সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

আপসহীন বাপ্পা মজুমদার

মাতিয়ার রাফায়েল
  ০২ মার্চ ২০২৩, ০০:০০

এ দেশের সঙ্গীতাঙ্গনে এ পর্যন্ত যে ক'জন আলোচিত শিল্পীর রয়েছেন, তার মধ্যে প্রথম সারির একজর সুভাশীষ মজুমদার বাপ্পা প্রথম সারিতেই থাকবেন। তার গানে, কণ্ঠে ও সুরে এমন জাদু মাখানো তরঙ্গ বয়ে যায় যে, সমকালীন আর কারো গানেই তেমন প্রতিধ্বনিত হয় না। এই চোখের পলকেই কখন বাংলা গান এত দ্রম্নত গতিসম্পন্ন হয়ে গেল, স্রোতের প্রবাহে ভেসে গেলে একে সব শিল্পী সেখানে নিঃসঙ্গ শেরপা'র মতো একাই থেকে গেলেন বাপ্পা মজুমদার। যে জায়গায় নিজের আসন পেতে বসে আছেন সেখান থেকে এক চুল নড়লেন না। শূন্য দশক থেকে বর্তমান সময়; দেশের সঙ্গীতে পরিবর্তন এসেছে অনেক। ক্যাসেটের যুগ পার করে আসে সিডির যুগ, সেটাও শেষ হয়ে আসে অনলাইন, ইউটিউব তথা ডিজিটাল মাধ্যম। সময়ের এসব পরিবর্তনের পালে হাওয়া লাগিয়ে চলছেন সবাই। যাদের অধিকাংশই গা ভাসিয়েছেন সস্তা জনপ্রিয়তার করাল স্রোতে। গুণগত মানের কথা চিন্তা না করে কেবল গান করে চলেছেন, উদ্দেশ্য শুধু কী করে ইউটিউবে ভিউ পাওয়া যায়; কী করে রাতারাতি পরিচিতি পাওয়া যায় এ নিয়ে এক অস্থির হয়রানির মধ্যে থাকাই হচ্ছে তাদের গানের ব্যস্ততা।

এই সস্তা জনপ্রিয়তার স্রোতে যে শিল্পী গা ভাসিয়ে দেননি, যে শিল্পী সব সময়েই স্থির থেকে চলেছেন নিজের বানানো বাগান পথে, তিনিই হলেন বাপ্পা মজুমদার। দীর্ঘ সঙ্গীত জীবনে মানহীনতার সঙ্গে আপস করেননি কখনো। নিজের বৈশিষ্ট্যের প্রমাণ দিয়ে যাচ্ছেন এমন স্রোতের বিপরীতেও। প্রমাণ দিয়ে চলে এখনো রুচিশীল, মানসম্মত গান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়নি শুদ্ধাচারী শ্রোতা। সেই ইমেজ তৈরি করতে নিতে পেরেছেন বলেই এখন গান শুনতে ইচ্ছে করলে শ্রোতারা ছুটে যান বাপ্পা মজুমদারের গানে। কারণ তিনি এমন সব গান সৃষ্টি করেছেন, যেগুলোর আবেদন ফুরায়নি, কখনো ফুরাবেও না।

পারিবারিক নাম শুভাশীষ মজুমদার বাপ্পা হলেও তরুণ অনুরাগীদের কাছে তিনি 'বাপ্পা দা'। আর বাংলাদেশের মানুষের কাছে বাপ্পা মজুমদার। সংক্ষেপে তার এই বাপ্পা নামটির সঙ্গে তার জাদুকরী গান এমনভাবে মিশে গেছে যে, শ্রোতার কানে বাপ্পা নামটি উঠলেই তার গান কেমন সেটারও একঝলক পরিচয় ঘটে যায়। সঙ্গীতের মতো বিশাল এক চওড়া ভুবনে যেমন মান্না দে নামটি আসলেই যেমন তার গান কেমন এটাও কানে অনুরণিত হতে থাকে, ভূপেন হাজারিকা নামটি এলেই শ্রোতার কানে এটা অনুরণিত হতে থাকে এরকম বাপ্পা মজুমদারের নামটিও অনুরণিত হতে থাকে।

শূন্য দশকের শুরুতে ব্যান্ডগানকে পাশ কাটিয়ে বাপ্পার গান শোনার জন্য জাদুগ্রস্ত হয়ে পড়েন শ্রোতারা। এমন শিল্পী তো যেখানে সেখানে থেকে গানের হাতেখড়ি নিতে পারেন না। যেখানে তার গানের হাতেখড়ি সেটার সঙ্গেও যে জড়িয়ে আছে এ দেশের এক কিংবদন্তি পরিবার। বাবা ওস্তাদ বারীণ মজুমদার যিনি ছিলেন উপমহাদেশের একজন প্রখ্যাত সঙ্গীতবিশারদ। মা বরেণ্য সঙ্গীতশিল্পী ইলা মজুমদার। প্রখ্যাত এই সঙ্গীত যুগল পরিবারের ছোট ছেলে বাপ্পা মজুমদারকে বাইরের কারো কাছেই গান শিখতে হয়নি। বরং পরবর্তী সময়ে ওস্তাদ বারীণ মজুমদারের সঙ্গীত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মণিহার সঙ্গীত একাডেমিতে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ওপর পাঁচ বছর মেয়াদি একটি কোর্স সম্পন্ন করেন। বাবা-মায়ের আশীর্বাদে নিজেকে ক্রমশ আরো উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর করে তুলেছেন তার গান, কণ্ঠ, গায়কী ও সুরের মোহন মন্ত্রবশীকরণ জাদুতে।

গড়েছেন সঙ্গীতের আরেক 'বব ডিলান'খ্যাত সঞ্জীব চৌধুরীর সঙ্গে 'দলছুট' নামের ব্যান্ডদল। যে দলটি বাংলাদেশের অন্য সব ব্যান্ডদল থেকেই ব্যতিক্রম ছিল। অন্যান্য ব্যান্ডদল যেখানে পাশ্চাত্যের উন্মাতাল গানকে আলিঙ্গন করে সেখানে 'দলছুট' পাশ্চাত্যের ক্লাসিক শিল্পী বব ডিলান, এলভিস প্রিসলিদের সুরের সঙ্গে প্রাচ্যের সুরের জাদুকে একীভূত করে। বাংলা গানকে আরেক নতুন মাত্রায় উন্নীত করে। সঞ্জীবের মৃতু্যর পর নিজেই দলছুটের হাল ধরেন। বাপ্পা মজুমদার ব্যান্ড ও নিজের জন্য গান লেখার পাশাপাশি অন্য শিল্পীদের জন্যও গান লিখে থাকেন। 'সত্তা' সিনেমায় জেমসের গাওয়া 'না জানি কোন অপরাধে' গানটির সুরকার হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন তিনি।

অসম্ভব ভালো গিটার বাজিয়ে বাপ্পা মজুমদার তার বড় ভাই পার্থ মজুমদারের কাছে ছোটবেলাতেই গিটার বাজানো শিখেছেন। পরে সেটা নিয়ে গেছেন তিনি আরো অনন্য উচ্চতায়। তার সুরেলা দরদভরা রোমান্টিক কণ্ঠের সঙ্গে ব্যতিক্রমী কম্পোজিশন এবং সহজ-সাবলীল নিমগ্ন গায়কী সমকালীন বাংলা গানে উজ্জ্বল হয়ে আছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে