সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১
ভারতের মধ্যপ্রদেশ

ডাইনোসরের ডিমকে দেবতা ভেবে পূজা!

বংশপরম্পরায় এখানে এই পূজা হয়ে আসছে। দীপাবলির সময়, এখানকার মানুষরা, তাদের জমির একটা অংশে কাঁকর ভৈরব প্রতিষ্ঠা করে সন্তানসম্ভবা গবাদি পশুদের ওই শিলার ওপর দিয়ে লাফ দিয়ে পার হতে বলেন। তাদের বিশ্বাস, এতে সন্তানসম্ভবা পশুর আগত শিশুরা সুস্থ হবে, ফলে মালিকের ভবিষ্যৎও সুরক্ষিত থাকবে। একই সঙ্গে সব ফাঁড়াও কাটবে...
যাযাদি ডেস্ক
  ২৩ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০
ভেস্তা মান্দোলাই-এর সঙ্গে বিএসআইপির ড. শিল্পা পান্ডে

ভারতের মধ্যপ্রদেশের ধার জেলা ঐতিহাসিক পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে বিখ্যাত। ওই জেলারই অন্তর্গত পাড়ল্যা গ্রামের বাসিন্দাদের কুলদেবতা 'কাঁকর ভৈরব'। তারা বংশ পরম্পরায় কাঁকর ভৈরবের পূজা করে আসছেন দীর্ঘকাল ধরে। তাদের বিশ্বাস শিলাকৃতির কাঁকর (যার অর্থ জমির সীমানা) ভৈরব (ঈশ্বর) জমি ও গবাদি পশুর রক্ষা করেন এবং দুর্দশা নির্মূল করেন। কিন্তু ওই ভিল সম্প্রদায়ের অনেকের ধারণাই ছিল না যে, গোলাকৃতি শিলাটি তারা নিজেদের চাষাবাদের জমির সীমানায় রেখে পূজা করছেন, সেটা আসলে ডাইনোসরের ডিমের জীবাশ্ম!

পাড়ল্যার বাসিন্দা ভেস্তা মান্দোলাই বলেন, 'কিছুদিন আগে পর্যন্ত আমরা জানতামই না, ওই শিলা আসলে ডাইনোসরের ডিমের জীবাশ্ম। কত বছর ধরে আমারা কাঁকর ভৈরবের পূজা করে আসছি তার ইয়ত্তা নেই।' তার ভাষায়, 'আশপাশের অঞ্চলের কোথাও কোথাও কাঁকর ভৈরবকে ভিলেট বাবা বলেও পূজা করা হয়। আমাদের গ্রামের ছেলেরা কোথাও থেকে গোলাকৃতি শিলা, যেগুলো অন্যান্য পাথরের থেকে আলাদা- সে রকম কিছু খুঁজে পেলে নিয়ে এসে পূজা করত। কেউ কী আর জানত, ওগুলো আসলে ডাইনোসরের ডিমের জীবাশ্ম?'

কীভাবে জানা গেল?

নর্মদা উপত্যকা অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে খননকার্য হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে ডাইনোসরের 'নেস্টিং সাইট', 'নেস্ট', তাদের ডিমের জীবাশ্ম, হাঙরের দাঁতের জীবাশ্ম আরও অনেক কিছু উদ্ধার করেছেন জীবাশ্ম বিশেষজ্ঞরা। তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন বিশাল ভার্মা, যিনি পেশায় পদার্থবিদ্যার শিক্ষক। এ পর্যন্ত তিনি ২৫৬টি ডাইনোসরের ডিম উদ্ধার করেছেন।

বিশাল ভার্মা ও তার মতো অন্য জীবাশ্ম বিশেষজ্ঞদের নিরলস প্রয়াসের ফলে ওই অঞ্চলের প্রত্নতাত্ত্বিক ও ভূতত্ত্বগত গুরুত্ব সম্পর্কে মানুষ জেনেছে। পাড়ল্যা ও সংলগ্ন অঞ্চল থেকে উদ্ধার করা জীবাশ্ম হতবাক করেছে ভেস্তা-সহ ভিল সম্প্রদায়ের অনেককেই। তারা জেনেছেন, গোলাকার শিলা যাকে বংশ পরম্পরায় পূজা করা হয়, সেটা আসলে টাইট্যানো-স্টর্ক প্রজাতির ডাইনোসরের ডিম!

দিন কয়েক আগে 'বীরবল সাহনি ইনস্টিটিউট অব প্যালিওসায়েন্সস'-এর (বিএসআইপি) বিশেষজ্ঞদের একটি দল ধার জেলা পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল ওই অঞ্চল থেকে উদ্ধার হওয়া ফসিল ও অন্যান্য প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলোর সংরক্ষণ। একইসঙ্গে ইউনেস্কোর কাছে ধার জেলাকে 'গেস্নাবাল জিও পার্ক' হিসেবে চিহ্নিত করার প্রস্তাব পেশ করাও ছিল তাদের লক্ষ্য। সে সময় বি?এসআইপির ওই দলে ছিলেন ওই প্রতিষ্ঠানের পরিচালনত (ডিরেক্টর) ডক্টর মহেশ জি ঠক্কর, ডক্টর শিল্পা পান্ডে, মধ্যপ্রদেশ ইকো টু্যরিজম বোর্ডের সিইও শমিতা রজৌরা, বন দপ্তরের কর্মকর্তাসহ অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তা এবং বিশাল ভার্মা।

শিল্পা পান্ডে বলেন, 'বীরবল সাহনি ইনস্টিটিউট অব প্যালিওসায়েন্সেসের সেন্টার ফর প্রোমশন অব জিও হেরিটেজ অ্যান্ড জিওটু্যরিজম প্যালিওসায়েন্টিস্টের পক্ষে আমরা ধার ও সংলগ্ন অংশে গিয়েছিলাম এই মাসে। এর আগে ২৫৬টি ডাইনোসরের ডিম পাওয়া গেছে, যা নথিভুক্তও করা হয়েছে।' তিনি বলেন, 'মধ্যপ্রদেশের মনাবরের কাছে একাধিক জায়গা আছে, যেমন আখড়, কন্যাপুর ইত্যাদি যেখানে ওই নেস্টিং সাইট পাওয়া গেছে। আমরা জানতে পারি, গত জুন মাসে পর্যন্ত ধার অঞ্চলে ২০টি নতুন নেস্ট-এর খোঁজও মিলেছে।'

তিনি জানিয়েছেন, জীবাশ্ম ও যে নির্দিষ্ট অঞ্চল থেকে সেগুলো পাওয়া গেছে, তার সংরক্ষণের জন্য স্থানীয় মানুষের সহযোগিতা একান্ত প্রয়োজন। সে বিষয়ে আদিবাসীদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে তারা জানতে পারেন, উদ্ধার করা ডাইনোসরের ডিমের জীবাশ্মগুলোকে সেখানকার মানুষ দেবতা 'কাঁকর ভৈরব' হিসেবে পূজা করেন।

ডক্টর শিল্পা পান্ডে বলেন, 'বংশ পরম্পরায় এখানে এই পূজা হয়ে আসছে। দীপাবলির সময়, এখানকার মানুষরা, তাদের জমির একটা অংশে কাঁকর ভৈরব প্রতিষ্ঠা করে সন্তানসম্ভবা গবাদি পশুদের ওই শিলার ওপর দিয়ে লাফ দিয়ে পার হতে বলেন। তাদের বিশ্বাস, এতে সন্তানসম্ভবা পশুর আগত শিশুরা সুস্থ হবে, ফলে মালিকের ভবিষ্যতও সুরক্ষিত থাকবে। একই সঙ্গে সব ফাঁড়াও কাটবে।'

এরপরেই শুরু হয় সেখানকার স্থানীয় মানুষের বোঝানো। তার কথায়, 'যে অঞ্চল থেকে ডাইনোসরের ডিম পাওয়া গেছে, তার শুধুমাত্র প্রত্নতাত্ত্বিক ও ভূতাত্ত্বিক মূল্য রয়েছে, তা কিন্তু নয়। একই সঙ্গে এই সাইটগুলোর ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্বও রয়েছে।'

বিএসআইপির পরিচালক ডক্টর ঠক্কর জানিয়েছেন, কীভাবে পাড়াল্যার অধিবাসীদের সঙ্গে কথা বলে তাদের ওই অঞ্চলের প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্বের কথা বোঝানো হয়েছে। তিনি বলেন, 'নর্মদা ভ্যালি রিজিয়নে এর আগেও অনেক বিশেষজ্ঞ দল কাজ করেছেন। ওই অঞ্চলের প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব রয়েছে। এই যে, টি-রেক্স সম্পর্কে আমরা এত কথা শুনি। কয়েক কোটি বছর আগে নর্মদা ভ্যালিতে কিন্তু মাংসাশী ডাইনোসর ছিল, যাকে রাজাসোরাস নরমাডেন্সিস বলা হয়। সে সম্পর্কে পৃথিবীকে জানানো আমাদের কর্তব্য।'

তিনি বলেন, 'ইউনেস্কো যদি ধার জেলাকে 'গেস্নাবাল জিও পার্ক' হিসেবে চিহ্নিত করার প্রস্তাবে সম্মতি জানায়, তাহলে আমাদের সেই স্বপ্ন পূর্ণ হবে। শুধু তাই নয়, ওই অঞ্চল এবং সেখান থেকে যে জীবাশ্ম পাওয়া গেছে, তা সংরক্ষণ করাও সম্ভব হবে। এবং এর কোনো কিছুই স্থানীয় মানুষের সহযোগিতা ছাড়া সম্ভব নয়।'

একই কথা জানিয়েছেন মধ্যপ্রদেশ ইকো টু্যরিজম বোর্ডের সিইও শমিতা রজৌরা। তার কথায়, 'ওই অঞ্চলকে ঘিরে আমাদের অনেক পরিকল্পনা রয়েছে। এবং তাতে শুধুমাত্র বিশ্ব দরবারে ভারতের খ্যাতিই বাড়বে না, স্থানীয় মানুষের উন্নতিও হবে। পর্যটন শিল্পের উন্নতি হবে, মানুষের কর্মসংস্থানও হবে।'

স্থানীয় মানুষদের বিজ্ঞান বোঝানো

বিশাল ভার্মা ২০০৭ সাল থেকে প্রত্নতাত্ত্বিক কাজ চালিয়ে আসছেন। তার অভিজ্ঞতা বলছে, স্থানীয় মানুষরাও কিন্তু সমান আগ্রহী ছিলেন কাঁকর ভৈরবের প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব বোঝার জন্য। তার ভাষায়, 'গ্রামের মানুষের বোঝানোটা তেমন শক্ত ছিল না। বছর পাঁচেক আগে আমরা প্রথম বুঝতে পারি, স্থানীয় মানুষ যাকে কাঁকর ভৈরব বলে পূজা করেন, সেটা ডাইনোসরের ডিম। আমার সঙ্গে যারা কাজ করছিলেন, সে সময় তাদের অনেকেই পাড়ল্যার। তাদের কিন্তু বুঝিয়ে বলতে কোনো অসুবিধা হয়নি এবং কোনোভাবেই তাদের বিশ্বাসে আঘাত লাগেনি। বরং তারা কৌতূহলী ছিলেন। বিভিন্ন জিনিস জানতে চাইছিলেন।'

ধার জেলায় একটি কাজের সময় পাড়ল্যার বাসিন্দা ভেস্তা মান্দোলাই প্রথম যোগ দিয়েছিলেন বিশাল ভার্মার দলে। ভেস্তা মান্দোলাই বলছেন, 'সে বহু বছর আগের কথা। ওর কাজ দেখে কৌতূহল হতো। কাছাকাছি একটা জাগায় উনি নেস্টিং সাইট খুঁজছিলেন। সে সময় আমিও ওই দলের সঙ্গে কাজ করতে শুরু করি। ধীরে ধীরে অনেক নতুন জিনিস শিখেছি। অনেক ধারণা বদলেছে। যেমন জানতে পেরেছি, কাঁকর ভৈরব হলো ডাইনোসরের ডিমের জীবাশ্ম।' তিনি এখন মধ্যপ্রদেশের বাগে অবস্থিত ডাইনোসর ন্যাশনাল পার্কের সুরক্ষাকর্মী হিসেবে কাজ করেন।

'ডাইনোসর ম্যান'

বিশাল ভার্মার কাজ প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন গবেষণাপত্রে। অনেকেই তাকে 'ফসিল ম্যান' বা 'ডায়ানোসর ম্যান' বলে সম্বোধন করেন। জীবাশ্ম নিয়ে বিশাল ভার্মা যখন প্রথম কাজ শুরু করেন, তখন তিনি তরুণ। বাবার চাকরি সূত্রে তার ছেলেবেলা কেটেছে খনি অঞ্চলে। একদিন বাবার সহকর্মীরা একটি খননের কাজে ব্যস্ত ছিলেন। সে সময় সেখান থেকে শাঁখের টুকরা পাওয়া যায় যার প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব রয়েছে। এরপর তারও আগ্রহ জন্মায় প্রত্নতাত্ত্বিক বিষয়ে। তিনি একাই খুঁজতে শুরু করেন ধার অঞ্চলের বিভিন্ন প্রান্তে। এক সময় তার আলাপ হয় নর্মদা ভ্যালিতে গবেষণার কাজে আসা বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে, যারা ডাইনোসরের জীবাশ্ম খুঁজছিলেন।

ধীরে ধীরে সংগ্রহ করা জীবাশ্মগুলোকে প্রদর্শনের ব্যবস্থা করেন তিনি। উদ্দেশ্য ছিল ছাত্রদের সে বিষয়ে আগ্রহ বাড়ানো। তিনি বলেন, 'হাঙরের দাঁত, শঙ্খ এমন অনেক জিনিস পেয়েছিলাম। এতে আমার আগ্রহ আরও বেড়ে যায়। এরপর আমার স্কুলের ছাত্রদের সামিল করি এই কাজে। আমরা সমবেতভাবে ১০০টা ডাইনোসরের ডিম খুঁজে পাই, যা প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের হাতে তুলে দেওয়া হয়। এরপরের বার যে কয়টি ডাইনোসরের ডিম উদ্ধার হয়, সেটা সরকারকে দিয়ে দেওয়া হয়, যা ডাইনোসর পার্কে সাজানো রয়েছে। এই কাজে স্থানীয় মানুষও আমায় সহযোগিতা করেছেন।'

মধ্যপ্রদেশ সরকারের ওই সংগ্রহশালা তৈরি করতেও তিনি সাহায্য করেছেন। শুধুমাত্র প্রত্নতাত্ত্বিক বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণাই নয়, ওই অঞ্চলের নবীন প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধও করেছেন তিনি। তার সঙ্গে আগে কাজ করেছে এমন ছাত্রছাত্রীরা অকনেকে প্যালিওসায়েন্স নিয়ে পড়াশোনা করেছে। স্থানীয় মানুষদের মধ্যে ওই অঞ্চলের সম্পদকে সংরক্ষণের বিষয়েও প্রচার করেছেন বিশাল ভার্মা। সংবাদসূত্র : বিবিসি নিউজ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে