রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

বাড়ছে বাল্যবিয়ে

স্কুল-কলেজে পড়ুয়া কিশোর-কিশোরীরা বুঝে কিংবা না বুঝে জড়িয়ে পড়ছে প্রেমের সম্পর্কে- যার কারণেই বৃদ্ধি পাচ্ছে বাল্যবিয়ে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ সরকার বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগে দেশের মানুষের মাঝে বাল্যবিয়ের কুফল সম্পর্কে অনেকটা সচেতনতা গড়ে উঠেছে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করে সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলাকে বাল্যবিয়ে মুক্ত ঘোষণা করেছে সরকার
ভূঁইয়া শফি
  ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০

এক সময় বাংলাদেশে বাল্যবিয়ে আটকানো খুবই চ্যালেঞ্জিং একটা বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। দরিদ্রতা আর সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতার অভাবে আমাদের দেশে বাল্যবিয়ে বেড়ে গিয়েছিল। সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর উদ্যোগে দেশের মানুষের মাঝে বাল্যবিয়ের কুফল সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি পেলে মাঝের কিছু সময় বাল্যবিয়ে কমতে থাকে। তবে বর্তমান সময়ে প্রেমের কারণে উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে বাল্যবিয়ের প্রবণতা। স্কুল-কলেজে পড়ুয়া কিশোর-কিশোরীরা বুঝে কিংবা না বুঝে জড়িয়ে পড়ছে প্রেমের সম্পর্কে- যার কারণেই বৃদ্ধি পাচ্ছে বাল্যবিয়ে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ সরকার বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগে দেশের মানুষের মাঝে বাল্যবিয়ের কুফল সম্পর্কে অনেকটা সচেতনতা গড়ে উঠেছে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করে সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলাকে বাল্যবিয়েমুক্ত ঘোষণা করেছে সরকার। তথাপিও বাল্যবিয়ের পরিমাণ আশাতীত হ্রাস করা সম্ভব হয়নি। ব্যর্থতার বড় কারণ হলো সরকারি হিসাবের গরমিল! বাল্যবিয়ে সাধারণত অতি গোপনে হয়ে থাকে। যার কারণে প্রশাসনের কানে খবরটি পৌঁছায় না। প্রশাসনের খাতায় শুধু বাল্যবিয়ে বন্ধের হিসাব উঠে, কয়টি বাল্যবিয়ে সম্পূর্ণ হয়েছে তার সঠিক হিসাব থাকে না। আধুনিকতার ছোঁয়া আর প্রযুক্তির উন্নত হওয়ার বাতাস পেয়েছে স্কুলপড়া টিনেজ শিক্ষার্থীরা। স্কুল জীবনে মোবাইল ফোন হাতে পেয়ে বড়দের অনুসরণ করতে গিয়ে প্রেমের সম্পর্কে আবদ্ধ হচ্ছে অনেকেই। বাল্যবিয়ের ক্ষেত্রে একটি অন্যতম কারণ বলা যেতে পারে প্রযুক্তির অপব্যবহার। হাতে মোবাইল ফোন পাওয়ার কারণে রাত জেগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চ্যাটিং করে ব্যস্ত সময় পার করছে কিশোর-কিশোরীরা। এ কারণে ক্ষতিতে পড়ছে তাদের মানসিক বিকাশ, পড়ালেখা, দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মেধা শূন্যতা আরো নানা জটিল সমস্যা। এখন যে কেউ চাইলেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে খুব সহজে যুক্ত হতে পারছে একে অন্যের সঙ্গে। ফলে কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে ভাব আদান-প্রদানের সুযোগ আগের চেয়ে অনেক বেড়ে গেছে। আর এভাবেই একটা সময় গড়ে উঠছে প্রেম, ভালোবাসার সম্পর্ক। সর্বশেষ ঘটনাটি গড়িয়ে যায় বাল্যবিয়ে পর্যন্ত। মূলত বিদেশি টিভি সিরিয়াল ও বিদেশি কালচার অনুসরণ করতে গিয়ে তারা এমনটা ঘটাচ্ছে। উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার পর ছেলে-মেয়েদের আর কোনো কাজে বাধা নিষেধ করা হয় না। তারা স্বাধীনভাবেই চলতে পারে তাদের মর্জির মতো। টেলিভিশন সিনেমা, নাট্য ফিল্ম, বিদেশি সিরিয়াল বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রেম ভালোবাসাকে প্রমোট করে। যা দেখে আমাদের দেশের ছেলেমেয়েদের মাঝে প্রেমে পড়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। বিদেশি কালচার অনুসরণ করতে গিয়ে স্কুল-কলেজের অপ্রাপ্ত বয়স্ক কিশোর-কিশোরীরা বুঝে হোক বা না বুঝে তারা প্রেমের সম্পর্কে আবদ্ধ হচ্ছে। স্কুল-কলেজ ফাঁকি দিয়ে স্কুল-কলেজের সময়ে তারা বিভিন্ন পার্ক, কফি হাউস, রেস্টুরেন্ট ও সিনেমা হলে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাঙালি সংস্কৃতিতে এই রকমটা আগে দেখা না গেলেও তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামাচ্ছে না। অনেকটা বয়সের দোষ বলে, উড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। হয়তো এটাই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিশোর বয়সের প্রেমের ক্ষেত্রে কোনো ছেলে বা মেয়ে তারা কেউ প্রতিষ্ঠিত নয় বা তাদের বয়স এমন নয় যে, তারা নিজেরা নিজেদের কথা চিন্তা করতে পারে। তাই তারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভুল সময় আর ভুল মানুষের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে আবদ্ধ হয়। যার কারণে তাদের পরিবার তাদের সম্পর্ক স্বীকৃতি দিতে চায় না। অপ্রাপ্ত বয়স্ক সন্তানের প্রেমের বিষয়টি যখন পরিবার পর্যন্ত চলে আসে তখন পরিবারের সদস্যরা ছেলে বা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মেয়েকে পরিবারের সম্মান রক্ষার স্বার্থে অন্যত্র বিয়ে দেওয়ার জন্য মনোস্থির করে। আমাদের দেশের ১৮ বছরের আগে কোনো মেয়ে ও ২১ বছরের আগে কোনো ছেলেকে বিয়ে দেওয়া আইনত দন্ডনীয় অপরাধ। তাই অপ্রাপ্ত বয়স্ক ওই মেয়েটিকে অতি গোপনে কাজি বা মোলস্না ডেকে বিয়ের দেওয়া হয়। সব ক্ষেত্রেই এসব বিয়ে প্রশাসন ও সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টি এড়িয়ে দেওয়া হয়ে থাকে। যে কারণে তারা বিষয়টি জানতে পারে না। বিয়ের সমস্ত আয়োজন জোগাড় হয়ে যাওয়ার পর মেয়ে ও মেয়েটির বাবার দিকে তাকিয়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ইউপি চেয়ারম্যান-মেম্বাররাও বিষয়টি সামাজিকভাবে চেপে যাওয়ার চেষ্টা করে। এটিও একটি কারণ প্রশাসনের দৃষ্টি এড়ানোর। স্থানীয় প্রশাসন বাল্যবিয়ের সংবাদের ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকারের ইউপি চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল। তাদের চেপে যাওয়ার কারণে বিষয়টি আর প্রশাসনের নজরে আসে না। সবচেয়ে বড় উদ্বেগজনক বিষয় হলো- না জানার কারণে এই বাল্যবিয়েটি সরকারি হিসাবের খাতায় লিপি বন্ধ হয় না। আবার অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় কিশোর বয়সে কিশোরীরা তার প্রেমিকের সঙ্গে পালিয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটিয়ে ফেলে। এক্ষেত্রে মেয়ের পরিবার থানায় নিখোঁজ ডায়েরি করে। বিভিন্ন থানায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যে সব মেয়ের নিখোঁজ ডায়েরি করা হয় তাদের বয়স সাধারণত ১৩ থেকে ১৭ বছরের মধ্যে হয়ে থাকে এবং বেশিরভাগই প্রেমিকের সঙ্গে পালিয়ে গিয়েছে এমন ঘটনা। পুলিশ খুঁজে বের করার পর মেয়ের বাবা নিজের সম্মান রক্ষার স্বার্থে মেয়েকে ওই অন্যত্র বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে বা ওই প্রেমিকের কাছেও বিয়ে দেন। এ ক্ষেত্রেও বিয়েটি প্রশাসনের নজর এড়িয়ে গোপনে হয়। যার কারণে এটিও সরকারের হিসাবের খাতায় আসে না। এছাড়াও ইভটিজিং বাল্যবিয়ের ক্ষেত্রে অন্যতম একটি সমস্যা। স্কুল-কলেজে যাওয়ার পথে বখাটে ছেলেরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে। তারা স্কুল-কলেজের মেয়েদের বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি ও কথাবার্তার মাধ্যমে উত্ত্যক্ত করে। যার কারণে মেয়েরা আর পড়ালেখার জন্য স্কুলে যেতে চায় না। পরিবার বোঝা মনে করে বিয়ে দিয়ে দেয়। এভাবেই আমাদের দেশে বর্তমান সময়ে বাল্যবিয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাল্যবিয়ের কারণে নারীর প্রতি সহিংসতা, প্রসবকালীন মৃতু্যঝুঁকি, প্রজনন স্বাস্থ্যসমস্যা ছাড়াও নানাবিধ শারীরিক সমস্যায় পড়তে হচ্ছে কিশোরীদের। অল্প বয়সে বেশিরভাগ নারী শিশুমৃতু্যর প্রধান কারণ বাল্যবিয়ে। দেশে মা ও শিশু মৃতু্যর মূল কারণ ১৮ বছরের কম বয়সিদের মা হওয়া। বিশেষজ্ঞদের মতে, কিশোরী মায়ের মৃতুঝুঁকি প্রাপ্তবয়স্ক মায়ের তুলনায় অন্তত চার গুণ বেশি। বাল্যবিয়ের ফলে অল্প বয়সে গর্ভবতী হওয়ার ফলে অপুষ্টির কারণে অনেক সময় নবজাতক মারাও যায়। এমনকি নবজাতক বেঁচে থাকলেও পরবর্তী সময়ে এসব শিশুরা বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক জটিলতায় ভোগে। অনেক ক্ষেত্রে নাবালিকা মেয়ে মা হওয়ায় কীভাবে শিশুকে পরিচর্যা করবে, সে সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান রাখে না। অল্প বয়সে বিয়ের ফলে একটি মেয়ের পক্ষে অন্য একটি পরিবারের অনেক বিষয় ও একটি সংসার সামাল দেয়া বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। না দিতে না পারার কারণে অধিকাংশ ক্ষেত্রে নারীরা শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণার শিকার হয়ে থাকে। অল্প বয়সে বিয়ে দেওয়া শিশু নির্যাতন বা যৌন নির্যাতনের মধ্যে পড়ে। বাল্যবিয়ে নারীর অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করে। বাল্যবিয়ের ফলে নারী শিক্ষার হার গ্রাস, স্কুল থেকে ঝরে পড়ার হার বৃদ্ধি, নারীদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার ক্ষমতা ও সুযোগ কমে যাওয়াসহ নানারকম নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় সমাজ ও রাষ্ট্র। তাই রাষ্ট্রকে বাল্যবিয়ে মুক্ত করতে হবে।

রাষ্ট্রকে বাল্যবিয়ে নামক অভিশাপ থেকে রক্ষার স্বার্থে শুধু দেশের সরকারকেই এগিয়ে আসলে হবে না, বরং দেশের প্রত্যেক পরিবার ও প্রত্যেক মানুষকে এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে। বাল্যবিয়ে প্রতিকারে গ্রামে গ্রামে পাড়ায় পাড়ায় প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। গ্রাম্য পর্যায়ে প্রশাসনের নজরদারি বাড়াতে হবে। সরকারকে বাল্যবিয়ের নির্ভুল ও সঠিক হিসাব তৈরি করতে হবে। পরিবারের অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছেলে ও মেয়েদের সার্বক্ষণিক খবরদারির মধ্যে রাখতে হবে। তারা কার সঙ্গে মিশে কোথায় যায় এসব বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে। পরিবারের বড়দের খেয়াল রাখতে হবে তারা মোবাইল ফোন বা অনলাইনে কি করে এ বিষয়ে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। বয়ঃসন্ধিকাল ও কিশোর বয়সের প্রেমর সমস্যার বিষয়গুলো নিয়ে তাদের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কর্মস্থল, রাস্তাঘাট ও গণপরিবহণকে নারীবান্ধব ও যৌন হয়রানিমুক্ত করতে হবে। আমাদের প্রথম যে কাজটি করতে হবে তা হলো মেয়েদের নিরাপদ পথচলা নিশ্চিত করতে হবে। বাল্যবিয়ে ঠেকাতে বিভিন্ন স্তরে যোগ্যতা অনুযায়ী নারীর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হতে নারীদের আগ্রহী করতে হবে। নারীদের জন্য বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। স্বল্প শিক্ষিত ও শিক্ষা ঝরেপড়া মেয়েদের কারিগরি ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের আওতায় আনতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থাকে সেমিনারের মাধ্যমে বাল্যবিয়ের কুফল সম্পর্কে প্রচারণা চালাতে হবে। লিফলেট, পোস্টার, নাটক, জারিগান, কার্টুন ও স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের মাধ্যমে জনসচেতনতার ব্যবস্থা করে জনসাধারণের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বাল্যবিয়ে বন্ধ বা এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে