শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

'এখনকার সিনেমার কিছুই বুঝি না'

আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চলচ্চিত্র অভিনেত্রী ফরিদা আক্তার ববিতা। চলচ্চিত্রের পরিবেশ 'অসুস্থ' উলেস্নখ করে দীর্ঘদিন ধরেই অভিনয় থেকে দূরে রয়েছেন দেশ বরেণ্য এ তারকা। চলচ্চিত্রে কাজ না করায় হাতের অফুরন্ত সময় কাটান ইবাদত-বন্দেগিতে। পাশাপাশি ক'দিন পরপরই একমাত্র ছেলে অনীককে দেখতে কানাডায় ছুটে যান তিনি। এখনো সেখানেই অবস্থান করছেন তিনি। দেশ ছাড়ার আগে তার সঙ্গে কথা বলে সাক্ষাৎকারটি সাজিয়েছেন
মাতিয়ার রাফায়েল
  ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০০:০০
ফরিদা আক্তার ববিতা

'আমি যদি বুঝতে পারি এখনকার সিনেমায় দেওয়ার মতো কিছুই নাই আমার, তখন দূরে থাকাই ভালো। তারাও কিছু বানাতে পারলেন না, আমিও কিছু করতে পারলাম না এমন সিনেমায় আমার এতকালের অর্জন তো মাটি করে দিতে পারি না। এখন শুধু নামকা ওয়াস্তে থাকলাম, কিন্তু কিছুই পেলাম না- সে রকম গল্পও না, সে রকম চরিত্রও না- তা করে নিজের সুনাম তো বিনষ্ট করতে পারি না। তবে সে রকম চরিত্র হলে অবশ্যই করব।'

ঢাকাই সিনেমা থেকে অনেকদিন হলো দূরে থাকার কারণ জানতে চাইলেই এভাবেই একনাগাড়ে বলতে শুরু করেন ববিতা। কথা শেষ হতে না হতেই এখনকার সিনেমার মান প্রসঙ্গে চলে যান তিনি। বলেন, 'অ্যাকচুয়ালি এখন সিনেমাই দেখা হয় না। যে দুয়েকটি দেখেছি, তার মধ্যে 'মনপুরা'টা ভালো লেগেছে। খুব যে মারাত্মক কিছু হয়েছে তাও না। আমাদের সময়ে যেসব সিনেমা হতো সে তুলনায় এখনকার সিনেমাগুলো কিছুই না। কিছুই না। শুধু এতটুকুই বলতে পারি।'

একসময় সিনেমার দর্শক বলতে গোটা দেশের দর্শক ছিল; এখন যেন ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। কথা কেড়ে নিয়ে ববিতা বলেন, 'এটা কিন্তু দেশের সিনেমার জন্য খুব ভালো লক্ষণ না। ছবি হতে হবে সব ধরনের দর্শকের জন্য। সব শ্রেণির দর্শক থাকতে হবে সিনেমায়। নির্দিষ্ট একটা শ্রেণির জন্য বানানো সিনেমা কখনো গোটা দেশের কথা বলতে পারে না। গোটা দেশের পরিচয় বইতে পারে না।'

আগে তো সিনেমার নামকরণেও সিনেমাটি সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যেত.... কথাটি টেনে নিয়েই ববিতা বলেন, 'এখন কি সেরকম চিন্তা থেকে সিনেমা বানানো হয়! এখন হচ্ছে কিছু পয়সা ইনকাম হবে, সেই চিন্তা থেকে সিনেমা বানানো। তখন সিনেমা বানানো হতো দেশের জন্য। নিজের সুনামের জন্য। এখন যা হচ্ছে- না কমার্শিয়াল, না আর্টফিল্ম, না টেলিফিল্ম- আমি নিজেও বুঝি না। এ সিনেমাগুলো কি বলতে চায় কিছুই বুঝি না।'

কিন্তু এসব সিনেমার কোনো কোনোটি তো আলোচিতও হচ্ছে! ববিতার ভাষ্য, 'অ্যাকচুয়ালি মানসিক দিক থেকে আমি এমন অবস্থায় আছি যে, এখন কোথায় কি হচ্ছে তা জানতে পারছি না। বাসায় কোনো পত্রপত্রিকাও রাখি না। কোন ছবি কোন উৎসবে যাচ্ছে বা গিয়েছে তাও আমার জানা হয় না।'

তারপরও সিনেমাগুলো প্রথম পর্বেই ছিটকে পড়ছে, মূলপর্বে যেতে পারছে না। কৌতূহলী হয়ে জানতে চান ববিতা 'মানে, আপনি কি আগের সিনেমা সম্পর্কে বলছেন, নাকি এখনকার সিনেমা সম্পর্কে!' পরক্ষণেই বলেন, 'আসলে আগে এক রকম নিয়ম ছিল, এখন হয়তো অন্যরকম। ছবি সরকারিভাবেই পাঠানো হয়। তাতে পদ্ধতিগত ব্যাপারও থাকে। নিয়ম হচ্ছে, জমা দেওয়া ছবিগুলো আয়োজকরা আগে দেখবেন। তারপর চিন্তা করবেন ছবিটি উৎসবের জন্য রাখা যায় কিনা। এখন কীভাবে ছবিগুলো যায় জানি না। তখন মোটেও ব্যক্তিগতভাবে ছবি পাঠানো হতো না। তবে আমাদের মন্ত্রণালয় ঠিকমতো পাঠায়নি বলেই সেগুলো প্রতিযোগিতায় আসতে পারেনি।'

সরকারিভাবে সেন্সরের বিষয়ও থাকে। তাতে ভালো ছবিও বাদ যেতে পারে- এমন মন্তব্যে তিনি বলেন,'যতটুকু জানি, মন্ত্রণালয় প্রথমে ভালো ভালো সিনেমাগুলো যাচাই করে দুয়েকটা নির্বাচিত ছবি উৎসবে পাঠায়। এখন সিনেমাগুলো কীভাবে ফেস্টিভালে ইনক্লুড হয় তা আমার জানা নেই বিধায় আপনার প্রশ্নের উত্তরটা ঠিকমতো দিতে পারছি না।'

এখনকার নিয়ম জানা না থাকলেও নিজ সময়ের জানা অভিজ্ঞতা থেকে এ বরেণ্য শিল্পী বলেন, 'এখন তো শুনি এ নিয়ে অনেক লবিং, তদবিরসহ আরো কিছু হয়। এ নিয়েই তারা সারাবছর পড়ে থাকে এবং খোঁজখবর নেয়। ওইসব ফেস্টিভালে আমি অনেকবার গিয়েছি তো, আমার অভিজ্ঞতা একেবারে খারাপ না। অবশ্য এটা আমার সময়কার কথা। নিয়ম অনুযায়ী তারা বিভিন্ন দেশে একটা ইনভাইটেশন লেটার পাঠায়। তারপর মন্ত্রণালয় নির্বাচিত সিনেমা পাঠালে ওরা সেই সিনেমার গল্প, টেকনিক, রিয়েলিটি সবকিছু ভালো করে দেখে। ভালো লাগলে আরেকটি লেটার পাঠিয়ে ছবিটি উৎসবের জন্য রাখার কথা বলে। নয়তো কিছুই না জানিয়ে বাতিল করে দেয়।' তারপর 'বসুন্ধরা', 'অশনি সংকেতে'র এ শিল্পী আগের ব্যর্থতার কথা বলতে গিয়ে বলেন, 'সেক্ষেত্রে আপনার প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে- জহির রায়হান, নারায়ণ ঘোষ মিতা, আমজাদ হোসেনের ছবি ঠিকমতো পাঠানো হয়নি বিধায় তাদের ছবি সেভাবে নজরে পড়েনি। তারপরও যা পাঠানো হয়েছে দেশের জন্য সম্মান বয়ে এনেছে।' সেই সম্মান পাওয়া বিষয়ে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তাতে তিনি আরো যোগ করেন, 'আমি নিজেই সাক্ষী, তাসখন্দে সুভাষ দত্তর 'বসুন্ধরা' দেখে তারা বলেন, 'তোমাদের টেকনোলজির এত সীমাবদ্ধতা থাকতেও এমন ভালো সিনেমা বানাতে পার!' তখন তো চিত্রগ্রাহক ছিলেন আনোয়ার হোসেন। খুব ভালো চিত্রগ্রাহক ছিলেন। এখন তো সেই মানের চিত্রগ্রাহকই নেই। শেখ নিয়ামত আলীর 'দহন'ও উচ্চ প্রশংসা পায়। 'সূর্য দীঘল বাড়ী' জার্মানি, পর্তুগালসহ বিভিন্ন উৎসবে ভালো প্রশংসা পায়। কিন্তু এখন উৎসব নিয়ে কত কিছুই তো হয়- তা আমার জানা নেই বলে তাদের বিষয়ে আপনার প্রশ্নের উত্তরটা দিতে পারছি না।' এরপর নিজের কিছু জানা তথ্য থেকে যোগ করে বলেন, 'কিছু মনে করবেন না, এমনও হয়, আয়োজকরা যখন দেখেন বাংলাদেশ থেকে সিনেমা জমা পড়েনি তারা ভাবে, 'আচ্ছা বাংলাদেশ তো সুন্দর দেশ। তাদের কেন সুযোগ দিই না'। তখন বাংলাদেশকেও লেটার পাঠায়। এরকম বিষয়ও আমার জানা আছে।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে