শনিবার, ১৮ মে ২০২৪, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

শ্রমিকের রক্ত, শ্রম ও ঘামে গড়া আধুনিক সভ্যতা 

যাযাদি ডেস্ক
  ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৮:২৩
ছবি-সংগৃহিত

'দুনিয়ার মজদুর এক হও' ; কাল মার্কসের 'কমিউনিস্ট ইশতেহার' বইতে শ্রমজীবী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায়, 'সকল দেশের সর্বহারারা, এক হও' স্লোগান থেকে আজকের আধুনিক এ স্লোগান। লেলিনের অত্যন্ত পছন্দের এ স্লোগানটি সোভিয়েত সাম্রাজ্যের প্রত্যেকটি দেশের সেরা নীতিবাক্য ছিল এটি।লন্ডনে মার্ক্সের সমাধিতে 'সকল দেশের শ্রমিকরা এক হও' স্লোগানটি এখনো ক্ষোদিত আছে।

স্লোগানটির উদ্দেশ্য ছিল পৃথিবীর সকল দেশের নিপীড়িত, বঞ্চিত শ্রমিক শ্রেণীকে ঐক্যবদ্ধ করা,অধিকার আদায়ে শ্রমিক ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা করা,পুঁজিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী শ্রেণীকে পরাজিত করে শ্রেণীহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করা।এখনো অনেক সমাজতান্ত্রিক দেশের নীতিবাক্য এটি ।

আসিতেছে শুভদিন,

দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা, শুধিতে হইবে ঋণ!

হাতুড়ি শাবল গাঁইতি চালায়ে ভাঙিল যারা পাহাড়,

পাহাড়-কাটা সে পথের দু’পাশে পড়িয়া যাদের হাড়,

তোমারে সেবিতে হইল যাহারা মজুর, মুটে ও কুলি,

তোমারে বহিতে যারা পবিত্র অঙ্গে লাগাল ধূলি;

জাতীয় কবির লেখা প্রতিটি পঙক্তি কি সভ্যতার প্রকৃত ইতিহাস ও দায়ের কথা বলে না? সভ্যতার পরতে পরতে শ্রমিকের রক্ত, ঘাম, পরিশ্রম লেগে আছে। সভ্যতার বড়বাবুরা শ্রমিকের রক্তের উপর দাঁড়িয়ে সভ্যতার মহান পুরুষ অথবা ধনকুবের হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।কিন্তু সেই রক্ত ও ঘাম ঝরানো অমানুষিক পরিশ্রম করা শ্রমিক অবহেলিত,বঞ্চিত ও সভ্যতার ইতিহাসে অপাঙক্তেয় থেকে গেছে।অথচ শ্রমিকের হাতেই সভ্যতার বুনিয়াদ রচিত হয়েছে।

বাংলাদেশের চলমান তীব্র দাবদাহে অনেকে স্বাচ্ছন্দে ও নিরাপদে কর্মস্থলে কিংবা বাসায় অবস্থান করলেও সে সুযোগ নেই একজন দিনমজুর এবং শ্রমিকের।প্রচন্ড গরমে শাবল,গাইতি দিয়ে কাজ করা নির্মাণ শ্রমিক, মাটিকাটা শ্রমিক, তীব্র কাঠফাটা রোদে কৃষি শ্রমিক কিংবা প্রচন্ড তাপে কাজ করা হোটেল-রেস্টুরেন্ট শ্রমিক, রাজপথের উত্তপ্ত খররৌদ্র তাপে রিক্সা ও যানবাহন শ্রমিক ও শ্রমজীবী মানুষের সে সুযোগ নেই। জীবন-জীবিকা নির্বাহে প্রত্যেককে অবশ্যই কাজে নামতে হয়। তা না হলে তার ঘরে হাঁড়িতে ভাত চড়ে না।

প্রতিবছর ঘটা করে মে দিবস উদযাপিত হয়; এর একটা ভালো দিক হলো শ্রমিকের শ্রম,ঘাম ও রক্তের দামকে শ্রদ্ধা জানিয়ে হলেও বিশ্বব্যাপি দিনটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হয়।সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে মহাসমারোহে র‍্যালি, আলোচনা সভা,উৎসব-আমেজে পালিত হয়।কিন্তু কেউ শ্রমিকের ভাগ্যের পরিবর্তনের কথা বলে না অথবা করেও না যদিও পুঁজিবাদী আধুনিক সভ্যতায় শ্রমিকের অধিকার নিয়ে সফল হওয়া অনেকটা উপহাসের মত ব্যাপার।আজীবন শ্রমিককে মানবতর জীবন যাপন করতে হয়।

কিন্তু শ্রমিকের রক্ত ও ঘাম চুষে আঙ্গুল ফুলের কলা গাছ হতে অহরহ দেখি। রাজনীতি, অর্থনীতি যখন পুঁজিবাদের করাল গ্রাসে পড়ে তখন শ্রমিক অধিকার উপেক্ষিত থাকবে এটাই স্বাভাবিক। মধ্যযুগের নির্মম দাসপ্রথা বিলুপ্ত হলেও আধুনিক যুগে তা পরোক্ষভাবে রাষ্ট্র ও সমাজে বিদ্যমান রয়েছে।

শ্রমিক দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য,'জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর কর্মপরিবেশ নিশ্চিতকরণ'। বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে এখনো নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর কর্ম পরিবেশ অনেকটাই অবহেলিত। যদিও ২০১৩ সালে রানা প্লাজা ট্রাজেডি, তাজরীন গার্মেন্টস অগ্নিকাণ্ড সহ অন্যান্য মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় হাজারো শ্রমিকের মর্মান্তিক মৃত্যুর পর সরকার,ACCORD,ALLIANCE ও অন্যান্য স্টেকহোল্ডারদের প্রচেষ্টায় বাংলাদেশের গার্মেন্টস সেক্টরে নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশ মোটামুটি নিশ্চিত হয়েছে।

তদুপরি অন্যান্য খাতে ঝুঁকিপূর্ণ ও অনিরাপদ কর্ম পরিবেশ অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ও মর্মান্তিক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী।অধিকন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে শ্রমিকের নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর কর্মপরিবেশ একবিংশ শতাব্দীর বিরাট চ্যালেঞ্জ।

জলবায়ু পরিবর্তনের গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রভাব হলো ‘হিট স্ট্রেস’। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বছরে দু-তিন মাস অত্যধিক গরম পড়ে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ২০ থেকে ২৫ বছর পর বছরে পাঁচ থেকে সাত মাস অত্যধিক গরম পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।অতিরিক্ত গরমে একজন শ্রমিকের স্বাভাবিক শারীরিক প্রতিক্রিয়া হলো কাজের গতি কমে যাওয়া, যা মজুরি ও উৎপাদনশীলতাকে প্রভাবিত করতে পারে।

ন্যূনতম মজুরি ও আট কর্মঘণ্টার দাবিতে ১৮৮৬ সালে পহেলা মে শিকাগো শহরে শ্রমিক আন্দোলনে ১০-১২ জন শ্রমিক নিহত হন।যার পরিপ্রেক্ষিতে ১৮৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবের শতবর্ষ পূর্তিতে প্যারিসে অনুষ্ঠিত কংগ্রেসে ১৮৯০ সাল থেকে উক্ত দিনে আন্তর্জাতিকভাবে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস পালনের প্রস্তাব করেন রেমন্ড লাভিনে। আর ১৮৯১ সালে প্যারিসেই দ্বিতীয় কংগ্রেসে এই প্রস্তাব আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হয়। স্বীকৃতি পায় মে দিবস।তারপর থেকে পৃথিবীর আশিটির বেশি দেশে দিবসটি আড়ম্বরে উদযাপিত হলেও যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া সহ অনেকগুলো পুঁজিবাদী রাষ্ট্র দিবসটি এখনো উপেক্ষিত।

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর দিবসটি উদযাপনে পশ্চিম ইউরোপে ভাটা পড়লেও পৃথিবীর অনেক দেশে দিবসটি ব্যাপক উৎসাহ ও উদ্দীপনায় পালিত হচ্ছে।

বঙ্গবন্ধুর আমল থেকে এদেশে মে দিবস সরকারি ছুটির দিন হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। দিবসটির প্রধান দাবি এখনও ৮ ঘণ্টা কর্ম দিবসের সুফল পাওয়া যায়নি। নিম্ন মজুরির ফাঁদে এদেশের বিশাল শ্রমশক্তিকে আটকে ফেলা হয়েছে। শ্রমিকরা এখনও বাধ্য হয় ওভার টাইম করতে। কারণ তা না করলে সংসার চালানো অসম্ভব। গার্মেন্টসে দেখা যায়, ওভারটাইম চার ঘন্টা হলেও মজুরি দেয়া হয় এক ঘন্টার। এগুলো শ্রমিকের রক্ত ও ঘামের সাথে নিষ্ঠুর প্রতারণা।

কার্ল মার্ক্স তাঁর ‘উদ্বৃত্ত মুল্যতত্ত্ব’ এ হিসাব করে দেখিয়েছেন, মালিকের মুনাফা বাড়ানোর পথ। শ্রমিকের শ্রম, সময় আর যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ানো। ফলে কর্মঘণ্টা বাড়ছে, বাড়ছে উৎপাদন। আর তাঁর সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বেকারত্ব। প্রতি বছর ২০/২২ লাখ তরুণের মাত্র দুই লাখের মতো কর্মসংস্থান রাষ্ট্র করতে পারে।কাজের খোঁজে পরবাসে পাড়ি দেয় কয়েক লাখ মানুষ। আর বা।কিরা দেশে যেকোনো কাজে থিতু হতে চায়। দেশের সাড়ে ৬ কোটি শ্রমজীবীর প্রায় ৩ কোটি কৃষিখাতে, ৫০ লাখ শ্রমিক গার্মেন্টসে, ৩০ লাখের বেশি নির্মাণ খাতে; ৫০ লাখ পরিবহন খাতে; ১০ লাখের বেশি লোক বিভিন্ন শ্রমে নিয়োজিত বলে জানা যায়।

মে দিবস শুধু পালিত হলেই হবে না। মে দিবসের গুরুত্ব উপলব্ধি করে শ্রমিকের অধিকার, ন্যায্য মজুরি, নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর কর্মপরিবেশ বাস্তবায়ন হোক মে দিবসের উদযাপনের প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।শ্রমিক মুক্তি পাক শোষণ ও শৃঙখল থেকে।

লেখক: সাইফুল ইসলাম (স্বপ্নীল), শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক

যাযাদি/ এম

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
X
Nagad

উপরে