিশনারের মতে, পারিবারিক মামলার ক্ষেত্রে অনেকাংশে স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য জীবনের সঙ্গে যৌতুকের কোনো সম্পর্ক থাকে না। কিন্তু দাম্পত্য কলহ হলেই দেওয়া হয় যৌতুকের মামলা। এছাড়াও পুরুষকে বস্নাকমেইল করতে আবার জমিজমা সংক্রান্ত বিবাদকে কেন্দ্র করে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে দেওয়া হচ্ছে নারী নির্যাতনের মিথ্যা মামলা। পুলিশের মুখপাত্র সহকারী মহাপরিদর্শকের তথ্য মতে, এক্ষেত্রে বাংলাদেশে জমিজমা সংক্রান্ত মামলাই সব চেয়ে বেশি হয়ে থাকে। প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করার হাতিয়ার হিসেবে অনেক সময় জুড়ে দেওয়া হয় নারী নির্যাতনের মামলা।

বাংলাদেশ পুলিশের দেওয়া তথ্য মতে, ২০১৭ সালে দেশব্যাপী ১৫ হাজারের কিছু বেশি নারী নির্যাতনের মামলা হয়েছে- যার মধ্যে প্রায় চার হাজার মামলার ক্ষেত্রে পুলিশ তদন্তে ঘটনার কোনো প্রমাণ পায়নি বলে মামলা বিচার পর্যন্ত গড়ায়নি। অথবা ঘটনা মিটমাট হয়ে গেছে বলে মামলা তুলে নেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে, ২০১৭ সালে রায় হওয়া প্রায় সাড়ে আট হাজার নারী নির্যাতনের মামলায় সাজা হয়েছে মাত্র পাঁচশ' সাতাশটি মামলায় অভিযুক্ত আসামির। আর বাদবাকি সবগুলোতে অভিযুক্তরা খালাস পেয়েছেন। এছাড়াও ২০১৬ সালের জাতীয় বিচার বিভাগীয় সম্মেলনে সারাদেশের ৪০টিরও বেশি ট্রাইবু্যনালের বিচারক মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ার প্রথম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন মিথ্যা মামলাকে।

নারী নির্যাতনের এই মিথ্যা মামলার ফলে হেনস্থার শিকার হচ্ছেন অনেক নিরপরাধ মানুষ। আবার মিথ্যা মামলার ভয়ে স্ত্রী কর্তৃক বস্নাকমেইলের শিকার হয়ে নির্যাতিত জীবনযাপন করছেন অসংখ্য পুরুষ। বিশ্লেষকদের মতে, স্ত্রী কর্তৃক নির্যাতনের শিকার হলেও আইনের আশ্রয় নিতে পারছেন না পুরুষ। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সন্তানের ভবিষ্যৎ, সামাজিক মর্যাদা, চক্ষুলজ্জা, জেল-পুলিশ আর উল্টো মামলার ভয়ে বাধ্য হয়ে স্ত্রীর নির্যাতন সহ্য করতে হচ্ছে নীরবে। অন্যদিকে, এসব মিথ্যা মামলার আধিক্যের কারণে সত্যিকারে নির্যাতিত নারীদের মামলার বিচারের ক্ষেত্রে তৈরি হচ্ছে দীর্ঘ সূত্রিতা- যার ফলে তারা বহুলাংশে সুবিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। তাই সরকারের উচিত নারী নির্যাতনের মিথ্যা মামলার ক্ষেত্রে মিথ্যা মামলার জন্য কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা- যাতে কেউ মিথ্যা মামলা দিয়ে অযথা নিরপরাধ ব্যক্তিদের হয়রানি করার সুযোগ এবং বিচারকার্যে বিঘ্ন ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে না পারে। এছাড়া নারী নির্যাতনের মামলার তদন্তের ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতার বিষয়ে যথাযথ তদারকি করা এবং দ্রম্নত সময়ের মাধ্যমে বিচারকার্য সম্পাদন করা- যাতে সত্যিকারের ভিক্টিমরা সুবিচার পায় এবং অপরাধীদের কঠিন শাস্তি নিশ্চিত হয়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে