ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র হিসেবে ইশরাক হোসেনের শপথের দাবিতে রাজধানীর মৎস্য ভবন মোড় অবরোধ করে আন্দোলন করছেন ইশরাকপন্থি নেতাকর্মীরা। ফলে বন্ধ হয়ে যায় যান চলাচল। স্থবির হয়ে পড়ে রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র শাহবাগ ও মৎসভবন থেকে চলাচলকারী রাজধানীর অন্যান্য সড়ক। এতে নগরীর কর্মমুখী ও গন্তব্যগামী সাধারণ মানুষকে দিনভর চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে।
আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রগুলো জানায়, ২০২৪ সালের আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর, গত ৯ মাসে, দেশে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক ইস্যুতে কয়েকশ’ আন্দোলন ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালিত হয়েছে। এরমধ্যে অর্ধশতাধিক উল্লেখযোগ্য আন্দোলন ও বিক্ষোভ কর্মসূচিতে নগরজীবন স্থবির হয়ে পড়ে।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক ও নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, এক সময়ের কর্মব্যস্ত, জীবন্ত এবং সাংস্কৃতিক প্রাণকেন্দ্র ঢাকা- এখন আন্দোলনের নগরীতে রূপ নিয়েছে। সরকারের পতনের পর গত ৯ মাসে একের পর এক আন্দোলন, বিক্ষোভ ও প্রতিরোধের কর্মসূচিতে রাজধানীর রাজপথ যেন ক্রমাগত উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে।
শুধু একটি রাজনৈতিক দলের আন্দোলন নয়- এই সময়কালে রাস্তায় নেমেছে শিক্ষার্থী, শ্রমিক, শিক্ষক, সংখ্যালঘু, পরিবেশবাদী, এমনকি ক্ষুব্ধ নাগরিকরাও। প্রতিটি দিন যেন কোনো না কোনো দাবির ঝড় নিয়ে শুরু হচ্ছে।
বিশেষ করে রাজধানীর শাহবাগ, পল্টন, মতিঝিল, প্রেসক্লাব, নীলক্ষেত কিংবা গুলিস্তানসহ প্রায় প্রতিটি কেন্দ্রীয় মোড়েই প্রতিদিন জড়ো হচ্ছে হাজার হাজার বিক্ষুব্ধ মানুষ। কখনো চাকরির কোটা সংস্কার দাবিতে, কখনো ন্যায্য মজুরি ও শ্রমিক অধিকার নিশ্চিত করার দাবিতে, আবার কখনো সংখ্যালঘু নিপীড়নের প্রতিবাদে।
বুয়েটের শিক্ষার্থী এম আব্দুল্লাহ বলেন, ‘ঢাকায় এখন আন্দোলন ছাড়া কিছুই চোখে পড়ে না। গণপরিবহন বন্ধ, রাস্তা বন্ধ, আর সবখানে পুলিশি টহল। মনে হয় আমরা যুদ্ধক্ষেত্রে বাস করছি।’
এদিকে দৈনিক কর্মসূচি ঠেকাতে গিয়ে নাজেহাল অবস্থায় পড়ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। পুলিশ প্রশাসন থেকে শুরু করে র্যাব ও বিজিবি- সকলেই টানা মাঠে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘রাজধানীতে এখন দিনে গড়ে ৪ থেকে ৫টি বড় সমাবেশ বা মিছিল হয়। আমাদের পক্ষে সবকিছু সামলানো দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে।’সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও নেতৃত্বের সংকট সৃষ্টি হচ্ছে। বর্তমান সরকার অন্তর্বর্তীকালীন হলেও, রাজনৈতিক দলগুলোর দাবির পালে হাওয়া লেগেছে আরও জোরালোভাবে। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ পুনরায় সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছে। অন্যদিকে জাতীয়তাবাদী শক্তি, বাম গণতান্ত্রিক জোট এবং ছাত্র ও শ্রমিক ফ্রন্ট নিজের মতো করে আন্দোলনের ঝাঁপ খুলেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. সাদিক হোসেন বলেন, ‘এই মুহূর্তে ঢাকা হচ্ছে বাংলাদেশের প্রতীকী কেন্দ্র। যার দখলে ঢাকা, তার দখলে রাজনীতি। তাই সবাই একে কেন্দ্রবিন্দু বানিয়েছে।’এদিকে নিত্যদিনের অবরোধ, রাস্তাজুড়ে আন্দোলন, বিক্ষোভ মিছিলসহ নানা কর্মসূচীর ফলে চরম ভোগান্তিতে পড়েছে সাধারণ মানুষ। যানজট, নিরাপত্তাহীনতা ও জীবিকার অনিশ্চয়তায় অনেকেই রাজধানী ছেড়ে গ্রামে ফিরে যাওয়ার চিন্তাও করছেন।
নিজামুদ্দিন নামের এক রিকশাচালক বলেন, ‘ভাড়া পাই না, পুলিশ বারবার ঘুরায়, রাস্তায় লাঠিচার্জ হয়- এভাবে আর কতদিন? এমনি চলতে থাকলে গ্রামেই চলে যাওন লাগবো।’
নগরবাসীর মনে এখন একটাই প্রশ্ন ঢাকা কি সহসাই শান্ত হবে? নাকি এ নিয়ে সৃষ্ট নানা অস্থিতায় কর্মব্যস্ত এ নগরীর জীবনযাত্রা পুরোপুরি থমকে যাবে।এদিকে এ নিয়ে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও হতাশ হয়ে পড়েছে। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, তাদের পক্ষে প্রতিটি কর্মসূচি সামলানো কঠিন হয়ে পড়ছে। অনেক পুলিশ সদস্যকে টানা ডিউটি করতে হচ্ছে- যা মানসিক চাপও বাড়াচ্ছে। টানা পরিশ্রমে ক্লান্ত হয়ে পড়া অনেক পুলিশ সদস্য ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। নতুন পুলিশ সদস্যরাও ঢাকায় পোস্টিং নিতে অনাগ্রহ দেখাচ্ছে। আন্দোলন কর্মসূচীতে পুলিশের একটি বড় অংশ বেশিরভাগ সময় এনগেজ থাকায় তারা অপরাধ নিয়ন্ত্রণে রুটিন ওয়ার্ক করতে পারছে না। এমনকি মামলার তদন্তেও ব্যাপক ভাটা পড়েছে। এতে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে বলে মনে করেনও দায়িত্বশীল পুলিশ কর্মকর্তারা।
এদিকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই আন্দোলন সহসা বন্ধ হওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই ক্ষীণ। কেননা এ আন্দোলন কেবল ক্ষোভেরই বহিঃপ্রকাশ নয়, বরং নেতৃত্বের সংকট এবং রাজনৈতিক সমঝোতার ঘাটতিরও প্রতিফলন। ফলে এ পরিস্থিতি দীর্ঘমেয়াদী হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।