বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১

আরও বর্ণিল একুশের গৌরবে আলমগীর

বাংলাদেশের সিনে জগতের একমাত্র পুরস্কার-পুরুষ এমন বিশেষণ মূলত তাকেই মানায়। যিনি বাংলাদেশে সিনেমার চিত্রনায়ক হিসেবে আলমগীর নামেই সমধিক পরিচিত। পুরো নাম এম এ আলমগীর। পুরস্কার-পুরুষ তাকে এ কারণেই বলা যায় যে, তিনি এমন ফাঁকা মাঠে দৌড়াননি যেখানে তার কোনো শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যখন তিনি ঢাকাই সিনেমার রুপালি পর্দায় নাম লেখান তখন অলরেডি নায়করাজ রাজ্জাকের মতো কিংবদন্তি অভিনেতা সদর্পে শাসন করছিলেন ঢাকাই ইন্ডাস্ট্রি। ছিলেন আরও বাঘা বাঘা স্বনামধন্য অভিনেতা
মাতিয়ার রাফায়েল
  ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
আরও বর্ণিল একুশের গৌরবে আলমগীর

তিনিই বাংলাদেশের সিনে জগতের একমাত্র পুরস্কার-পুরুষ এমন বিশেষণ মূলত তাকেই মানায়। যিনি বাংলাদেশে সিনেমার চিত্রনায়ক হিসেবে আলমগীর নামেই সমধিক পরিচিত। পুরো নাম এম এ আলমগীর। পুরস্কার-পুরুষ তাকে এ কারণেই বলা যায় যে, তিনি এমন ফাঁকা মাঠে দৌড়াননি যেখানে তার কোনো শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যখন তিনি ঢাকাই সিনেমার রুপালি পর্দায় নাম লেখান তখন অলরেডি নায়করাজ রাজ্জাকের মতো কিংবদন্তি অভিনেতা সদর্পে শাসন করছিলেন ঢাকাই ইন্ডাস্ট্রি। যিনি সবেমাত্র ঢাকাই সিনেমায় তার আগের অভিনেতাদের মধ্যে ইনামুল হক, আমিনুল হক (ঢাকাই চলচ্চিত্রের প্রথম নায়কখ্যাত), উত্তমকুমারখ্যাত নায়ক রহমান (আবদুর রহমান), কাফী খান, আজিম যার প্রকৃত নাম নূরুল আজিম খালেদ রউফ, গোলাম মোস্তাফা, খলিলুলস্নাহ খলিল, আহসান আলী সিডনী, ইলিয়াস-জাভেদদের পেছনে ফেলে সামনের দিকে অগ্রসরমাণ এবং সেই সময়েই যার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লড়ছিলেন চলচ্চিত্রের আরেক যুবরাজ ওয়াসিম।

এটি ছিল ওয়াসিমের পোশাকি নাম। প্রকৃত নাম তার মেজবাহউদ্দিন আহমেদ। যদিও আলমগীর এবং ওয়াসিম একই বছর ১৯৭৩ সালে ঢাকাই সিনেমায় পা রাখেন কিন্তু তখন ওয়াসিমই যেন দর্শকপ্রিয়তার দিক থেকে আলমগীরের চেয়ে অনেক এগিয়ে ছিলেন এবং তিনিই ছিলেন তখন নায়করাজ রাজ্জাকের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী। ১৯৭৩ সালে অভিনেতা বুলবুল আহমেদও এফডিসিতে পা রাখেন। অন্যদিকে, তাদের দুই বছর আগে ১৯৭১ সালে ঢাকাই চলচ্চিত্রে পা রাখেন আরেক হিরো ঢাকাই চলচ্চিত্রের 'মিয়া ভাই'খ্যাত আকবর হোসেন পাঠান দুলু, যিনি চিত্রজগতে ফারুক নামেই পরিচিত। ফারুক নামটি তাকে দেওয়া হয়েছিল চলচ্চিত্রের পোশাকি নাম হিসেবে। তিনিও ছিলেন নায়করাজ রাজ্জাকের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী। যেখানে আবার একই সময়ে সিনেমায় পা রাখা আরও একজন অভিনেতাও ফাঁকে নায়করাজ রাজ্জাকের শক্তির পরীক্ষা নিতেছিলেন যিনি চিত্রজগতে 'মেগাস্টার'খ্যাত উজ্জ্বল। অভিনয় করেছিলেন অনেক সামাজিক-প্রণয়ধর্মী সিনেমার পাশাপাশি বেশ কিছু সুপার-ডুপার বাণিজ্যিক সিনেমাতেও।

ছিলেন আরও অনেকেই। তারাও ছিলেন নিজ নিজ নামের ওপর আলোচিত অভিনেতা। তাদের মধ্যে আনোয়ার হোসেন, সোহেল রানা, বুলবুল আহমেদ, জাফর ইকবাল, প্রবীর মিত্র, মাহমুদ কলি, আবুল খায়ের জসিম উদ্দিন চলচ্চিত্রে তিনি জসিম নামেই পরিচিত এবং সর্বশেষ তার কয়েক বছর পর যুক্ত হওয়া ইলিয়াস কাঞ্চন (১৯৭৭)। তবে নায়ক আলমগীরকে এ দেশের দর্শক প্রথম চিনতে শুরু করেন আগে থেকেই দাপটের সঙ্গে অভিনয় করতে থাকা নায়করাজ রাজ্জাক এবং সোহেল রানার সঙ্গে 'জিঞ্জির' (১৯৭৮) ছবিতে কো-আর্টিস্ট হিসেবে অভিনয় করে। এরপর থেকেই তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।

আজকে যেমন নিজ সময়ের নায়কদের প্রায় দশ বছর আগে থেকে চলচ্চিত্রে জায়গা করে নেওয়া শাকিব খান প্রায় ফাঁকা মাঠে দৌড়িয়ে নিজের জায়গা পাকাপোক্ত করেছেন নায়ক আলমীগের ক্ষেত্রে সেরকম কুসুমাস্তীর্ণ মাঠ মোটেও ছিল না। তাকে লড়াই করতে হয়েছে অনেক জায়ান্ট সব অভিনেতাদের সঙ্গে। সেই কঠিন লড়াইয়ের মধ্যে থেকেই তিনি অর্জন করে নিয়েছেন বাংলাদেশ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের সর্বোচ্চ দশটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। একটি আজীবন সম্মাননা এবং ৯টি চলচ্চিত্রের জন্য ৭ বার শ্রেষ্ঠ অভিনেতা ও ২ বার শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব অভিনেতা হিসেবে পুরস্কার।

এই যে একজন নায়ক, তার অভিনয় জীবনের তিন দশকের ক্যারিয়ারে এক বাংলাদেশ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারেই ১০টি পুরস্কার অর্জন করে নিলেন সেই সঙ্গে বাচসাসসহ আরও বহু পুরস্কার আছেই- সে কি পুরস্কার কমিটির জুরি বোর্ড এমনিতেই দিয়ে দিল? ঢাকাই সিনেমার অভিনয়ে মেলোড্রামা দিয়ে রুপালি পর্দা কাঁপিয়েছেন আনোয়ার হোসেন, নায়করাজ রাজ্জাক, উজ্জ্বলসহ অনেকেই কিন্তু নায়ক আলমগীর তার মেলোড্রামা দিয়ে যেভাবে পর্দা কাঁপিয়েছেন, ধরিয়েছেন নারীর হৃদয়ে কাঁপন- সেরকম অভিনয় আর কে দিতে পেরেছেন? পারিবারিক টানাপড়েন, সামাজিক অ্যাকশন, রোমান্টিক অ্যাকশন, ফোক ফ্যান্টাসিসহ সব ধরনের চলচ্চিত্রেই তার এই মেলোড্রামা এ দেশের তরুণ-তরুণীদের মনে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছিল। এমন সাফল্যের স্বীকৃতিরই পরিচয় এতোগুলো জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার।

আর এবার যেটা জুটলো সেটা তো তার সব পুরস্কারেরই গোটা গৌরব, একুশে পদক। যে পুরস্কার ১৯৫২ সালের মহান একুশে'র স্মারক হিসেবে এক অনন্য গৌরবের সাক্ষী হয়ে আছে। সেই তারই সাক্ষী হলেন এবার নায়ক আলমগীরও। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বেসমারিক পুরস্কারের মধ্যে যেটি দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। কাগজে-কলমে এটা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ হলেও এটা বাঙালির মানসিকতা জাগরণের তাৎপর্য বিচারে এটিই হতে পারে সর্বোচ্চ পুরস্কার। যা বাঙালির পরবর্তী সব ইতিহাসের পূর্বসূরি হিসেবে জনক হয়ে থাকবে যুগ যুগ।

এফডিসিতে পা রাখার শুরুর দিকে নায়করাজ রাজ্জাকসহ অন্যান্যের দাপটে তেমন সুবিধা না করতে পারলেও একপর্যায়ে যখন রাজ্জাকের বয়স বাড়তে থাকে এবং নায়ক হিসেবে দর্শক চাহিদাসম্পন্ন দিতে ব্যর্থ হলে তার সেই জায়গাটি দখল নিতে অন্যেরা সফল না হলেও নায়ক আলমগীর বিস্ময়করভাবে তার সফলতা দেখান। নায়ক আলমগীর ১৯৮৫ সালে যখন তার 'মা ও ছেলে' সিনেমায় 'দীপক চৌধুরী' চরিত্রে সর্বপ্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন তখন নায়করাজ রাজ্জাকের বয়স ৪৪। অর্থাৎ নায়ক হিসেবে তিনি তখন পড়তির দিকে।

নায়করাজ রাজ্জাক যেমন তার মেলোড্রামা দিয়ে দর্শকপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন আলমগীরও তেমন তার মেলোড্রামা দিয়ে দ্রম্নত দর্শকের প্রিয় হয়ে উঠেন। শুধু মেলোড্রামাই নয়, তার ওই মেলোড্রামাটিক অভিনয়ের সঙ্গে যেন তার চকচকে চোখের ভাষাটিও যেন দারুণ মূর্ত হয়ে উঠতো এমন অভিনয়ের সময়ে। এটাই তাকে নায়করাজ রাজ্জাক থেকে অনেকটা এগিয়ে রাখে এবং বিশিষ্টতা অর্জনে সহায়ক হয়ে ওঠে। একপর্যায়ে দেখা যায়, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার নিজের ঝুলিতে পূরণের ক্ষেত্রে নায়ক আলমগীরের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন মাত্র দু'জনই। এক তার পূর্বসূরি নায়করাজ রাজ্জাক এবং তার সময়ের বুলবুল আহমেদ।

নায়করাজ রাজ্জাক শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে পাঁচবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং আজীবন সম্মাননাসহ ৬ বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। অন্যদিকে, বুলবুল আহমেদ শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে তিনবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন এবং একবার শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র পরিচালক পুরস্কার হিসেবে মোট চারবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। তবে তাকে চলচ্চিত্রের জন্য আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়নি। যেমন নায়করাজ রাজ্জাককে প্রথম সর্বোচ্চ বেসমারিক পুরস্কার স্বাধীনতা পদক দেওয়া হলেও দেওয়া হয়নি রাষ্ট্রের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পুরস্কার একুশে পদক।

নিজেই এই সাফল্যের মূল্যায়ন করতে গিয়ে তাই নায়ক এম এ আলমগীর বলেন, 'ঢাকাই চলচ্চিত্রের জন্য আরেকটি স্বর্ণযুগ দরকার। তার মানে আমরা আবার সেই সাদা-কালো যুগে ফিরে যাওয়ার কথা বলছি। আমি বলছি, এমন একটি স্বর্ণযুগের- যেটা হবে ডিজিটাল এবং স্মার্ট। শুধু শুধু 'ভাইরাল' হয়ে স্টার হওয়া যায় না। অভিনেতা-অভিনেত্রী হওয়া যায় না। আর অশ্লীল মানেই অশ্লীল, সেটি সিনেমা হলের বড় পর্দায় হোক কিংবা ওটিটি। অশ্লীল কখনো শ্লীল হতে পারে না। অশ্লীলতা দিয়ে কখনো টিকে থাকা যায় না। কারণ অশ্লীলতাকে দর্শক সব সময়ই দূরে ছুড়ে ফেলে দেয়।'

তবে দিনকে দিন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার নিয়ে যেমন বিতর্ক হচ্ছে তেমন পুরস্কার প্রদানের পাত্র বাছাইয়ের ক্ষেত্রেও প্রশ্ন উঠছে। বলা হচ্ছে, এখন অভিনয়ের চেয়ে রাজনৈতিক বিবেচনাকেই মুখ্য হিসেবে ধরে পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে। এমনটি একতরফা চলতে থাকলে হয়ত অদূর ভবিষ্যতে কেউ নায়ক আলমগীরের রেকর্ড ১০ বারের পুরস্কারকে অতিক্রম করতে পারেন কিন্তু তিনি যেসব উচ্চমান সম্পন্ন অভিনেতাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে তিনি যে ১০ বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করে রেকর্ড করেছেন ভবিষ্যতে সেরকম হয়ত আর কখনোই দেখা যাবে না। পুরস্কার অর্জনের সেদিক থেকে বিবেচনা করলে নায়ক আলমগীরকে ঢাকাই ইন্ডাস্ট্রির সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে মূল্যায়ন করা যায়।

নিঃসন্দেহে একুশে পদকের জুরি বোর্ড নায়ক এম এ আলমগীরের এসব হিসাবের চুলচেরা বিশ্লেষণ করেই তাকে এবারের একুশে পদকে ভূষিত করার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকবেন। যা নিঃসন্দেহে জুরি বোর্ডের সুবিবেচনার পরিচায়ক হয়ে থাকবে। যদিও এই পুরস্কারটি তার আরও আগেই পাওয়া উচিত ছিল। এখন হয়ত নায়ক আলমগীর রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পুরস্কার স্বাধীনতা পদক থেকে

বড়জোর একপ্রস্থ দূরেই আছেন। এর বেশি নিশ্চয় নয়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে