সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

ধ্বংস হচ্ছে মহাকাশ স্টেশন

প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে দেখা যাবে এক আশ্চর্য দৃশ্য! প্রায় ৪০০ টন ধাতব পদার্থ দিয়ে তৈরি আইএসএস তীব্রগতিতে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে ঢুকছে; বাতাসের সঙ্গে সেই ঘর্ষণে তার গায়ে আগুন ধরে যাচ্ছে; তারপর সেই জ্বলন্ত অগ্নিগোলক আছড়ে পড়ছে সাগরের বুকে। সমুদ্রের কয়েক হাজার কিলোমিটার এলাকার মধ্যে ঘটবে এ ঘটনা। আর এর সঙ্গেই শেষ হবে মানবজাতির বৃহত্তম প্রকল্পগুলোর একটি
প্রদীপ সাহা
  ০৫ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০

আইএসএস বা 'আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশন' প্রায় আড়াই দশক ধরে মহাকাশে নভোচারীদের আবাসস্থল হিসেবে কাজ করছে। কিন্তু মার্কিন মহাকাশ সংস্থা 'নাসা' পরিকল্পনা করছে, কয়েক বছরের মধ্যেই এটিকে কক্ষপথ থেকে ছাড়িয়ে পৃথিবীতে নামিয়ে এনে ধ্বংস করে ফেলা হবে। তবে এ মহাকাশ স্টেশনকে অন্য কোনো কাজে লাগানো যায় কিনা, তা নিয়ে ভাবছেন বিজ্ঞানীরা? আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনটি একটা ফুটবল মাঠের সমান বড়, ২০০টি হাতির মোট ওজনের চেয়েও ভারী। একে কক্ষপথ থেকে নামিয়ে আনা অত্যন্ত কঠিন একটি কাজ। কিন্তু 'নাসা' পরিকল্পনা করেছে- আগামী আট বছরের মধ্যে তাই করা হবে। যদি সে সময় প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে থাকা হয়, দেখা যাবে সেই আশ্চর্য দৃশ্য! প্রায় ৪০০ টন ধাতব পদার্থ দিয়ে তৈরি আইএসএস তীব্রগতিতে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে ঢুকছে; বাতাসের সঙ্গে সেই ঘর্ষণে তার গায়ে আগুন ধরে যাচ্ছে; তারপর সেই জ্বলন্ত অগ্নিগোলক আছড়ে পড়ছে সাগরের বুকে। সমুদ্রের কয়েক হাজার কিলোমিটার এলাকার মধ্যে ঘটবে এ ঘটনা। আর এর সঙ্গেই শেষ হবে মানবজাতির বৃহত্তম প্রকল্পগুলোর একটি।

আইএসএস বা আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনটি তৈরির কাজ শুরু হয়েছিল ১৯৯৮ সালে। তখন থেকেই এটি পৃথিবীর চারদিকে ঘুরছে। এর দৈর্ঘ্য ১০৯ মিটার। আইএসএস হচ্ছে মহাশূন্যে মানুষের তৈরি বৃহত্তম কাঠামো। এতে আছে ১৫টি মডিউল, বিশাল ধাতব ফ্রেমের ওপর বসানো সৌরশক্তির প্যানেল। এতে পালা করে থাকেন সাতজন ক্রু। মহাশূন্য বিশ্লেষক লরা ফরজাইক একে তুলনা করেছেন গিজার পিরামিডের সঙ্গে। এখানে প্রথম নভোচারীরা থাকতে আসেন ২০০০ সালে। তারপর থেকে ২০টি দেশের আড়াইশ'রও বেশি লোক এখানে এসে থেকেছেন। জোসেফ অ্যাশবাকার হলেন ইউরোপিয়ান মহাকাশ সংস্থা 'ইএসএ'-র প্রধান। তিনি বলেন, এ মহাকাশ স্টেশন এক বিরাট সাফল্য। আইএসএস ছিল আন্তর্জাতিক সহযোগিতার একটি কেন্দ্র, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের কিছুদিন পর থেকেই রাশিয়া এ প্রকল্পে যোগ দেয়।

অধিকাংশ বিশেষজ্ঞই একমত, ২০৩০ সালের পর এটিকে ব্যবহার করা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাবে। বিকল্প হিসেবে কখনো কখনো বলা হয়েছে, আরও উঁচুতে নিরাপদ কোনো কক্ষপথে এটিকে নিয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু এটিকে অবাস্তব চিন্তা বলেই মনে করছে নাসা। নাসা বলছে, আইএসএসকে ঠেলে উচ্চতর কক্ষপথে নিয়ে যেতে হলে অনেক মহাকাশযান লাগবে। এর পরিবর্তে নাসা গত বছর (২০২২) বলেছে, আইএসএসকে ঠেলে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে নিয়ে আসা হবে। এর যন্ত্রপাতিগুলোর অধিকাংশই এখন অনেক পুরনো হয়ে গেছে। এর ফলে ভবিষ্যতে এ স্টেশনটা বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। এমনকি সঠিক কক্ষপথে রাখার জন্য তাকে নিয়ন্ত্রণ করাও অসম্ভব হয়ে উঠতে পারে। ১৯৮৫ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের স্যালুট-৭ স্পেস স্টেশনের বিদু্যৎ সরবরাহ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গিয়ে এমনটাই ঘটেছিল। তখন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দুজন নভোচারী সেটাকে আবার চালু করতে সক্ষম হয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল এয়ার অ্যান্ড স্পেস মিউজিয়ামের ইতিহাসবিদ ক্যাথি লুইস বলেন, আমরা চাই না- এমনটা আবার ঘটুক। বিপর্যয় ঠেকানোর জন্য নাসা পরিকল্পনা করেছে, আগামী ২০৩১ সালে আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশনকে 'ডি-অরবিট' অর্থাৎ কক্ষপথ থেকে নামিয়ে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে ঢুকিয়ে এটিকে নিরাপদে সাগরে আছড়ে ফেলা হবে। আজ পর্যন্ত যত মহাকাশযান পৃথিবীতে ফিরে এসেছে, তার মধ্যে এটিই হবে বৃহত্তম।

'টাগবোট' নামের ছোট নৌযান দিয়ে যেমন বড় জাহাজ টেনে নিয়ে যাওয়া হয়, ঠিক তেমনি একটি 'স্পেস টাগ' তৈরি করার জন্য গত মার্চ ২০২৩ মার্কিন কংগ্রেসের কাছে অর্থ চেয়েছে মহাকাশ সংস্থা 'নাসা'। এই 'স্পেস টাগ' এমন এটি মহাকাশযান, যা আইএসএসকে ঠেলে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে নিয়ে আসবে। এরকম একটা যান তৈরি করতে প্রায় ১০০ কোটি ডলার খরচ হবে। ঠিক কীভাবে আইএসএসকে তার কক্ষপথ থেকে বের করে আনা হবে, তা এক বিশাল চ্যালেঞ্জ। পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে ঢোকার সময় বড় বড় মহাকাশযান পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। যেমন- ২০০১ সালে রাশিয়ার 'মির স্পেস স্টেশন' এবং ১৯৭৯ নাসার 'স্কাইল্যাব'। তবে আইএসএস-এর ক্ষেত্রে সমস্যাটা আরও জটিল। কারণ এটা মির স্পেসের চেয়ে তিন গুণেরও বেশি বড়। মার্কিন হার্ভার্ড স্মিথসোনিয়ান সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের মহাকাশবিজ্ঞানী জোনাথন ম্যাকডাওয়েল বলেছেন, এটা এক বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ ৪০০ টন ওজনের একটা জিনিস আকাশ থেকে খসে পড়ছে, এটা কোনো সহজ ব্যাপার নয়!

আইএসএসকে কক্ষপথ থেকে নামিয়ে আনার কাজটা শুরু হবে ২০২৬ সাল থেকে। প্রথমে একে আপনা থেকেই কিছুটা নিচে নেমে আসতে দেওয়া হবে। বর্তমানে এটি আছে মাটি থেকে ২৫০ মাইল উপরে। আর ২০৩০ সালের মাঝামাঝি নাগাদ এটি নেমে আসবে ২০০ মাইল উচ্চতায়। তখন এ স্টেশনে শেষবারের মতো একদল ক্রু পাঠানো হবে। তারা আইএসএসের ভেতর যেন কোনো যন্ত্রপাতি বা ঐতিহাসিক গুরুত্বসম্পন্ন জিনিস রয়ে না যায়, তা নিশ্চিত করবেন। এভাবে আইএসএসের ওজন খানিকটা কমিয়ে ফেলা হবে। ক্রুদের এ শেষ দলটি আইএসএস ছেড়ে চলে যাওয়ার পর মহাকাশ স্টেশনটি আরও খানিকটা নিচে অর্থাৎ ২৮০ মাইল উচ্চতায় নেমে আসবে। মনে করা হয়, এটিই হচ্ছে 'পয়েন্ট অব নো রিটার্ন' অর্থাৎ এরপর আইএসএসকে আর উপরের দিকে ঠেলে ওঠানো যাবে না। কারণ, এ উচ্চতায় পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের উপরের স্তরের ঘনত্ব বেড়ে যাবে। প্রক্রিয়াটির জন্য সময় লাগবে কয়েক মাস। আইএসএসকে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের ভেতরে ঠেলে দেওয়ার কাজটা করবে 'প্রগ্রেস' নামের রুশ মহাকাশযান। রাশিয়া আভাস দিয়েছে, তারা হয়তো ২০২৫ সাল নাগাদ আইএসএস প্রকল্প থেকে বেরিয়ে যেতে পারবে। তবে যে মহাকাশযানই ব্যবহার হোক না কেন- তার ধাক্কায় আইএসএস নেমে আসবে ৭৫

মাইল উচ্চতায়।

মহাকাশ স্টেশনটি পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের অপেক্ষাকৃত ঘন গ্যাসের স্তরে ঢুকে পড়বে। এ সময় তার গতি হবে ঘণ্টায় ২৯ হাজার কিলোমিটার। প্রথমেই আইএসএসের সোলার প্যানেলগুলো মূল অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। মোটামুটি ৬২ মাইল উচ্চতায় আসতেই সব সোলার প্যানেল ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে। আইএসএস ৫০ মাইল উচ্চতায় নেমে এলে মূল মডিউলগুলো আলাদা হয়ে যেতে শুরু করবে। তখন এগুলোর তাপমাত্রা হবে কয়েক হাজার ডিগ্রি। ৪০০ টনের আইএসএস প্রচন্ড তাপে গলে যাবে এবং ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে তাতে আগুন ধরে যাবে। আশা করা হচ্ছে, সবকিছুই পরিকল্পনা মতো কাজ করবে এবং আইএসএসের পতনশীল জ্বলন্ত টুকরোগুলো মানুষের জন্য কোনো বিপদ সৃষ্টি করবে না। এর এক বিরাট অংশই পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। যতটুকু অবশিষ্ট থাকবে, সেগুলো এসে পড়বে 'পয়েন্ট নেমো' নামে প্রশান্ত মহাসাগরের একটি বিস্তীর্ণ এলাকায়- যা নিউজিল্যান্ড ও দক্ষিণ আমেরিকার মাঝখানে। এ জায়গাটিকে প্রায়ই মহাকাশযানের কবরখানা হিসেবে ব্যবহার করা হয়। কারণ, এ জায়গাটি মানুষের বসতি থেকে অনেকটা দূরে এবং এখানকার পানিতে সামুদ্রিক প্রাণীও খুবই কম। তারপরও আইএসএসের ধ্বংসাবশেষ যে জায়গাটিতে পড়বে, তা প্রায় ৬ হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ এবং বেশ কয়েক কিলোমিটার চওড়া।

কিছু লোক মনে করেন, আইএসএসকে এভাবে কক্ষপথ থেকে নামিয়ে আনাটা অর্থের অপচয়। কারণ, এতে আছে অনেক মূল্যবান যন্ত্রপাতি এবং কাঠামো; আছে সোলার প্যানেলে ব্যবহৃত দামি ধাতু। এগুলো মহাকাশে নিয়ে যেতেও বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়েছে। জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের মহাশূন্য নীতি বিশেষজ্ঞ জন ক্লাইন বলেন, 'আমাদের উচিত এর যতটা পারা যায়, ততটাই পুনর্ব্যবহার করা।' নাসা যে কোনো নতুন আইডিয়াকে স্বাগত জানালেও তারা এখনো নতুন কোনো প্রস্তাব আহ্বান বা গ্রহণ করেনি। তাদের পরিকল্পনা, আইএসএসকে পৃথিবীতে নামিয়ে এনে তার ধ্বংসাবশেষ প্রশান্ত মহাসাগরে কবরস্থ করা। ২০৩০ সালের পর এভাবেই হয়তো মানুষের মহাকাশ অভিযানের এক অসাধারণ কীর্তির সমাপ্তি ঘটবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে