সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

পৃথিবী থেকে দূরে সরে যাচ্ছে চাঁদ

আমরা কী শেষ পর্যন্ত এমন কোনো ভবিষ্যৎ দেখতে যাচ্ছি, যেখানে পৃথিবীর আশপাশে কোনো চাঁদ থাকবে না? বর্তমানে পৃথিবী থেকে দূরে সরে যাওয়ার হার এত বেশি থাকার পরও চাঁদ পৃথিবীকে সম্পূর্ণরূপে ছেড়ে যাবে এমন সম্ভাবনা নেই। প্রায় ৫০০ কোটি থেকে ১০০০ কোটি বছরের মধ্যে সম্ভবত সূর্যের বিপর্যয়মূলক মৃতু্য ঘটবে। কিন্তু তার অনেক আগেই সম্ভবত মানবসভ্যতা বিলীন হয়ে যাবে।
প্রদীপ সাহা
  ২৯ জুলাই ২০২৩, ০০:০০

মানব ইতিহাসের পুরোটাজুড়ে পৃথিবীর ওপর চাঁদের উপস্থিতি একেবারে অবিচ্ছেদ্য। এর মৃদু মাধ্যাকর্ষণ শক্তির টানে পৃথিবীতে জোয়ার-ভাটার ছন্দ নির্ধারিত হয়। এর আলোয় অনেক প্রজাতির নিশাচর প্রাণী যৌনকর্মে লিপ্ত হয়। বিশ্বে এ পর্যন্ত যতগুলো সভ্যতা এসেছে, সবাই শুক্লপক্ষ ও কৃষ্ণপক্ষের ওপর ভিত্তি করে তাদের ক্যালেন্ডার কিংবা পঞ্জিকা তৈরি করেছে। কিন্তু সেই চাঁদ আমাদের কাছ থেকে বর্তমানে একটু একটু করে দূরে সরে যাচ্ছে। চাঁদের অবস্থানের ওপর নির্ভর করে বহু সংস্কৃতিতে নানারকম উৎসব পালন করা হয়। চাঁদ পৃথিবীর চারপাশে প্রদক্ষিণ করে, কখনোই নিজে ঘুরপাক খায় না। সে কারণে আমরা সব সময় চাঁদের একটি মাত্র পিঠই দেখতে পাই। কিন্তু 'লুনার রিসেশন' নামে এক প্রক্রিয়ার ফলে চাঁদ ধীরে ধীরে আমাদের গ্রহ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।

অ্যাপোলো মিশনের মহাকাশচারীরা চাঁদের পিঠে যেসব প্রতিফলক বসিয়েছিলেন, বিজ্ঞানীরা তার ওপর লেজার রশ্মি নিক্ষেপ করেছেন। সম্প্রতি তারা শতভাগ নির্ভুলতার সঙ্গে পরিমাপ করতে সক্ষম হয়েছেন, চাঁদ কত দ্রম্নতগতিতে পৃথিবীর কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। তারা নিশ্চিত করেছেন, চাঁদ প্রতি বছর ১ দশমিক ৫ ইঞ্চি (৩ দশমিক ৮ সেন্টিমিটার) হারে দূরে সরে যাচ্ছে এবং এর ফলে দিনের দৈর্ঘ্য একটু একটু করে বাড়ছে। লন্ডনের রয়্যাল হলওয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের জিও-ফিজিক্সের অধ্যাপক ডেভিড ওয়ালথাম পৃথিবী ও চাঁদের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে গবেষণা করেন। তিনি বলেছেন, 'এসবই হচ্ছে জোয়ারের জন্য। জোয়ারের টানের ফলে পৃথিবীর ঘূর্ণন ধীর হয়ে আসে এবং সেই শক্তিতে চাঁদে কৌণিক ভরবেগ তৈরি হয়।' সূর্যগ্রহণ মূলত ঘটে থাকে চাঁদের কারণে। পৃথিবী তার কক্ষপথে ঘোরার সঙ্গে সঙ্গে একটু দূরে চাঁদের মাধ্যাকর্ষণ শক্তি সমুদ্রে জোয়ার ও ভাটার সৃষ্টি করে। এই জোয়ার সমুদ্রের পানিকে ফুলিয়ে দেয়, যা উপবৃত্তের আকারে একবার চাঁদের অভিকর্ষের দিকে এবং আরেকবার বিপরীত দিকে প্রসারিত হয়। কিন্তু যেহেতু পৃথিবী তার অক্ষের ওপর চাঁদের কক্ষপথের চেয়েও অনেক বেশি দ্রম্নতবেগে ঘুরছে, তাই চাঁদের নিচের সমুদ্রের অববাহিকাগুলোর সঙ্গে ঘর্ষণের কারণে চাঁদ সেই পানিকে টেনে ধরে রাখতে কাজ করে। এর মানে হলো, সমুদ্রের পানি ফুলে ওঠার ব্যাপারটি ঘটে চাঁদের কক্ষপথের কিছুটা সামনে। চাঁদ তখন এটিকে পেছনের দিকে টেনে ধরে রাখার চেষ্টা করে। ফলে সামান্য হলেও এটি আমাদের গ্রহের ঘূর্ণন শক্তিকে কমিয়ে দেয়। চাঁদের শক্তি অর্জনের সময় পৃথিবীর ঘূর্ণন আরও ধীর হয়ে যায়, যার ফলে চাঁদ একটু উপরের কক্ষপথে সরে আসে।

আমাদের গ্রহের ঘূর্ণনের এই ক্রমবর্ধমান ধীরগতির মানে হলো, ১৬০০ শতকের শেষদিক থেকে পৃথিবীতে দিনের দৈর্ঘ্য প্রতি শতাব্দীতে গড়ে প্রায় ১ দশমিক ৯ মিলিসেকেন্ড হারে বেড়েছে। প্রাচীন পর্যবেক্ষণের ওপর ভিত্তি করে তৈরি অন্যান্য পরিমাপগুলোতে এই সংখ্যাকে আর একটু বেশি করে দেখানো হয়েছে (প্রতি শতাব্দীতে ১ দশমিক ৭৮ মিলিসেকেন্ড হারে)। এমনিতে এটা খুব বেশি বলে মনে না হলেও পৃথিবীর সাড়ে ৪০০ কোটি বছরের ইতিহাসে এক গভীর পরিবর্তনকে তুলে ধরে। সৌরজগতের জন্মের প্রথম পাঁচ কোটি বছর পর বা তার কাছাকাছি সময়ে চাঁদ তৈরি হয়েছিল বলে মনে করা হয়। এ নিয়ে সবচেয়ে বেশি যে তত্ত্বটিকে মেনে নেওয়া হয়, তা হলো- পৃথিবী যখন মাত্র গঠিত হয়েছে বা হচ্ছে, সেসময় মঙ্গলগ্রহের আকারের অন্য একটি বস্তু যা থিয়া নামে পরিচিত, তার সঙ্গে সংঘর্ষ ঘটে। এর ফলে পৃথিবীর একটি অংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এখন আমরা একে চাঁদ বলে ডাকি। পৃথিবীতে পাথরের স্তরের মধ্যে সংরক্ষিত ভূতাত্ত্বিক তথ্য থেকে স্পষ্ট হয়েছে, আজকের তুলনায় অতীতে চাঁদ পৃথিবীর অনেক কাছাকাছি জায়গায় ছিল। বর্তমানে চাঁদের অবস্থান পৃথিবী থেকে ৩ লাখ ৮৪ হাজার কিলোমিটার দূরে। কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় ৩২০ কোটি বছর আগে যখন পৃথিবীর টেকটনিক পেস্নটগুলো মাত্র ঘুরতে শুরু করেছিল এবং মহাসাগরে বসবাসকারী অণুজীবগুলো নাইট্রোজেন খেতে শুরু করেছিল, সে সময়ে চাঁদ পৃথিবী থেকে মাত্র ২ লাখ ৭০ হাজার কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ছিল- যা বর্তমান দূরত্বের তুলনায় প্রায়

৭০ ভাগ।

জার্মানির ফ্রিডরিশ শিলার ইউনিভার্সিটির ভূ-পদার্থবিদ টম ইউলেনফেল্ড এবং অন্যদের গবেষণা থেকে জানা গেছে, লুনার রিসেশনের হার সবসময় একরকম ছিল না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর গতি কখনো বেড়েছে, আবার কখনো কমে গেছে। আর্জেন্টিনার ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অফ সাল্টার ভূতাত্ত্বিক ভ্যানিনা লোপেজ ডি আজারেভিচ এক সমীক্ষায় জানিয়েছেন, প্রায় ৫৫০-৬২৫ মিলিয়ন বছর আগে চাঁদ বছরে ২ দশমিক ৮ ইঞ্চি (৭ সেন্টিমিটার) পিছিয়ে যেত। মি. ইউলেনফেল্ড বলেন, 'চাঁদ যে গতিতে পৃথিবী থেকে দূরে সরে যায়, তা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও তা ঘটবে।' প্রকৃতপক্ষে আমরা বর্তমানে এমন একটি সময়ের মধ্যে বাস করছি, যখন এই দূরে সরে যাওয়ার (লুনার রিসেশন) হার অস্বাভাবিকভাবে বেশি। এই হারে বর্তমান অবস্থানে পৌঁছানোর জন্য চাঁদকে মাত্র দেড়শ' কোটি বছর অপেক্ষা করতে হতো। কিন্তু সাড়ে চারশ' কোটি বছর আগে চাঁদ তৈরি হওয়ার পর থেকে লুনার রিসেশনের যে প্রক্রিয়াটি ঘটছে, তা অতীতে স্পষ্টতই অনেক ধীরগতির ছিল।

পৃথিবীতে মহাদেশগুলো এখন যেভাবে অবস্থান করছে, তাতে উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের অববাহিকায় একটি ধাক্কা তৈরি করছে। এই মহাসাগরে যে পানি রয়েছে, তা জোয়ারের কাছাকাছি হারে একবার সামনে এগিয়ে যায় এবং একবার পেছনে সরে আসে। উদাহরণ দিয়ে ড. ওয়ালথাম বলেন, মনে করুন একটি শিশুকে দোলনায় ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। যদি প্রতিটি ধাক্কার সঙ্গে সঙ্গে একই গতিতে আরও ধাক্কা দেওয়া হয়, তাহলে দেখবেন দোলনার উচ্চতা বেড়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, উত্তর আটলান্টিক যদি সামান্য একটু বেশি প্রশস্ত কিংবা সংকীর্ণ হতো তাহলে এমনটি ঘটত না। আমরা যেসব মডেল তৈরি করেছি তাতে দেখা যাচ্ছে আপনি যদি কয়েক মিলিয়ন বছর পিছিয়ে যান, তখন মহাদেশগুলোর অবস্থান ভিন্ন ছিল বলে জোয়ারের শক্তিও খুবই কম ছিল। কিন্তু ভবিষ্যতে এতে পরিবর্তন ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে। আমরা কী শেষ পর্যন্ত এমন কোনো ভবিষ্যৎ দেখতে যাচ্ছি, যেখানে পৃথিবীর আশপাশে কোনো চাঁদ থাকবে না? বর্তমানে পৃথিবী থেকে দূরে সরে যাওয়ার হার এত বেশি থাকার পরও চাঁদ পৃথিবীকে সম্পূর্ণরূপে ছেড়ে যাবে এমন সম্ভাবনা নেই। প্রায় ৫০০ কোটি থেকে ১০০০ কোটি বছরের মধ্যে সম্ভবত সূর্যের বিপর্যয়মূলক মৃতু্য ঘটবে। কিন্তু তার অনেক আগেই সম্ভবত মানবসভ্যতা বিলীন হয়ে যাবে। তবে যাই হোক, স্বল্পমেয়াদে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হিমবাহ এবং হিমশৈলগুলোতে আটকে থাকা পানি গলে যাওয়ার পরিমাণ হ্রাস করে মানবসভ্যতা নিজেই দিনের দৈর্ঘ্য কিছুটা কমাতে একটা ভূমিকা পালন করতে পারে। (সূত্র : বিবিসি)

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে