সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া

স্বল্পায়ু, তিপ্পান্ন বছরের জীবনে অধিকাংশ সময় তার কেটেছিল সংগ্রাম ও আত্মাত্যাগের মাধ্যমে। কৈশোরে পিতামাতার কন্যাসুলভ আচরণের শিকার, বারো বছরের বিবাহিত জীবনের ইতি, দুই কন্যা সন্তানের অকাল মৃতু্য, শ্বশুরবাড়ির সদস্যদের অনাদর কর্মকান্ড এবং সর্বশেষ তৎকালীন সমাজরক্ষকদের কটাক্ষের শিকার। সব প্রতিকূল পরিবেশকে ছেড়ে তিনি সবার ঊর্র্ধ্বে অবস্থান করেছিলেন। বাঙালি আপামর জনতার কাছে তিনি সমাজসেবক, অন্ধকারে থাকা বাঙালি নারীর কাছে শিক্ষার আলো, নারী-পুরুষ সমতার ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠ সংস্কারক এবং সাহিত্যিক হিসেবে যুক্তিবাদী ও চিন্তার বিস্ময়কর অগ্রসরতার প্রতিফলক। তিনি ছিলেন এমনই এক মহীয়সী নারী। বেগম রোকেয়া ছিলেন একজন কঠোর নারীবাদী। তবে পুরুষ বিদ্বেষী ছিলেন না।
বসুদেব রায়
  ১২ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০

'সূর্য ডোবার পর আমি নির্ভয়ে বাইরে যেতে চাই' শত শত বছর ধরে সেই অব্যক্ত মনস্কামনাকে বাস্তবে রূপ দিয়েছিল যে নারী তিনি হচ্ছেন বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। যার কাছে কুসংস্কারের রক্ষণশীলতা প্রথা মাথা নত করেছিল। যিনি স্বামিত্বের বেড়াজালকে ছিন্ন করেছিলেন, আর সৃষ্টি করেছিলেন প্রভুত্বহীন সুলতানার স্বপ্নের দেশ। যেখানে কেউ কাউকে ধর্মের বেড়াজালে আটক রাখতে পারবে না। নিজের কর্ম বলে নিজের অবস্থানে থাকবে। যে মাতৃগর্ভে সন্তানের জন্য সেই সন্তানের শাসনে মা জাতির দন্ড। সেই পৌরুষত্ব সৃষ্টি ধর্ম তিনি মানতে নারাজ। তাই তিনি সৃষ্টি করেছিলেন লিঙ্গ সমতার অনন্য এক পৃথিবী। আলো দেখিয়েছিলেন বাঙালি স্বকীয়তাহারা অবলা, নির্যাতিত, নিপীড়িত নারীকে। শুধু তিনি বাঙালি নারী জাগরণের অগ্রদূতেই নয়, বাঙালি জাতিসত্তা বিকাশের জ্বলন্ত কারিগর ও আধুনিক চেতনার পুরোধা ব্যক্তিত্ব। যে সময়ে নারীরা পুরুষের করাঘাতে বন্দি, সে সময়ে তিনি নিরীহ বাঙালির মুক্তির পথ স্বজাত শিল্পকে বেছে নিয়েছিলেন। তিনি যেমন উপমহাদেশের অনগ্রসরতার কারণ আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলেন, তেমনি তার স্পষ্ট সমাধানেরও পথ বাতলিয়ে দিয়েছিলেন।

স্বল্পায়ু তিপ্পান্ন বছরের জীবনে অধিকাংশ সময় তার কেটেছিল সংগ্রাম ও আত্মা ত্যাগের মাধ্যমে। কৈশোরে পিতামাতার কন্যাসুলভ আচরণের শিকার, বারো বছরের বিবাহিত জীবনের ইতি, দুই কন্যা সন্তানের অকালমৃতু্য, শ্বশুর বাড়ির সদস্যদের অনাদর কর্মকান্ড এবং সর্বশেষ তৎকালীন সমাজরক্ষকদের কটাক্ষের শিকার। সব প্রতিকূল পরিবেশকে ছেড়ে তিনি সবার ঊর্র্ধ্বে অবস্থান করেছিলেন। বাঙালি আপামর জনতার কাছে তিনি সমাজসেবক, অন্ধকারে থাকা বাঙালি নারীর কাছে শিক্ষার আলো, নারী-পুরুষ সমতার ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠ সংস্কারক এবং সাহিত্যিক হিসেবে যুক্তিবাদী ও চিন্তার বিস্ময়কর অগ্রসরতার প্রতিফলক। তিনি ছিলেন এমনই এক মহীয়সী নারী।

বেগম রোকেয়া ছিলেন একজন কঠোর নারীবাদী। তবে পুরুষ বিদ্বেষী ছিলেন না। কেননা, তিনি নারী ও পুরুষকে একটি সকটের দু'টি চাকার সঙ্গে তুলনা করেছেন- যার একটি চাকা ছোটো হলে অন্য চাকাটি চলতে পারে না বা চলা সম্ভব নয়। তবে তিনি সেই সব পুরুষদের তীব্র নিন্দা করেছেন যারা নারীর ওপর স্বামিত্ব খাটায়। সেই সঙ্গে তিনি নারী মুক্তির পথও প্রশস্ত করেছিলেন। তবে আজও দুঃখের বিষয় যখন শুনি ও দেখি নারী ইভটিজিং, যৌতুক প্রথা, বাল্যবিবাহ, নারী শ্রমের বৈষম্যের মতো অপ্রীতিকর ঘটনা। তা ভাবার বিষয় এখনো কেন আমরা জাগ্রত হয়নি? জীবনের সুখ কী এতটাই প্রিয় তাকে দাসত্বের বিনিময়ে কিনতে হবে। এসবের বিরুদ্ধে শুধু বঙ্গ নারী না বঙ্গ পুরুষদেরও রুখে দাঁড়াতে হবে। তবেই এ দেশের অগ্রগতি ত্বরান্বিত হবে। মনে রাখতে হবে, 'কোনোকালে একা হয়নিকো জয়ী, পুরুষের তরবারি; প্রেরণা দিয়েছি, শক্তি দিয়েছে, বিজয়ালক্ষ্ণী নারী।'

তিনি যে সত্যের বহ্নিশিখা স্থাপন করে গিয়েছিল তারই ফসল আজকের সুশিক্ষিতা বঙ্গ নারী। যারা আজ সমাজের প্রতিটি স্তরে পদার্পণ করছে। তারা ঘরে বাইরে সব জায়গায় নিজেদের সম্মানের সঙ্গে পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে। তারাই আবার পুরুষের গর্বের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই আমাদের মতো জনবহুল দেশে যখন নারী-পুরুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ব্যতীত আর্থসামাজিক উন্নয়ন অসম্ভব। সেহেতু নারী ও পুরুষ হাতে হাত রেখে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়াই সময়োপযোগী সমাধান। জাতীয় কবির সেই উপলব্ধিত সময়, 'সেদিন সুদূর নয়- যেদিন ধরণি পুরুষের সাথে গাহিবে নারীরও জয়! এখনই সেই সময়, শুভ হোক নারী-পুরুষের সম্মিলিত পথ চলা। জয় হোক মানবের'।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে