গত কয়েক মাস ধরে চীনের কল্যাণে বদলে যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের চিত্র। যার মূল কারিগর সৌদি আরব ও ইরান। এই দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘ দিন ধরে সম্পর্ক ছিল না। অবশেষে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা হয়েছে। দুই দেশের নিজ নিজ দেশে কূটনেতিক মিশনগুলো চালু করা হয়েেছে।
এদিকে সিরায়র সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সম্পর্ক পূর্ণ প্রতিষ্ঠা হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সম্পর্ক নড়েবড়ে হয়ে যাচ্ছে।
সৌদি আরবে এক শিয়া ধর্মীয় নেতার ফাঁসির প্রতিবাদে বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে শত শত লোক ২০১৬ সালের ২ জানুয়ারি তেহরানে সৌদি দূতাবাস ভবনে চড়াও হয়ে ভাঙচুর করে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল। ওই ঘটনায় দু’দেশের ভঙ্গুর সম্পর্ক পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়েছিল।
মঙ্গলবার সাত বছর পর রিয়াদে খুলেছে ইরানের দূতাবাস। ধারণা করা হচ্ছে, খুব দ্রুত তেহরানে খুলছে সৌদি দূতাবাস।
যে দু’দেশের শত্রুতা আর রেষারেষি গত চার দশক ধরে মধ্যপ্রাচ্যকে বিপর্যস্ত করেছে সেই ইরান আর সৌদি আরব মার্চে চীনের মধ্যস্থতায় এক চুক্তি করার পর থেকে যেভাবে দ্রুত ঘনিষ্ঠ হচ্ছে তা নিঃসন্দেহে বিস্মিত হওয়ার মতো।
তেহরান ও রিয়াদের মধ্যে যাত্রীবাহি বিমান চলাচল শুরু হচ্ছে। একজন ইরানি সৌদি আরবে আট লাখ ডলারের কুরআন তেলাওয়াতের এক প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছে। ইরান থেকে সৌদি আরবে ইস্পাত রফতানি শুরু হয়েছে। সুদানে আটকে পড়া ৬০ জন ইরানি নাগরিককে সৌদি নৌ-বাহিনী উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়ার পর ইরান ও সৌদি কর্মকর্তাদের কোলাকুলি করতে দেখা গেছে। এবং ইরানের সরকারি সূত্রগুলো নিশ্চিত করেছে যে খুব শিগগিরই প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির রিয়াদ সফরের কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। এ সফর হলে তা হবে ২০০৭ সালের পর কোনো ইরানি নেতার সৌদি সফর।
এসব উদ্যোগের পেছনে কপটতা দেখেছেন না বিশ্লেষকরা, তবে অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন সৌদি আরব আর ইরানের এ সখ্যতার ভিত্তি কতটা শক্ত? কতদিন তা টিকবে?
এ সন্দেহের মূলে রয়েছে দু’দেশের সম্পর্কে টানাপড়েনের দীর্ঘ ইতিহাস, যা পুরো মধ্যপ্রাচ্যকে কম-বেশি বিপর্যস্ত করেছে। যে টানাপড়েনের মূলে রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে নেতৃত্ব নিয়ে শিয়া ইরান ও সুন্নি সৌদি আরবের অব্যাহত প্রতিদ্বন্দ্বিতা।
কেন সৌদিদের ইরান ভীতি ১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লবের পর থেকে আরব বিশ্বে ইরানের বিরুদ্ধে সন্দেহ বহুগুণে বেড়ে যায়।
বিশেষ করে সৌদি আরব এবং উপসাগরীয় রাজতন্ত্রগুলো ভয় পেয়ে যায় আয়াতোল্লাহ খোমেনি হয়ত এখন তার ধর্মীয় বিপ্লবের রেসিপি আশপাশে রফতানি শুরু করে দিবেন। ফলে, তখন থেকেই ইরান ও প্রতিবেশী সুন্নি আরব দেশগুলোর মধ্যে বৈরিতা আর রেষারেষি নতুন মাত্রা পেতে শুরু করে।
মার্কিন গবেষণা সংস্থা আটলান্টিক কাউন্সিলের সারাহ জাইমি সম্প্রতি তার এক গবেষণা নিবন্ধে লিখেছেন, ১৯৮০-এর দশকে ইরাক-ইরান যুদ্ধ থেকে শুরু করে একে এক লেবানন, ইয়েমেন এবং সবশেষে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধের মূলে রয়েছে সেই রেষারেষি।
ইয়েমেনে ইরান সমর্থিত শিয়া হুতি মিলিশিয়াদের বিদ্রোহ দমনে সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে সৌদি আরব। লেবাননে ইরান সমর্থিত শিয়া মিলিশিয়া হেজবোল্লার প্রভাব খর্ব করতে ওই দেশের সুন্নি গোষ্ঠীগুলোকে টাকা-পয়সা দিয়ে সাহায্য করতে শুরু করে সৌদিরা। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে বাশার আল আসাদ সরকারের সমর্থনে ইরান অস্ত্র আর যোদ্ধা পাঠাতে শুর করলে সৌদিরাও আসাদ বিরোধীদের সাহায্য-সহযোগিতায় নেমে পড়ে।
লন্ডনে মধ্যপ্রাচ্য রাজনীতির বিশ্লেষক সাদি হামদি বিশ্বাস করেন ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে এই বৈরিতা এবং সন্দেহ এতই গভীর যে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপনে একটি বোঝাপড়ায় তা দূর হবে না।
সাদি হামদি বলেন, ‘এটি সাময়িক একটি সন্ধি, সমাধানের কোনো সূচনা নয়। বড় কোনো অগ্রগতি নয়। সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা আগেও একাধিকবার হয়েছে। প্রেসিডেন্ট খাতামি সৌদি আরবে গিয়েছিলেন। প্রেসিডেন্ট আহমেদিনেজাদ গিয়েছিলেন। তখন সম্পর্ক নিয়ে ভালো ভালো কথা হয়েছে, কিন্তু কিছুদিন পর আবার যা তাই।’
কিন্তু কেন এখন এই সন্ধি করতে উদ্যোগী হলো দু’দেশ? হামদি মনে করেন, বিশেষ করে সৌদি আরব চাপে পড়ে কিছুটা বাধ্য হয়েই এই পথে গেছে।
নয় বছর ধরে যুদ্ধের পরও সৌদি আরব ইয়েমেনে তাদের সমর্থিত সরকারকে ক্ষমতায় বসাতে ব্যর্থ হয়েছে। হুতিদের বিদ্রোহ দমনে ব্যর্থ হয়েছে। উপরন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নিজেদের মাটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার শিকার হচ্ছে। সিরিয়াতে বাশার আল আসাদের সরকার উৎখাতের চেষ্টায় কাজ হয়নি।
একই সাথে সৌদি তেলের ওপর আমেরিকার নির্ভরতা কমার সাথে সাথে গত প্রায় দশ বছর ধরে ক্রমাগত দূরত্ব বাড়ছে রিয়াদ ও ওয়াশিংটনের মধ্যে। সৌদিদের তীব্র আপত্তি উপেক্ষা করে ২০১৫ সালে ইরানের সাথে পারমানবিক চুক্তি করেন বারাক ওবামা। ২০১৯ সালে সৌদি আরবের সবচেয়ে বড় তেলের স্থাপনায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পেছনে ইরানের হাত থাকার প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র কিছুই করেনি।
অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতা থেকে কিছুটা বাধ্য হয়েই চিরশত্রু ইরানের সাথে একটি বোঝাপড়ার পথে গেছে সৌদি আরব।
অর্থনীতির প্রয়োজনও সৌদি সিদ্ধান্তের পেছনে কাজ করেছে।
ভিশন-২০৩০ (টুয়েন্টি থার্টি) যুবরাজ মোহামেদ সালমানের এখন ধ্যান-জ্ঞান। কিন্তু তেল নির্ভর অর্থনীতি থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে নেয়া তার ওই উচ্চাভিলাষী উন্নয়ন পরিকল্পনায় গত ছয় বছরে পশ্চিমাদের কাছ থেকে উল্লেখযোগ্য কোনো বিনিয়োগ তিনি পাননি। উপরন্তু ইয়েমেন এবং ইরাক থেকে ইরান-সমর্থিত মিলিশিয়ারা সৌদি আরবের নিরাপত্তা যেভাবে হুমকিতে ফেলেছে তাতে তিনি বাইরে থেকে বিনিয়োগ আনতে পারছেন না।
সাদি হামদি বলেন, ‘বিনিয়োগের জন্য যুবরাজ মোহামেদ অস্থির হয়ে পড়ছেন। কিন্তু তার জন্য তাকে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই হবে। ফলে, সৌদিরা দুর্বল একটি অবস্থান থেকে ইরানের সাথে এই সমঝোতা করছে।’
ইরান কেন আগ্রহী হলো স্পষ্টতই আঞ্চলিক প্রাধান্য বিস্তার নিয়ে রেষারেষিতে গত কয়েকবছরে সৌদিদের অনেকটাই চাপে ফেলতে সক্ষম হয়েছে ইরান। তাহলে তারা এই সমঝোতায় কেন রাজী হলো?
বেশিরভাগ বিশ্লেষকই বলছেন, দেশের ভেতর ক্রমবর্ধমান জনরোষ এবং একই সাথে বছরের পর বছর ধরে কঠোর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে ভঙ্গুর এক অর্থনীতির জেরে ইরানের ইসলামি সরকার প্রচণ্ড চাপে পড়েছে। তাই তারা ভাবছে যে সৌদি আরব ও অন্য উপসাগরীয় দেশগুলোর সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক ওই দুর্দশা লাঘবে সাহায্য করবে।
সাদি হামদি মনে করেন, ইরানের এ সিদ্ধান্তের পেছনে একটি কৌশলগত উদ্দেশ্যও হয়ত রয়েছে।
তিনি বলেন, ‘ইরান মনে করছে যে সৌদিদের সাথে একটি সমঝোতা হলে লেবানন, ইরাক, ইয়েমেন বা সিরিয়ায় তাদের যেসব প্রক্সি (সহযোগী) রয়েছে তাদের ওপর চাপ কিছুটা কমবে এবং ওই সুযোগে তারা তাদের সামরিক ও রাজনৈতিক অর্জন সংহত করার বাড়তি সময় পাবে।’
তার মতে, সৌদি আরব আর ইরানের এ সমঝোতা শুধু কৌশলগত একটি সন্ধি এবং দু’পক্ষের মধ্যে মৌলিক বিরোধগুলো তাতে ঘুচবে না। রাজনৈতিক ও সামরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে তারা সরবে বলে ভরসা নেই। এই বোঝাপড়া মৌলিকভাবে ভঙ্গুর।
গবেষণা সংস্থা কার্নেগী এনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিসের ইরান বিশেষজ্ঞ করিম সাজাদপোর তার এক বিশ্লেষণে লিখেছেন, বৈরি দেশগুলোর পারস্পরিক অবিশ্বাস আর সন্দেহ দূর নাহলে তাদের মধ্যে সমঝোতা যেকোনো সময় বাতিল হতে পারে পারে।
তিনি লেখেন, ‘১৯৯০ সালে অসলো চুক্তি এবং ২০১৫ সালের ইরান পারমাণবিক চুক্তির যে পরিণতি হয়েছে তাতে ওই সমঝোতা চুক্তির ভবিষ্যৎ নিয়েও সন্দেহের উদ্রেক হওয়া খুবই স্বাভাবিক। কারণ, সৌদি আরব এবং ইরানের মধ্যে পারস্পরিক কোনো বিশ্বাস নেই।’
তবে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, বিশ্ব রাজনীতিতে শক্তির ভারসাম্যে যেভাবে রদবদল ঘটছে মধ্যপ্রাচ্যও তার প্রভাব পড়বেই। এ অঞ্চলের অর্থনীতি এবং নিরাপত্তায় আমেরিকার একচ্ছত্র প্রাধান্য দ্রুত কমছে। আর এর পরিণতিতে, আঞ্চলিক শক্তিগুলোও তাদের চিরাচরিত হিসাব-নিকেশ বদলাতে বাধ্য হচ্ছে।
তাছাড়া, সৌদি আরব-ইরানের সমঝোতায় চীনের ঘনিষ্ঠ সংশ্লিষ্টতাও এ সমঝোতাকে টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করবে বলে অনেক মনে করছে।
লন্ডনের দৈনিক গার্ডিয়ানের সাথে এক সাক্ষাৎকারে গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইউরেশিয়া গ্রুপের মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক গবেষণা বিভাগের প্রধান আইহাম কামেল বলেন, সৌদি-ইরান বোঝাপড়ার ফল দেখা যাবে খুবই ধীরে।
তিনি বলেন, ‘রেষারেষির একটি সম্পর্ক রাতারাতি সহযোগিতার সম্পর্ক হয়ে যায় না। আমি মনে করি, ইরান ও উপসাগরীয় আরব দেশগুলোর সংঘাতময় সম্পর্কটি এক ধরণের স্বাভাবিক সম্পর্কে রূপ নিবে যেখানে মতভেদ থাকবে, প্রতিযোগিতা থাকবে এবং একই সাথে সহযোগিতাও হবে।’ সূত্র : বিবিসি
যাযাদি/ এস