সব হারিয়েও ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ যোদ্ধারা দখলদার ইসলাইলী বাহিনীর বিরুদ্ধে তীব্র লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। মরণপণ এই লড়াইয়ে তারা বাড়িঘর, আত্মীয় স্বজন সব হারিয়ে নিঃশ্ব। এখন বেঁচে থাকার জন্য যে প্রয়োজন সেটুকুও মিলছে না। পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস, খাবার সব সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে ইসরাইল। আহত ও নবজাতক শিশুরা বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছে। গত একমাস ধরে অমানবিক নির্যাতনের শিকার ফিলিস্তিনিরা। তবুও হামাস সদস্যরা শেষ পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাবার অঙ্গিকার করেছে। তারা মরতে রাজি তবুও নিজ ভূমি ছাড়তে রাজি নয়।
গাজার উত্তরাঞ্চলে ইসরাইলি বাহিনীর সাথে হামাস যোদ্ধাদের তীব্র লড়াই চলছে। গত কয়েক দিন ধরে ইসরাইলি সেনাবাহিনীর স্থল হামলা জোরদার হওয়ার পর থেকে গাজার উত্তরাঞ্চলে সংঘাতের তীব্রতা বেড়েছে। ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজায় স্থল অভিযানে বিভিন্ন স্থাপনা, হাসপাতালেও চালানো হচ্ছে হামলা। তবে স্থল অভিযানে খুব বেশি অগ্রগতি হয়নি ইসরাইলের। সংঘাতের তীব্রতা সবচেয়ে বেশি উত্তর গাজার শহর গাজা সিটির হাসপাতালগুলোর আশেপাশে। এখন পর্যন্ত গাজায় স্থল অভিযানে গিয়ে ৪৫ সেনা প্রাণ হারিয়েছেন বলে জানিয়েছে ইসরাইল। সোমবার ইসরাইলি সেনাবাহিনী উত্তর গাজায় লড়াইয়ে আরো দুই সেনা নিহত হওয়ার ঘোষণা দিয়েছে।
ইসরাইলি বাহিনী বেশ কিছুদিন ধরেই দাবি করে আসছে এই হাসপাতালগুলোর নিচে হামাসের টানেলের নেটওয়ার্ক রয়েছে এবং এসব হাসপাতালকে কেন্দ্র করেই তারা যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে।
হাসপাতালগুলোর আশেপাশের এলাকায় বেশ কয়েকদিন ধরে তীব্র সংঘাত চলার কারণে কয়েকটি হাসপাতাল কার্যত অচল হয়ে পড়েছে।
গাজার সবচেয়ে বড় হাসপাতাল আল শিফা ‘আর হাসপাতাল হিসেবে কাজ করছে না’ বলে এক বিবৃতিতে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
ইসরাইলি বাহিনীর ক্রমাগত বোমা হামলা ও স্থল আক্রমণ চলতে থাকায় গাজার আরো কয়েকটি হাসপাতালও একই পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছে বলে সতর্ক করেছে সংস্থাটি।
গাজা সিটির আল শিফা হাসপাতালে এতদিন বোমা না ফেললেও হাসপাতালটির ৫০ থেকে ১০০ মিটারের মধ্যে বেশ কয়েকদিন ধরেই বোমা হামলা করে আসছিল ইসরাইলি বাহিনী।
তবে গত কয়েকদিন ধরে ওই হাসপাতালের ভেতরে থাকা স্থাপনায় বোমা হামলা করার পাশাপাশি হাসপাতালের আশেপাশে স্থল হামলার তীব্রতাও বাড়িয়েছে তারা।
রোববার জাতিসঙ্ঘ জানিয়েছে অক্সিজেন প্রস্তুতকারী যন্ত্র, পানির ট্যাংক, ম্যাটার্নিটি ওয়ার্ড ও হৃদরোগ বিভাগসহ হাসপাতালের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা বোমা হামলায় ধ্বংস হয়েছে।
চলমান সংঘাতের মধ্যে রোববার আল ওই হাসপাতালের তিনজন নার্সও মারা গেছেন বলে জানিয়েছে জাতিসঙ্ঘ।
৭ অক্টোবর হামাসের বিরুদ্ধে ইসরাইলি বাহিনীর অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকে ১০১ জন জাতিসঙ্ঘ কর্মী নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে সংস্থাটি।
লেবানন থেকে ইসরাইলে হামলা ইসরায়েলি ডিফেন্স ফোর্সেস আইডিএফ সোমবার সকালে জানিয়েছে লেবানন থেকে ইসরায়েলে দু’টি মর্টার নিক্ষেপ করা হয়েছে। তবে এই হামলায় কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি।
৭ অক্টোবর ইসরাইলি বাহিনীর সাথে হামাসের সংঘাত শুরু হওয়ার পর থেকেই লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হেজবুল্লাহ ও ইসরাইলের সেনাবাহিনীর মধ্যে বিচ্ছিন্ন সংঘাত চলছে।
লেবাননের শক্তিশালী সশস্ত্র সংগঠন হেজবুল্লাহ ইসরাইলের উত্তর দিকের সীমানায় থাকা মিলিটারি পোস্টে বেশ কয়েকবার রকেট ও বোমা হামলা চালিয়েছে।
জবাবে ইসরায়েলের বাহিনীও লেবাননের দিকে বেশ কয়েক দফা রকেট ছুঁড়েছে। গত মাসে ইসরায়েলের হামলায় অন্তত ছয়জন হেজবুল্লাহ সদস্য প্রাণ হারিয়েছেন।
হেজবুল্লাহর রকেট হামলায়ও এর মধ্যে বেশ কয়েকজন ইসরাইলি সেনা আহত ও নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
হেজবুল্লাহর শীর্ষ নেতারা বেশ কিছুদিন ধরেই সতর্ক করে আসছেন যে গাজায় বেসামরিক নাগরিকদের ওপর হামলা বন্ধ না হলে পুরো মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ ছড়িয়ে যেতে পারে। তবে যুদ্ধের হুমকি দিয়ে আসলেও এখন পর্যন্ত ইসরাইলের সীমান্ত অঞ্চলেই হামলা জারি রেখেছে হেজবুল্লাহ।
যুদ্ধবিরতির আহ্বান ইউরোপীয় ইউনিয়নের গাজার ভেতরে থাকা হাসপাতালগুলো যেন রোগীদের চিকিৎসা দেয়া চালিয়ে যেতে পারে তা নিশ্চিত করতে গাজায় ‘অর্থপূর্ণ’ যুদ্ধবিরতি দেয়ার আহ্বান জানিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন।
ইউরোপিয়ান কমিশন ফর ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্টের কর্মকর্তা ইয়ানেজ লেনারচিচ সোমবার ব্রাসেলসে এক বৈঠকে মন্তব্য করেন যে জ্বালানির অভাবে গাজা উপত্যকার অর্ধেকেরও বেশি হাসপাতাল কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে।
৭ অক্টোবরের পর থেকে গাজায় নতুন করে জ্বালানি প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি।
গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্র জানায়, গাজায় প্রতিদিন চার ঘণ্টার জন্য হামলা চালানো থেকে বিরত থাকতে সম্মত হয়েছে ইসরাইল। কিন্তু ইউরোপীয় কমিশন বলছে ‘কার্যকর’ যুদ্ধবিরতি না হলে গাজার বাসিন্দাদের দুর্ভোগ লাঘব সম্ভব হবে না।
লেনারচিচ বলেন, ‘প্রথমত, যুদ্ধবিরতির সময় আগে থেকে ঘোষণা করতে হবে যেন সব প্রতিষ্ঠান আগে থেকে পরিকল্পনা করে তাদের কার্যক্রম চালাতে পারে। দ্বিতীয়ত, যুদ্ধবিরতির সময়ের সুনির্দিষ্ট হিসেব থাকতে হবে।’
ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৭টি দেশ রোববার এক বিবৃতি প্রকাশ করে গাজায় যুদ্ধের ‘অতি স্বত্ত্বর মানবিক বিরতি’ দেয়ার আহ্বান জানায়।
পাশাপাশি গাজার বাসিন্দাদের ‘মানব ঢাল’ হিসেবে ব্যবহার করার জন্য হামাসের প্রতি নিন্দাও প্রকাশ করা হয় ওই বিবৃতিতে।
ইসরাইলের বিবৃতি
ইসরাইলি সেনাবাহিনী এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, সোমবার গাজার উত্তরাঞ্চলে যুদ্ধ চলাকালীন সময় দু’জন ইসরাইলি সেনা সদস্য মারা গেছেন।ইসরাইলের গণমাধ্যমের হিসেব অনুযায়ী, ৭ অক্টোবর হামাসের সাথে সংঘাত শুরু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত মোট ৪৫জন ইসরাইলি সেনা সদস্য নিহত হয়েছেন।
ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ৭ অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত ৩৬৩ সেনা, ৫৯ জন পুলিশ এবং ১০ জন শিন বেটের সদস্যকে হারিয়েছে ইসরাইল। এর আগে শুক্রবার হামাসের টানেলে পাতা ফাঁদে পা দিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন চার ইসরাইলি সেনা। এছাড়া গোলাগুলোতে আরো এক ইসরাইলি সেনার মৃত্যু হয়।
ইসরাইলি ইনেট নিউজ ওয়েবসাইট একটি সামরিক বিবৃতির বরাত দিয়ে জানিয়েছে, উত্তর গাজার বেইত হানুনে একটি বুবি-ফাঁদ টানেলে চার সেনা এবং আরেকজন উত্তরে যুদ্ধে নিহত হয়েছেন। বুবি-ফাঁদ হলো এমন একটি ডিভাইস বা সেটআপ, যা মানুষ বা অন্য প্রাণীকে হত্যা, ক্ষতি বা অবাক করার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়। এটি শিকারের উপস্থিতি বা ক্রিয়া দ্বারা ট্রিগার হয় এবং কখনো কখনো শিকারকে এর দিকে প্রলুব্ধ করার জন্য কিছু টোপ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। গাজাজুড়ে বিভিন্ন এলাকায় ফিলিস্তিনি প্রতিরোধী গোষ্ঠীগুলোর কাছ থেকে প্রচণ্ড যুদ্ধের মুখোমুখি হচ্ছে ইসরাইলি সেনাবাহিনী।
আইডিএফ জানিয়েছে, হামাসের বিরুদ্ধে তাদের অভিযান শুরু হওয়ার পর এ পর্যন্ত ৪ হাজার ৩০০ রকেট নিক্ষেপ করা হয়েছে গাজায়। সূত্র : বিবিসি, আনাদোলু এজেন্সি
যাযাদি/ এস