শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

জামায়াতকে নিয়ে বিএনপিতে নতুন করে আলোচনা

যাযাদি ডেস্ক
  ০৩ মার্চ ২০২১, ১৮:২১

দেশের প্রধান বিরোধীদল বিএনপি তাদের অন্যতম মিত্র জামায়াতে ইসলামীর সাথে জোটগত সম্পর্ক রাখবে কিনা- সেই প্রশ্নে দলটিতে নতুন করে আবার আলোচনা শুরু হয়েছে বলে দলটির একাধিক সূত্রে জানা গেছে।

প্রায় ছয় বছর ধরে জামায়াতের সাথে দূরত্ব রেখে বিএনপি বিভিন্ন ইস্যুতে রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়েছে এবং তা পালন করছে। অন্যদিকে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটে জামায়াত রয়েছে।

বিএনপি নেতাদের অনেকে জানিয়েছেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উদযাপনের নানা কর্মসূচি নিয়ে বিএনপি যখন মাঠে নেমেছে, তখন দলটিতে জামায়াতের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার আলোচনা জোরালো হয়েছে।

তারা বলছেন, এখন আন্তর্জাতিক এবং দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কোন কৌশল না খাটিয়ে জামায়তের সাথে সম্পর্ক নিয়ে বিএনপির অবস্থান স্পষ্ট করা জরুরি হয়ে পড়েছে। দলের ভেতর এমন চাপ তৈরি হয়েছে বলে জানা যাচ্ছে।

তবে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, জামায়াতের সাথে সম্পর্কের ব্যাপারে তাদের দলে আলোচনা চলছে। যদিও তারা এখনও কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি।

শেষ পর্যন্ত বিএনপির নেতৃত্ব জামায়াতের সঙ্গ ছাড়তে পারবে কিনা-দলটির ভেতরে সেই প্রশ্নও রয়েছে।

আলোচনা এখন বিএনপির সর্বোচ্চ ফোরামে

জামায়াতে ইসলামীর সাথে জোটগত সম্পর্ক রাখা না রাখার প্রশ্নকে প্রথমবারের মতো আলোচ্যসূচি হিসাবে নিয়ে আলোচনা চালানো হচ্ছে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটিতে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্য বলেন, তাদের নীতি নির্ধারণী ফোরামে বিষয়টি আলোচনায় আসে গত বছরের শেষ দিকে। মাঝে সেই আলোচনায় কিছুদিন বিরতি ছিল এবং এখন আবার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে।

তারা জানান, দীর্ঘদিন ধরে আলোচনায় তাদের স্থায়ী কমিটির বেশির ভাগ সদস্যই জামায়াতের সাথে তাদের দলের জোটগত সম্পর্ক ছিন্ন করার পক্ষে মত দিয়েছেন। শুধু দু'জন সদস্য মত দিয়েছেন জামায়াতের সাথে সম্পর্ক বহাল রাখার পক্ষে। আর দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এখনও এ ব্যাপারে তার মত দেননি।

তারা আরও বলেছেন, স্থায়ী কমিটি সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে বিষয়টিতে সিদ্ধান্ত নিতে পারে, তাদের দলের নেত্রী খালেদা জিয়ার কাছ থেকে তারা এমন ইঙ্গিত পেয়েছেন।

দু'টি মামলায় সাজা হলেও আওয়ামী লীগ সরকারের নির্বাহী আদেশে শর্ত সাপেক্ষে জেল থেকে মুক্তি নিয়ে ঢাকায় গুলশানের বাসভবনে অবস্থান করছেন খালেদা জিয়া। তিনি দলীয় বা রাজনৈতিক কোন কর্মকাণ্ডে অংশ নিচ্ছেন না।

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে অংশ নিয়ে থাকেন।

দলটির স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্য বলেন, স্থায়ী কমিটিতে আলোচনায় এখন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তার মত দেয়ার পর তারেক রহমান তার সিদ্ধান্ত দেবেন।

তবে শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য শেষ পর্যায়ে তাদের খালেদা জিয়ার কাছেই যেতে হতে পারে বলে তারা মনে করেন।

কী বলছেন বিএনপি মহাসচিব

জামায়াত ২০ দলীয় জোটে থাকলেও অনেক দিন ধরে তাদের সাথে দূরত্ব রেখে বিএনপির কর্মসূচি নেয়ার বিষয় তুলে ধরেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

তবে তিনি বলেন, সম্পর্ক রাখা না রাখার প্রশ্নে তারা এখনও সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে পারেননি।

‘২০১৫ সালের পর থেকেই কিছু কর্মসূচির ক্ষেত্রে তাদের (জামায়াতে ইসলামী) সাথে আমাদের (বিএনপি)একটা দূরত্ব থেকে গেছে। সেটা আছেই এখনও, সেটা এখনও যায়নি। যদিও আমাদের ২০ দলীয় জোট এখনও অক্ষুণ্ন আছে। এ বিষয়গুলো নিয়ে অবশ্যই আলাপ আলোচনা চলছে। কিন্তু কোন সিদ্ধান্ত হয়নি।’

কিন্তু কর্মসূচি নেয়ার ক্ষেত্রে জামায়াতকে সাথে না রাখা এবং একইসাথে জামায়াতকে জোটে বহাল রাখা- এটা বিএনপির কৌশল কিনা, এই প্রশ্নে কৌশলেই জবাব দেন মি: আলমগীর।

‘কৌশলতো বিভিন্ন রকম থাকে। কিন্তু এ বিষয়টা আমরা এখন আলোচনা করছি। আমাদের মধ্যে আলোচনা হচ্ছে। এখনও আমরা কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে পারি নাই।’

বিএনপি-জামায়াত সম্পর্কে টানাপোড়েন

বিএনপি নেতাদের অনেকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ২০০৭ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া যখন গ্রেপ্তার হন, সে সময় জামায়াত কোন প্রতিক্রিয়া দেখায়নি বা কোন প্রতিবাদ করেনি।

সেই বিষয়কে কেন্দ্র করে তখন থেকেই বিএনপির তৃণমূলে জামায়াত নিয়ে একটা বিরূপ মনোভাব তৈরি হতে থাকে।

দলটির নেতারা আরও বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে বিএনপি যে বিপর্যস্ত অবস্থায় পড়েছিল, সেই থেকে লম্বা সময় ধরে দলটির সব পর্যায়ের নেতা কর্মীদের মধ্যে হতাশা ছিল। এমন পরিস্থিতিতে জামায়াতকে বিএনপি সেভাবে পাশে পায়নি। বরং জামায়তের অনেক কর্মকাণ্ডের দায় বিএনপিকে বহন করতে হয়েছে বলে তারা মনে করেন।

বিএনপি নেতাদের অনেকে বলেছেন, ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারি নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়ে তাদের ২০ দলীয় জোট ব্যর্থ হয়। কিন্তু সে সময় এবং পরের বছর ২০১৫ সালের জানুয়ারিতেও সারাদেশে তাদের কর্মসূচি যে সহিংস রূপ নিয়েছিল, দেশে এবং বিদেশে, তার পুরো দায় বিএনপির ওপরই এসেছে।

ফলে সেই ২০১৫ সাল থেকেই মাঠ পর্যায়ে জামায়াতের সাথে বিএনপির নেতা কর্মীদের সম্পর্কের টানাপোড়েন চরমে পৌঁছায়।

বিএনপির নেতৃত্বও দলের হতাশা কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য জামায়াতকে বাদ দিয়ে নিজেরা দলীয়ভাবে কর্মকাণ্ড চালাতে শুরু করে।

দলটির একাধিক নেতা জানান, জেলা- উপজেলা পর্যায়ে বা তৃণমূল স্তরে বিএনপির নেতা কর্মীদের এখনও জামায়াতের সাথে কোন যোগাযোগ বা সম্পর্ক নেই। তবে বিএনপির নেতৃত্বাধীন পেশাজীবী সংগঠনগুলোতে এখনও জামায়াতের প্রভাব রয়েছে বলে তারা মনে করেন।

তবে বিএনপির তৃণমূল থেকেই জামায়াতের সঙ্গ ছাড়ার জন্য দলটির নেতৃত্বের ওপর চাপ তৈরি করা হয়েছে।

দলটির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য জানান, ২০১৮ সালে ৩০শে ডিসেম্বরের নির্বাচনের আগে বিএনপি নেতৃত্ব সারাদেশের নেতা কর্মীদের মতামত নিয়েছিল। সে সময় সারাদেশ থেকেই তাদের তৃণমূল স্তরের নেতাকর্মীরা জামায়াতের সঙ্গ ছাড়ার সুপারিশ করেছিলেন।

সেই প্রেক্ষাপটে ২০ দলীয় জোটের বাইরে বিএনপি ড: কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নামের আলাদা একটি জোট গঠন করেছিল।

যদিও শেষপর্যন্ত নিবন্ধন না থাকার কারণে জামায়াতের প্রার্থীরা বিএনপির ধানের শীষ প্রতীক নিয়েই সেই নির্বাচনে অংশ নেয়।

সঙ্গ ছাড়ার আলোচনার প্রেক্ষাপট

২০১৮ সালের ৩০শে ডিসেম্বরের প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ টানা তৃতীয় দফায় সরকার গঠন করে।

সেসময় বিএনপির সেই জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নামের জোটের ব্যর্থতার প্রশ্ন ওঠে।

সেই প্রেক্ষাপটে বিএনপিতে হতাশা বেড়ে যায়।

বিএনপি নেতারা বলেছেন, হতাশা এবং বিপর্যস্ত পরিস্থিতি কাটিয়ে তাদের দল সামনে কীভাবে এগুতে পারে, সে ব্যাপারে সুপারিশ বা প্রস্তাব তৈরির জন্য স্থায়ী কমিটির একজন সদস্যকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। তিনি গত বছরের প্রতিবেদন দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে পেশ করেন।

সেই প্রতিবেদনে জামায়াতের সাথে জোটগত সম্পর্ক না রাখার প্রস্তাব করে তার স্বপক্ষে কারণ এবং যুক্তিও তুলে ধরা হয়।

আর এই প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করেই জামায়াত ইস্যুটি আনুষ্ঠানিকভাবে আলোচনায় আসে বিএনপির নীতি নির্ধারণী ফোরামে। এখন সেই আলোচনাই সিদ্ধান্ত নেয়ার পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে।

সঙ্গ ছাড়ার পক্ষে যুক্তি

বিএনপি নীতি নির্ধারকদের মধ্যে যারা জামায়াতের সঙ্গ ছাড়ার পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন, তারা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনোভাবকে বড় বিষয় হিসাবে দেখছেন বলে মনে হয়েছে।

দলটির এমন একজন নেতা জানিয়েছেন, সেই ২০১৪ সাল থেকেই তারা যখন ঢাকায় পশ্চিমা দেশগুলোর কূটনীতিকদের সাথে কথা বলতে গেছেন, তখন জামায়াতের সাথে জোটের ব্যাপারে নেতিবাচক মনোভাব তারা উপলব্ধি করেছেন। ফলে এই বিষয়টিকে তারা গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন।

জামায়াতসহ কয়েকটি দলকে নিয়ে বিএনপি চার দলীয় জোট গঠন করেছিল সেই ১৯৯৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের প্রথম দফার সরকারের সময়ে। সেই জোটই পরে ২০ দলীয় জোটে রূপ পেয়েছে।

বিএনপির নেতারা বলেছেন, বিএনপি যখন জামায়াতকে নিয়ে জোট গঠন করেছিল, তখন ধর্মভিত্তিক দলগুলোর ওপর একটা প্রভাব তৈরির টার্গেট তাদের ছিল।

তারা আরও বলেছেন, সে সময় ধর্মভিত্তিক দলগুলোর ওপর জামায়াতের প্রভাব ছিল। এই চিন্তা থেকে জামায়াতকে সাথে রাখার জন্য বিএনপিরই জোর চেষ্টা ছিল।

কিন্তু পরে কওমী মাদ্রাসা ভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের উত্থানের প্রেক্ষাপটে ধর্মভিত্তিক দলগুলোর রাজনীতিতেও অনেক মেরুকরণ হয়েছে। সেখানে একক কোন ইসলামপন্থী দলের প্রভাব কমেছে বলেও বিএনপি নেতারা মনে করেন।

এছাড়া বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াতের র্শীর্ষ নেতাদের ফাঁসি বা সাজা হয়েছে।

তারা এই বিষয়গুলো এখন বিবেচনায় আনছেন জামায়াতের সাথে সম্পর্ক রাখার প্রশ্নে।

সম্পর্ক রাখার বিপক্ষে যুক্তি

বিএনপি নেতৃত্বের মধ্যে যারা জামায়াতের সাথে সম্পর্ক বহাল রাখতে চাইছেন, তারা ভোটের হিসাব নিকাশকেই এখনও গুরুত্ব দিচ্ছেন।

তাদের একজন বলেন, বিএনপি কেন জামায়াতের সঙ্গ ছাড়ছে না- এসব প্রশ্ন তুলে আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষ থেকেই নানা প্রপাগাণ্ডা বা প্রচারণা চালানো হয় বলে তারা মনে করেন। সেজন্য তারা মনে করেন জামায়াতের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করলে সরকারের ফাঁদেই পা দেয়া হবে।

এটিই তাদের বড় যুক্তি। একইসাথে বিএনপির এই নেতারা মনে করেন, জামায়াতের সাথে বিএনপির সম্পর্ক প্রায় দুই যুগের। ফলে ভোটের রাজনীতিতে এই সম্পর্কের প্রয়োজন আছে।

বিএনপি নেতারা এটাও বলেছেন, আলোচনার পক্ষে বা বিপক্ষে যুক্তি যাই আসুক, তারা যে কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে এতদিনের মিত্র জামায়াতের এখনকার নেতৃত্বের সাথেও আলোচনা করতে চান।

তারা মনে করেন, এবার যেহেতু নীতি নির্ধারকরা আনুষ্ঠানিকভাবে আলোচনা করছেন, ফলে তাদের একটা পরিস্কার অবস্থান তুলে ধরতে হবে।

তবে এই আলোচনার সমাপ্তি কবে হতে পারে বা কখন কোন সিদ্ধান্ত আসতে পারে- সে ব্যাপারে বিএনপি নেতৃত্ব সুনির্দিষ্টভাবে কোন সময়ের কথা উল্লেখ করছে না। বিবিসি বাংলা

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে