আজকের যায়যায়দিন

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে ওই বছরের ৩০ জানুয়ারি অ্যাডলফ হিটলার রাইখস্ট্যাগে ভাষণ দিতে গিয়ে ইউরোপীয় ইহুদিদের 'নির্মূল' করার ডাক দিয়েছিলেন। তবে ইহুদিদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক বক্তব্য অথবা বিদ্বেষমূলক অপরাধের জনক হিটলার ছিলেন না। শত শত বছর ধরে ইহুদিরা জার্মানিতে বিদ্বেষের শিকার হয়েছে। হিটলার ছিলেন সময়ের ফসল। শত শত ইহুদির মারণযজ্ঞ চালানোর জন্য হিটলার পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বকালেই কলঙ্কিত হয়ে থাকবেন।

২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে দেশটির বাসিন্দা মুসলমান ও খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের মানুষ বিদ্বেষমূলক অপরাধের শিকার। এছাড়াও তাদের উদ্দেশে একই সঙ্গে বিদ্বেষমূলক বক্তব্যও ঢালাওভাবে প্রচার করা হচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়ানো হচ্ছে বিভ্রান্তিকর তথ্য। সব ক্ষেত্রেই অভিযুক্ত হিন্দুত্বের তথাকথিত ধ্বজাধারীরা।

'জেনোসাইড ওয়াচ' নামে একটি সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা গ্রেগরি স্ট্যানটন সম্প্রতি বলেছেন, 'বর্তমানে ভারতের যা পরিস্থিতি এবং ভারতে হিন্দুত্ববাদের যে রমরমা দেখা যাচ্ছে, এর ফলে ভারতীয় নাগরিক মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষের গণহত্যার শিকার হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।'

তবে বিদ্বেষমূলক অপরাধের ঘটনাগুলো মোদির প্রধানমন্ত্রিত্বের আমলে ব্যাপক হারে ঘটছে মুসলমানদের পাশাপাশি খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের মানুষকে লক্ষ্য করেও। 'ইউনাইটেড ক্রিস্টান ফোরাম'র দাবি, ২০২১ সালে ভারতীয় নাগরিক খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের মানুষ মোট ৪৮৬টি ঘটনায় ঘৃণা ও বিদ্বেষের শিকার হয়েছেন।

নিহত ১৮ / ইউক্রেনে দফায় দফায় রুশ ক্ষেপণাস্ত্র হামলা

দিলিস্নভিত্তিক সংস্থা 'অ্যাক্ট নাউ ফর হারমনি অ্যান্ড ডেমোক্রেসি'র তরফেও অভিযোগ করা হয়েছে, ভারতে লাগাতার মুসলমান ও খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের মানুষকে উদ্দেশ্য করে বিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছে। সেই সঙ্গে উত্তরোত্তর বাড়ছে বিদ্বেষমূলক অপরাধের সংখ্যাও। এই ধরনের ৮৭৮টি ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে ২০১৪ সাল থেকে ২০২২ সালের মধ্যে। এর মধ্যে ৫৪ শতাংশ ঘটনা বিদ্বেষমূলক বক্তব্য প্রচারের। আর ৪৬ শতাংশ ঘটনা বিদ্বেষমূলক অপরাধের।

'অ্যাক্ট নাউ ফর হারমনি অ্যান্ড ডেমোক্রেসি'র তরফে আরও জানানো হয়েছে, ভারতীয় নাগরিক মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ ৬১.৬ শতাংশ ক্ষেত্রে বিদ্বেষমূলক বক্তব্যের টার্গেট। খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে মুসলমানদের তুলনায় বিদ্বেষমূলক অপরাধ বেশি সংখ্যায় সংঘটিত হয়েছে। মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ ৩৮.৪ শতাংশ ক্ষেত্রে বিদ্বেষমূলক অপরাধের শিকার। খ্রিষ্টানরা ৯৬ শতাংশ ক্ষেত্রে বিদ্বেষমূলক অপরাধের শিকার। তারই ধারাবাহিকতায় রাজধানী দিলিস্নর জাহাঙ্গীরপুরীর সাম্প্রতিক দাঙ্গার ঘটনা মুসলমান সম্প্রদায়ের ওপর বিদ্বেষমূলক অপরাধের আরেকটি নমুনা সৃষ্টি করেছে।

বিদ্বেষমূলক বক্তব্য ছড়ানো অথবা বিদ্বেষমূলক অপরাধের নির্দিষ্ট ব্যাখ্যা আছে। দেখা গেছে, সচরাচর এই ধরনের ঘটনাগুলো ঘটে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের টার্গেট বানিয়ে। ভারতে মুসলমান, খ্রিষ্টান ছাড়াও দলিত সম্প্রদায়ের মানুষও ব্যাপক হারে বিদ্বেষমূলক অপরাধ ও বক্তব্যের শিকার হচ্ছে। মোদি নেতৃত্বাধীন সরকার কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার পর থেকে ধারাবাহিকভাবে এই ধরনের ঘটনা ঘটে চলেছে। সংখ্যালঘুদের ওপর এ জাতীয় আক্রমণ চালানো ভারতীয় সংবিধানের পরিপন্থি, একথা সর্বজনবিদিত।

তবে কি মোদির প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর ভারতের সামাজিক ভারসাম্য বিষিয়ে যাচ্ছে? কারণ গবেষণায় দেখা গেছে, বিদ্বেষমূলক অপরাধ কিংবা বক্তব্য ছড়ানোর কাজটা তখনই সফল হয়, সমাজে যখন ঘৃণার বাতাবরণ তৈরি হয়।

মোদি ক্ষমতায় আসার পর ২০১৪ সাল থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে সংখ্যালঘুদের ওপর ঘৃণার ঘটনা ৫০০ শতাংশ বেড়েছে। এই তথ্য সর্বভারতীয় সংবাদ মাধ্যমের সমীক্ষায় প্রকাশিত হয়েছে। এরপর চলতি বছরও খোদ রাজধানীতে আক্রান্ত হলেন মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ। গত দুই বছরে রাজধানী দিলিস্নতে এই ধরনের দুটি দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটার পরও যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। উলটে প্রশাসনের চোখেও 'বিপজ্জনক' হয়ে উঠছে সংখ্যালঘুরা।

অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, রাজনৈতিক নেতারা বিদ্বেষমূলক বক্তব্য ছড়ানো এবং অপরাধের ঘটনায় সরাসরি অভিযুক্ত। এরই সাম্প্রতিক একটি উদাহরণ মহারাষ্ট্র নবনির্মাণ সেনার সুপ্রিমো রাজ ঠাকরের প্ররোচনামূলক মন্তব্য। রাজ ঠাকরে হুমকি দিয়েছিলেন, মসজিদ থেকে লাউডস্পিকার অবিলম্বে না খোলা হলে মহারাষ্ট্র নবনির্মাণ সেনা দ্বিগুণ শব্দে মসজিদের বাইরে 'হনুমান চালিশা' বাজাবে।

মহারাষ্ট্রের ঔরঙ্গাবাদে এক জনসভায় রাজ ঠাকরে এই মন্তব্য করায় তার বিরুদ্ধে এফআইআর-ও দায়ের হয়েছে। আসলে বিদ্বেষমূলক অপরাধ অথবা বক্তব্য ছড়ানোর দায়ে রাজের মতো মূল অভিযুক্ত রাজনৈতিক নেতারা গোড়াতেই আক্রমণের রাস্তায় গিয়ে আলোচনার রাস্তা বন্ধ করে দিচ্ছেন।

খ্রিষ্টানদের ওপর সবচেয়ে বেশি বিদ্বেষমূলক অপরাধ এবং বিদ্বেষমূলক বক্তব্য ছড়ানোর ঘটনাগুলো ঘটছে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যেই। এই ধরনের সর্বাধিক সংখ্যক ঘটনা ঘটেছে বিজেপি-শাসিত উত্তরপ্রদেশে।

এদিকে, ভারতের মোট জনসংখ্যার ১৫.৫ শতাংশ মানুষ মুসলমান সম্প্রদায়ের অন্তর্গত। আর মোট জনসংখ্যার দুই দশমিক তিন শতাংশ খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের অন্তর্গত। নানা অজুহাত খাড়া করে মুসলমান এবং খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের ওপর বিদ্বেষের লাগাতার যে বিষবাষ্প ছড়ানো হচ্ছে, শুভবুদ্ধির উদয়ে এর সমাপ্তি কবে হবে সেটাও বলা মুশকিল।

এমনকি, এক সম্প্রদায়ের খাদ্যদ্রব্যও আরেক সম্প্রদায়ের কাছে ঘোরতর আপত্তিকর হয়ে উঠেছে। এছাড়া কখনো লাভ জিহাদ কিংবা ধর্মান্তরণের অপযুক্তি খাড়া করে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ছড়ানো হচ্ছে বিদ্বেষের আবহ। বাড়ছে বিদ্বেষমূলক বক্তব্য ও অপরাধ। তবে প্রকৃত অপরাধীরা অনেক ক্ষেত্রেই পার পেয়ে যাচ্ছে।

খ্রিষ্টান এবং মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষের ওপর বিদ্বেষমূলক অপরাধের ঘটনাগুলো বহু ক্ষেত্রে এই দুই সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুষ্ঠানের সময় ঘটেছে। ইউনাইটেড খ্রিষ্টান ফোরামের অভিযোগ, গত বছরের নভেম্বর থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের মানুষের ওপর শতাধিক হামলা হয়েছে। কেবলমাত্র ডিসেম্বরেই এই ধরনের মোট ৪৮টি হামলার ঘটনা ঘটেছে।

'সব কা সাথ, সব কা বিকাশ'-এর ভারতে ভিন্ন দুই ধর্মের নাগরিকদের ওপর বিদ্বেষ ছড়ানোর ঘটনা যেভাবে ঘটেই চলেছে, কার্যত তা বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের সুপ্রাচীন ভারতীয় ঐতিহ্যেরই অপমান। সংবাদসূত্র : ইনস্ক্রিপ্ট