রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

প্রবাসী নারী কর্মীদের অমানবিক জীবন

মোসাইদ রাহাত
  ১২ মার্চ ২০২৪, ০০:০০

প্রবাসী নারী কর্মীদের অমানবিক জীবন অনেক আগে থেকেই। এ নিয়ে কারো কোনো মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার হালিমা খাতুন। জীবিকার তাগিদে পাড়ি দেন মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরবে। যে বাড়িতে কাজ করতেন, সেখানে শিকার হয়েছেন নির্যাতনের। অমানবিক পরিশ্রম করেও ঠিকমতো পেতেন না বেতন। বাধ্য হয়ে দুই বছর আগে ফিরে আসেন দেশে। এখনো তিনি মাঝ রাতে ঘুমের মধ্যে আঁতকে ওঠেন। স্মৃতিগুলো তাড়িয়ে বেড়ায় তাকে।

অশ্রম্নভেজা চোখ দুটো মুছতে মুছতে হালিমা খাতুন এই প্রতিবেদককে বলেন, 'আমি সৌদির রিয়াদে ছিলাম। দুই বছরের জন্য যে বাড়িতে কাজ করতে গেয়েছিলাম, সেখানে নির্যাতনের শিকার হয়েছি। আমাকে ওরা মারধর করেছে, সম্পূর্ণ বেতন দিত না। আমি অনেক কষ্টে ওই জায়গা থেকে বেরিয়ে আসি। আসার সময় তারা আমার পারিশ্রমিকটুকু আটকে রেখে দেশে পাঠিয়ে দেয়। এখন ভালো আছি। ওয়েলফেয়ার সেন্টারে প্রশিক্ষণ নিয়ে স্বল্প পুঁজিতে ব্যবসা করে সংসারের হাল ধরেছি।'

'আমি দেড় মাস বিস্কুটের কার্টন খেয়ে থাকছি। আমাদের একটু ভাতও দিসে না। আমি দালালের মাধ্যমে সৌদি গেছালাম। সৌদিতে যারাই গৃহকর্মী হিসেবে যায়, তাদের ওপর জুলুম চলে। আমি যখন মরার পথে, তখন তারা আমাকে অজ্ঞান অবস্থায় হাসপাতালে ফেলে যায়। ওই সময় আমার দোষ ছিল আমি একটু বিশ্রাম কেন নিলাম। এখন দেশে এসে অর্থ কষ্টে আছি। তবে শারীরিক-মানসিক নির্যাতন থেকে তো বেঁচে গেছি।' কাঁদতে কাঁদতে কথাগুলো বলছিলেন, একই গ্রামের আনোয়ারা বেগম।

এভাবেই পরিবারের সুখের আশায় জীবিকার তাগিদে মধ্যপ্রাচ্যে যাওয়া হাওড়ের নারীরা নিঃস্ব হয়ে ফিরছেন দেশে। বিশেষ সুবিধা ও উচ্চ বেতনের প্রলোভনের ফাঁদে পড়ে সৌদি আরব, ওমান, কাতার ও দুবাই গিয়ে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন হাওড়ের নারীরা। তবে বিদেশফেরত প্রবাসীদের দক্ষ বানাতে প্রশিক্ষণ দিয়ে স্বাবলম্বী করে তুলতে কাজ করে যাচ্ছে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের ওয়েলফেয়ার সেন্টারগুলো।

সুনামগঞ্জ ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের ওয়েলফেয়ার সেন্টারের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত আট মাসে সুনামগঞ্জে প্রায় আট হাজার নারী ও পুরুষ মধ্যপ্রাচ্য থেকে দেশে ফিরে এসেছেন। এর বেশির ভাগই নারী শ্রমিক। তাদের অনেকে ছিলেন সৌদি আরবে। আবার অনেকে গিয়েছিলেন কাতারে। এ ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের দেশ দুবাই, ওমান থেকেও নির্যাতিত হয়ে দেশে ফিরছেন নারীরা।

জীবন-জীবিকার অন্বেষণে সৌদি আরবে যাওয়া আরেক নারী জেসমিন বেগম। গতকাল বৃহস্পতিবার বিকালে শনির হাওড়পাড়ে তার নিজ বাড়িতে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তিনি বলেন, 'স্বামী সংসারী না হওয়ায় টাকা দেনা করে নিজেই গিয়েছিলেন সৌদি আরবে। কিন্তু কপালে সুখ সইল না। হলো না ভাগ্য পরিবর্তনের কোনো পথ। হলো না টাকা উপার্জন। শূন্য হাতেই ফিরেছেন নিজ জন্মভূমিতে, পরিবার-পরিজনের কাছে।' তার রয়েছে তিন ছেলে।

তিনি জানান, '২০১৭ সালের দিকে ধারদেনা করে প্রায় দুই লাখ টাকা খরচ করে গিয়েছিলেন সৌদি আরবের আলকাসিম মিচকিন খামচায়। যা রিয়াদ থেকে দুই থেকে তিন ঘণ্টা দূরের গন্তব্যে। সেখানে এক শেখের বাড়িতে পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে কাজ করতেন। তার পরিবারের সদস্য ১০-১২ জন। তাদের সবার খাবার রান্না করা, কাপড় পরিষ্কার করার কাজ করতেন। মাত্র দুই থেকে তিন ঘণ্টা তিনি বিশ্রামের সময় পেতেন। তাদের কাজের পর আবার অন্যের বাড়িতেও কাজ করাত। কিন্তু টাকা দিত কম। নির্যাতন ও খাবারের জন্য কষ্ট দেওয়া ছিল নিত্যদিনের ঘটনা।

জেসমিন বেগম বলেন, 'সে কষ্ট বলে বোঝানোর মতো না। তাই দেশে চলে এসেছি গত বন্যার আগে। আমি চাই না আমার মতো কেউ এইভাবে কষ্ট করুক। কিন্তু দেশে এসেও শান্তি নাই। তিন বছর সৌদি থেকে যে টাকা পাঠিয়েছি; আমার পরিবারের সদস্যরাও হিসাব দেয়নি। তাই কষ্টটা আরও বেড়ে গেছে। আমার মেজো ছেলে টমটম (অটোরিকশা) চালিয়ে সংসার চালায়। আমি এখন কিছুই করতে পারি না।'

শুধু জেসমিন বেগমই নয়, সুনামগঞ্জ সদর উপজেলা গৌরারং ইউনিয়নের উত্তরশ্রী গ্রামের বাসিন্দা জাহানারা বেগম এমন নির্যাতনের শিকার। তিনি ২০২২ সালে গিয়েছিলেন সৌদি আরব। সেখানে গিয়ে কাজ করেন এক শেখের বাড়িতে। কিন্তু ওই বাড়ির মালিক ও তার সাত মেয়েসহ পরিবারের লোকজন ভালো ব্যবহার করত না। শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করত। পরে মালিকের মেয়ে তার তিন লাখ টাকা জোর করে রেখে দেয়। এ নিয়ে ঝগড়া করে দেশে চলে আসেন তিনি। তবে এখন ওয়েলফেয়ার সেন্টার থেকে প্রণোদনা পেয়ে ছোটখাটো ব্যবসা শুরু করেছেন।

সুনামগঞ্জ মহিলা পরিষদের সভাপতি গৌরী ভট্টাচার্য্য বলেন, 'হাওড়ের নারীরা মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে নির্যাতিত হয়ে দেশে ফিরছেন, এটি আমরা প্রায়ই শুনি। তবে গৃহকর্মী নিয়ে সরকার ও রাষ্ট্রের ভাবা উচিত। তারা সংসারের অভাব দূর করতে দালাল শ্রেণির লোকের মাধ্যমে অল্প টাকায় বিদেশ গিয়ে নিঃস্ব, সর্বস্বান্ত হচ্ছে। যেটি নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। যারাই দেশের বাইরে যাচ্ছেন, তারা যেন দক্ষ হয়ে তবেই বিদেশ যান এবং দালালের মাধ্যমে নয়, সরকারিভাবে যান, তাহলে তাদের জন্য উপকার হয়। এছাড়া যারা বিদেশ থেকে চলে আসছেন, তাদেরও দক্ষ করে স্বাবলম্বী হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্বও কিন্তু রাষ্ট্রের। আশা করি, রাষ্ট্র সেটি নিয়ে ভাববে।'

সুনামগঞ্জ ওয়েলফেয়ার সেন্টারের সহকারী পরিচালক গাজী নাজমুল ইসলাম বলেন, 'যারা প্রবাসফেরত, তাদের আমরা বিভিন্নভাবে সহযোগিতা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে স্বাবলম্বী করার জন্য কাজ করছি। তাদের এককালীন ১৩ হাজার ৫০০ টাকা প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে। যাতে তারা প্রাথমিকভাবে নিজেদের গোছাতে পারেন।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে