রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

নারী নির্যাতন বেড়েই চলছে

মীর আব্দুল আলীম
  ৩০ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০

বাংলাদেশে সব ক্ষেত্রেই নারীর অগ্রযাত্রা এখন বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত। অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় নারী ভূমিকা রাখছে। এ দেশে নারী রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এগিয়ে কিন্তু অধিকারে পিছিয়ে। নারীদের ইতিবাচক অগ্রগতি আছে। সেই অগ্রগতি এখনো নারীকে পুরোপুরি স্বাধীন করতে পারেনি। নারী এখনো ঘরের মধ্যে বন্দি। বিচার, সহিংসতা, নির্যাতন প্রশ্নে নারী এখনো অবহেলার শিকার। নারীর অর্জন এমন কেন? সামাজিক সূচকে বাংলাদেশের বিস্ময়কর সাফল্যের পেছনে নারীর অগ্রগতি বড় ভূমিকা রাখলেও নারীর অবস্থা আজও তেমন বদলায়নি। ঘরে-বাইরে নারীরা নির্যাতিত হচ্ছে। এক হিসাবে দেখা গেছে, দেশের ৬৫ শতাংশ বিবাহিত নারী স্বামীর মাধ্যমে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন, ৩৫ শতাংশ অন্য কারও দ্বারা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। বাংলাদেশের একটি বেসরকারি সংস্থার পরিচালিত গবেষণায় বলা হয়েছে, গত তিন বছরে ১৫ বছরের কম বয়সি কিশোরীরা বেশি যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এ সময়ে কমপক্ষে ৩০ শতাংশ কিশোরী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন এবং ৪৩ শতাংশের ওপর ধর্ষণের চেষ্টা হয়েছে এবং ২৭ শতাংশ নারী স্বামী, শ্বশুরবাড়ির লোকদের হাতে নির্যাতিত হয়েছেন। নারী নির্যাতনের শিকার হয় কিন্তু বিচার হয় না। বিচারহীন সংস্কৃতির কারণে দেশে নারী নির্যাতন বাড়ছে। দেশে কিন্তু নারী নির্যাতন প্রতিরোধে আইন আছে; প্রয়োগ নেই। রয়েছে বিশেষ ট্রাইবু্যনাল। হুঙ্কার দেওয়া হচ্ছে নারীসমতার। তা সত্ত্বেও বন্ধ হচ্ছে না নারী নির্যাতন, ব্যভিচার, হত্যাকান্ড, ধর্ষণ। বলার অপেক্ষা রাখে না, দেশে এ জাতীয় নারী নির্যাতন এবং যৌন হয়রানির ঘটনা মাত্রাতিরিক্ত হারে বেড়ে গেছে। নিত্যই ব্যভিচার ও ধর্ষণকামিতার ঘটনা ঘটছে। রোধ হচ্ছে না। নির্যাতিত হচ্ছে স্কুলছাত্রী, রোগী, শিশু, যুবতী, আয়া, বুয়া, গৃহবধূ। কেউ বাদ যাচ্ছে না। নিজ গৃহে, হাসপাতালে, রাস্তাঘাটে, চলন্ত বাসে, স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে, গৃহে ঘটছে এই নির্যাতনের পৈচাশিক ঘটনা। নারী নির্যাতন করছে স্বামী, স্কুল-কলেজের শিক্ষক, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, ডাক্তার, কর্মচারী, পুলিশ, আত্মীয়, চাচা-মামা-খালু, দুলাভাই, আমলা এমনকি পীর-মুরশিদরাও। পুরুষরা প্রায়ই নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে হুঙ্কার ছাড়েন। মঞ্চ, সেমিনারে বলেন, নারীরা মায়ের জাতি, নারী নির্যাতন করবেন না। মাইকে গলা ফাটিয়ে বক্তৃতা করেন- 'বউ পেটানো লোক আমি দুচোখে দেখতে পারি না।' এজাতীয় ভদ্রলোকরা বিচার সালিশে নারী নির্যাতনকারী পুরুষ পেলে বেশ শায়েস্তাও করেন। এ বিষয়ে নসিহত করেন; হাদিস কোরআনের আলোকে পরামর্শ দেন- 'বউ ঘরের লক্ষ্‌মী; কখনো বউ পেটাবেন না। আলস্নাহ নারাজ হবেন।' কিন্তু নিজ ঘরে ঢুকলেই এদের অনেকেই এক অন্য মানুষ। বউয়ের কাছে এলেই মুখোশ খুলে যায় ওদের। আমাদের সমাজে নেতৃত্বদানকারী এমন পুরুষের সংখ্যা নেহাত কম নয়। চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ভুরি ভুরি। কি রাজনৈতিক, কি ডাক্তার, উকিল, জনপ্রতিনিধি, সাংবাদিক কেউ বাদ নেই এ তালিকা থেকে। তারা বিবেকসম্পন্ন উঁচুতলার মানুষ তবুও এ কর্মটি করেন নির্লজ্জভাবে। যারা জনগণকে সচেতন করবেন; নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হবেন; তারাই যদি নির্যাতন করেন তাহলে নারী নির্যাতন বন্ধ হবে কি করে? নির্যাতিত নারীরা যেখানে আইনি আশ্রয় খোঁজেন সেখানেও সমস্যা। এ ব্যাপারে একজন পুলিশ কর্মকর্তার প্রসঙ্গ না আনলেই নয়। তিনি কয়েক মাস আগে নারায়ণগঞ্জের এক থানার ওসি হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ওই ওসি সাহেবের স্ত্রীর দিন কাটত ওপরওয়ালাকে স্মরণ করে, যেন ওইদিন নির্যাতনের মাত্রা একটু কম হয় এই আশায়। দোষে দুষ্ট বললে ভুল হবে, বলতে হবে তিনি গুণে গুণান্বিত ওসি! অতি নীরবে বউ পেটাতে পেটাতে তথাকথিত নারী নির্যাতনবিরোধী ওই ওসির একদিন থলের বিড়াল বের হয়ে গেল। এক রাতে থানার নিজ কক্ষে ওসি সাহেবের বউ পেটানো আসামিকে নিজের হাতে ডান্ডা মেরে বাসায় ফেরেন। সেদিন একটু বেশিই রাগেন তিনি। নিজের পশু চরিত্রও সামাল দিতে পারেননি। সেরাতে ওই মহান ওসি নিজেই তার প্রথম স্ত্রীকে শুধু পেটাননি সন্তানসহ ঘর থেকেই বের করে দেন। তার অধীনদের সামনেই থানা কম্পাউন্ডে ঘটে এসব। পরদিন নারীবাদী এই ওসির বউ পেটানো মুখোশ থানার বাউন্ডারি পেরিয়ে জনসমক্ষে ফাঁস হয়ে যায়। এই হচ্ছে আমাদের সমাজের নারী নির্যাতনের নমুনা।

২০২৪ সালে এসেও নারীর এ অবস্থা কেন? নারীরা তো শুধু পেশাগত কাজেই যুক্ত হচ্ছেন না, তারা রাজনীতি এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদেও আসীন হচ্ছেন। বাংলাদেশের নারীরা বিমান চালাচ্ছেন। যোগ দিচ্ছেন সেনাবাহিনী ও পুলিশবাহিনীতেও। এমনকি ঝুঁকিপূর্ণ এবং কায়িক পরিশ্রমের পেশায়ও আসছেন তারা। তবে নারী তার অধিকার বঞ্চিত কেন? নারী নির্যাতিত কেন? এ দেশের নারীরা শুধু পেশাগত কাজেই যুক্ত হচ্ছেন না, তারা রাজনীতি এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদেও আসীন হচ্ছেন। বাংলাদেশের নারীরা বিমান চালাচ্ছেন। যোগ দিচ্ছেন সেনাবাহিনী ও পুলিশবাহিনীতেও। এমনকি ঝুঁকিপূর্ণ এবং কায়িক পরিশ্রমের পেশায়ও আসছেন তারা। 'বাংলাদেশে নারীদের ইতিবাচক অগ্রগতি আছে। কিন্তু সেই অগ্রগতি এখনো নারীকে পুরোপুরি স্বাধীন করতে পারেনি। নারী এখনো এখানে ঘরের মধ্যে বন্দি। বিচার, সহিংসতা, নির্যাতন প্রশ্নে নারী এখনো অবহেলার শিকার।

বাইরের চেয়ে ঘরেই বেশি নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন নারীরা। এদের মধ্যে ৮৭ শতাংশ নারীই নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন তাদের স্বামীদের হাতে। ২০১৩ সালে ৪ হাজার ৭৭৭ জন নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এদের মধ্যে ১ হাজার ৩৮৭ জন নারী হত্যার (আত্মহত্যা ও রহস্যজনক মৃতু্য) শিকার হয়েছেন বলে জানিয়েছে স্টেপস। জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক আলোচনা সভায় এ তথ্য জানায় স্টেপস টুয়ার্ডস ডেভেলপমেন্ট (স্টেপস) নামের একটি সংগঠন। 'নারীর মানবাধিকার-২০১৩' প্রতিবেদন উপস্থাপন ও আলোচনা সভার আয়োজন করে ওই সংগঠনটি। প্রতিবেদনে বলা হয়, নারীরা ঘরেই বেশি নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকেন। এদের মধ্যে ৮৭ শতাংশ বিবাহিত নারী স্বামী হাতে নির্যাতিত ও এক-তৃতীয়াংশ বৈবাহিত ধর্ষণের শিকার হন। প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছর ৪ হাজার ৭৭৭ জনের মধ্যে ১ হাজার ৩৮৭ জন নারী আত্মহত্যা ও রহস্যজনক মৃতু্য, ৮১২ জন ধর্ষণ, ৮৭ জন হত্যা, ৭০৩ জন যৌতুক ও পারিবারিক সহিংসতার শিকার, ৪৪ জন এসিডদগ্ধ ও ৭৮ জন গৃহকর্মী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।

কোথাও আজ নারীরা নিরাপদ নয়। যৌতুকের জন্য স্বামী, শ্বশুরবাড়ির লোকজনের নির্যাতন, পথেঘাটে যৌন হয়রানি, ধর্ষণের পর খুন হচ্ছে নারী। এ ক্ষেত্রে থাকছে না বয়স, স্থান, কাল, পাত্রের ভেদ। দেশব্যাপী শুরু হয়েছে ব্যভিচারের চূড়ান্ত প্রকাশ্য ধর্ষণকামিতা। রাত-বিরাতে নয়- শুধু দিনদুপুরে প্রকাশ্য ধর্ষণের ঘটনাও ঘটছে। শুধু ধর্ষণই নয়, রীতিমতো গণধর্ষণ হচ্ছে। অপসংস্কৃতি আর ভিনদেশি সংস্কৃতির আগ্রাসন আমাদের সমাজকে কতটা ক্ষতবিক্ষত করছে তা হাল আমলের ধর্ষণের চিত্র দেখলেই বেশ টের পাওয়া যায়। বাসের ভেতরে ধর্ষিত হচ্ছে মেয়েরা, শিক্ষাঙ্গনে যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে শিক্ষার্থীরা, এমপির কথিত এপিএসের দ্বারাও এ দেশে ধর্ষিত হচ্ছে যুবতী। এই হলো বাস্তবতা। তবে এটি নতুন কোনো বিষয় তা নয়; বলা যায়, আমাদের সমাজ বাস্তবতার এক করুণ চিত্র। কিছু মানুষরূপী নরপশু সভ্যতার ভাবধারাকে পাল্টে দিতে হায়েনার নখ মেলে বসেছে। অপরাধের সাজা না হলে এজাতীয় অপরাধ বাড়তেই থাকবে। নারীর প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। তবেই নারী নির্যাতন কমবে।

নারীর প্রতি অবিচার, নির্যাতন, যৌন-ব্যভিচার সর্বযুগে, সব ধর্মমতে নিন্দনীয় নিকৃষ্ট পাপাচার। ধর্ষণ এবং ধর্ষণের পর হত্যার চূড়ান্ত শাস্তিবিধান মৃতু্যদন্ড। অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা হলে এবং সাক্ষ্য-প্রমাণে নিশ্চিত হলে হত্যাকারীর শাস্তিও মৃতু্যদন্ড। কিন্তু আমাদের দেশে এ পর্যন্ত যতগুলো ধর্ষণ ও ধর্ষণজনিত হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছে, তার যথাযথ বিচারসম্পন্ন হয়েছে এরূপ নজির কমই আছে। আলোচিত নারী নির্যাতনের ঘটনাগুলো চাপা পড়ে যায় এক সময়। হয় চূড়ান্ত রিপোর্টে ঘাপলা নয়তো সাক্ষ্যপ্রমাণে প্রভাবিত করে অপরাধী পার পেয়ে যাচ্ছে ঠিকই। উপরন্তু এর বিচার চাইতে গিয়ে বিচারপ্রার্থীরা নির্বিচারে পাল্টা হত্যার হুমকি কখনো কখনো হত্যার শিকার ও হয়রানির শিকার হন। এ অবস্থা থেকে আমাদের অবশ্যই বেরিয়ে আসতে হবে।

যৌন নির্যাতন বন্ধে আগে মানসিকতা বদলাতে হবে। নারী দেখলেই কেন ধর্ষণ করতে হবে? সব দোষ নারীর? সব দোষ পাশকের? এমন মানসিকতা কেন আমাদের। ধর্মে নারীকে পর্দা করতে বললেও পুরুষদেরও চোখ অবনত রাখতে বলা বয়েছে। তবে শুধু নারীর দোষ কেন? নারীর রূপ-যৌবন পুরুষকে মোহিত করবে সেটাই স্বাভাবিক। তাই বলে তার ওপর পশুর মতো ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে কেন? ধর্ষণ কমাতে হলে আগে পুরুষের মাঝে মানবিক গুণাবলি জাগ্রত করতে হবে। ধর্ষণ রোধে আমাদের সচেতন হতে হবে। অবাধ মেলামেশার সুযোগ, লোভ-লালসা-নেশা, উচ্চাভিলাষ, পর্নো সংস্কৃতির নামে অশ্লীল নাচ-গান, যৌন সুড়সুড়িমূলক বই-ম্যাগাজিন, অশ্লীল নাটক-সিনেমা ইত্যাদি কামোত্তেজনা মানুষকে প্রবলভাবে ব্যভিচারে প্ররোচিত করে তা বর্জন করতে হবে। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সময়মতো বিয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। ধর্মীয় শিক্ষা ও যৌন শিক্ষার গ্রহণ করতে হবে। বাজে সঙ্গ ও নেশা বর্জন করতে হবে। পাশাপাশি নারীকেও শালিন হতে হবে। যৌন উত্তেজক পোশাক বর্জন করতে হবে।

নির্যাতনের ভয়াবহতা থেকে নারীকে বাঁচানোর উপায় কি? কেবল আইনের কঠোর প্রয়োগেই কাজ হবে না। এর জন্য প্রয়োজন জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে যার যার পারিবারিক বলয়ে ধর্মানুশীলনে একনিষ্ঠতা, পোশাকের শালীনতা, অশ্লীল সংস্কৃতিচর্চার পরিবর্তে শিক্ষণীয় বিনোদনমূলক ও শালীন সংস্কৃতিচর্চার প্রচলন নিশ্চিতকরণ। আর এটা করতে হলে কেবল রাজনৈতিক বক্তৃতা, আইনের শাসন প্রয়োগ বা ফতোয়া দিলেই চলবে না, সমাজের সর্বস্তরের মানুষ যার যার অবস্থানে থেকে স্কুল-কলেজ মাদ্রাসা-মক্তব-মসজিদ-মন্দির-গির্জা-প্যাগোডার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা সমাজের অন্য বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবীদের সমন্বয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। সর্বোপরি কঠোর শাস্তির বিধান ও প্রয়োগ নিশ্চত করতে হবে। নারীকে মর্যাদার আসনে বসাতে হবে। পরনারীকে কখনো স্ত্রী, মা, কখনো বোন, কখনোবা মেয়ে ভাবতে হবে। তাদের ওপর লোলুপদৃষ্টি নয়; মায়ামমতার দৃষ্টি দিতে হবে। তবেই নারী নির্যাতন, ধর্ষণ কমে আসবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে