বুধবার, ০১ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১
কনসু্যলেটে ইসরাইলি হামলা

লোক দেখানো আঘাত করবে ইরান!

মধ্যপ্রাচ্যে বড় ধরনের কোনো যুদ্ধ শুরু হোক সেটি ইরান চায় না। তেহরানের হাতে দুটি বিকল্প আছে। একটি হচ্ছে, আমেরিকার সেনা এবং তাদের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট স্থাপনার ওপর হামলার জন্য ইরান সমর্থিত গ্রম্নপগুলোকে মদদ দিতে পারে। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি জোরদার করে এগিয়ে নেওয়া...
যাযাদি ডেস্ক
  ০৮ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০
সিরিয়ার দামেস্কে ইসরাইলি হামলায় ধ্বংস ইরানি কনসু্যলেট

সিরিয়ার দামেস্কে ইরানের কনসু্যলেটে ইসরাইলি হামলায় ১৩ জন নিহত হওয়ার পর ইরানের জন্য একটি কঠিন সময় যাচ্ছে। একদিকে এই হামলার জবাব দিতে চাইছে দেশটি। অন্যদিকে, ইরান এমন কোনো কাজ করতে চায় না, যার মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়তে পারে।

ইসরাইল ও আমেরিকার কর্মকর্তারা মনে করেন, ইরান পাল্টা আঘাত করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমেরিকার গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে দেশটির সংবাদমাধ্যম 'সিবিএস নিউজ' জানিয়েছে, ইরান ড্রোন এবং ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পরিকল্পনা করছে। তবে কখন এবং কোন জায়গায় এই আঘাত করা হবে, সেটি নিশ্চিত নন আমেরিকার কর্মকর্তারা। এই হামলা এখন থেকে শুরু করে রমজান মাসের শেষ সপ্তাহে যে কোনো সময় হতে পারে বলে ধারণা করছেন কর্মকর্তারা। ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা ইরাক ও সিরিয়ার মাটি থেকে নাকি ইরানের ভেতর থেকে পরিচালনা করা হবে, সেটিও এখনো নিশ্চিত হতে পারেননি মার্কিন গোয়েন্দারা। এদিকে, ইসরাইলও বলেছে, ইরান যদি পাল্টা আঘাত করে, তাহলে তারা আবারও হামলা চালাবে। এর ফলে মধ্যপ্রাচ্যে আরেকটি যুদ্ধের সংকেত বেজে উঠতে পারে।

ইরানের শক্তি আছে?

ইসরাইলের বিরুদ্ধে কোনো কড়া সামরিক জবাব দিতে গেলে সেটি যুদ্ধকে ইরানের দোরগোড়ায় টেনে আনবে। কারণ, ইরানের বিষয়ে ইসরাইলও ছেড়ে কথা বলবে না। অন্যদিকে, ইসরাইলি হামলার যথাযথ জবাব দিতে না পারলে ইরানের সামরিক সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন উঠবে। ফলে ভবিষ্যতে ইসরাইল ইরানকে আরও দুর্বল ভাববে এবং তাদের ওপর চেপে বসবে।

ইরানকে প্রমাণ করতে হবে যে, তারা দুর্বল নয়। যে কোনো হামলার জবাব দেওয়ার ক্ষমতা তাদের রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে বড় ধরনের কোনো যুদ্ধের সূত্রপাত না করে ইরান কীভাবে ইসরাইলকে জবাব দিতে পারে, সেটি নিয়ে এক ধরনের দোদু্যল্যমানতা তৈরি হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, ইসরাইলকে পাল্টা আঘাত করার মতো সামরিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সামর্থ্য ইরানের রয়েছে কিনা?

মধ্যপ্রাচ্য-বিষয়ক বিশ্লেষক ও লেখক আলি সাদরাজদেহ বলেন, ইসরাইলের সঙ্গে সংঘাতে জড়ানোর মতো সামর্থ্য ইরানের নেই। কিন্তু দেশের ভেতরে জনগণকে দেখানোর জন্য হলেও ইরানকে একটি জবাব দিতে হবে। এ ছাড়া নিজেদের মিত্রদের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা টিকিয়ে রাখার জন্যও ইরানকে একটি পদক্ষেপ নিতে হবে।

ইসরাইলের কাছে ইরান যতই অপদস্থ হোক না কেন, এর কড়া জবাব দেওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। এর পরিবর্তে ইরানকে 'কৌশলগত কারণে ধৈর্য্য' ধরতে হবে। কারণ, ইরানের এখন অগ্রাধিকার হচ্ছে পারমাণবিক বোমা তৈরি করা। কিছু ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়ে ১০০ জন ইসরাইলিকে হত্যা করার চেয়ে পারমাণবিক বোমা তৈরির পথে এগিয়ে যাওয়া যুক্তিযুক্ত। এর মাধ্যমে ভবিষ্যতে শুধু ইসরাইল নয়, আমেরিকার হামলা ঠেকাতেও সক্ষম হবে ইরান।

হেজবুলস্নার অবস্থান কী?

গাজায় যুদ্ধ শুরুর পর থেকে সিরিয়া, ইরাক, লেবানন ও ইয়েমেনে ইরান সমর্থিত বিভিন্ন গোষ্ঠী ইসরাইলি স্বার্থে আঘাত হানছে। কিন্তু তাদের সেই তৎপরতাও সীমিত আকারে। এসব গোষ্ঠী ইসরাইলের সঙ্গে পুরোপুরি যুদ্ধে লিপ্ত হতে চায় না। সাদরাজদেহ বলেন, ইরান সমর্থিত গোষ্ঠীগুলোর কাছে ইসরাইলের দূতাবাসে হামলার বিষয়টি চিন্তা করাটা বেশ কঠিন।

হিজবুলস্নাহ হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে সংগঠিত সশস্ত্র গ্রম্নপ। রাষ্ট্রীয় বাহিনী না হয়েও তাদের ২০-৫০ হাজারের মতো যোদ্ধা রয়েছে। তাদের বেশিরভাগই বেশ প্রশিক্ষিত। সিরিয়া যুদ্ধে অংশ নেওয়ার মাধ্যমে যুদ্ধের ময়দানে লড়াই করার অভিজ্ঞতাও তাদের তৈরি হয়েছে। ইরান-সমর্থিত হিজবুলস্নাহর প্রায় এক লাখ ৩০ হাজার রকেট ও মিসাইল রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। এরপরও বিশ্লেষকরা মনে করেন, ইরানের পক্ষ নিয়ে হেজবুলস্নাহ এখন ইসরাইলের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে জড়াবে না।

হিজবুলস্নাহ ইসরাইলের ফাঁদে পা দিতে চায় না। কারণ, তারা ভালো করেই জানে যে, বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং তার যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভা এই যুদ্ধকে বিস্তৃত করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছে। কারণ, নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে এই যুদ্ধ কতদিন চলবে, এর ওপর।

প্রতীকী জবাব দেওয়া

পর্যবেক্ষক সাদরেজাদেহ মনে করেন, ইসরাইলের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে না গিয়ে ইরান একটি প্রতীকী জবাব দেওয়ার উপায় খুঁজছে। কয়েক বছর আগে ইরানের শীর্ষ কমান্ডার কাসেম সোলাইমানিকে ইরাকে হত্যা করার পর ইরানের তরফ থেকে 'কড়া প্রতিশোধের' হুমকি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে সেটি ঘটেনি। সোলাইমানি হত্যার জবাবে ইরান ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছিল ইরাকে অবস্থিত আমেরিকার সামরিক ঘাঁটিতে। কিন্তু সেই হামলায় আমেরিকার কোনো সেনা হতাহত হয়নি। বরং হামলার আগে আমেরিকার সেনাবাহিনীকে ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছিল।

'ভার্জিনিয়া টেক স্কুল অব পাবলিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স'-এর ইউসুফ আজিজি বলেন, ইরানের ভেতর পর্দার অন্তরালে দুটো শক্তির মধ্যে মতভেদ চলছে। একটি পক্ষ চাইছে, ইরান পারমাণবিক শক্তি অর্জন করার মাধ্যমে ইসরাইলি অগ্রাসন রুখে দাঁড়াক। আরেকটি অংশ চায়, ইসরাইলে সরাসরি হামলার মাধ্যমে এর জবাব দেওয়া হোক। এ ক্ষেত্রে ধৈর্য্য ধারণ করে পারমাণবিক লক্ষ্য অর্জন করার বিষয়টি হয়তো অগ্রাধিকার পাবে।

পাল্টা জবাব দিতেই হবে?

মধ্যপ্রাচ্যে বড় ধরনের কোনো যুদ্ধ শুরু হোক, সেটি ইরান চায় না। তেহরানের হাতে দুটি বিকল্প আছে। একটি হচ্ছে, আমেরিকার সেনা এবং তাদের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট স্থাপনার ওপর হামলার জন্য ইরান সমর্থিত গ্রম্নপগুলোকে মদদ দিতে পারে। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি জোরদার করে এগিয়ে নেওয়া। আমেরিকা ও তাদের মিত্ররা তেহরানের পারমাণবিক কর্মসূচির রাশ টেনে ধরতে চাইছে।

বার্তা সংস্থা 'রয়টার্সের' প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আমেরিকার কর্মকর্তারা ইরানের গতিবিধি খুবই সতর্কতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করছেন। ইরান সমর্থিত বিভিন্ন গোষ্ঠী ইরাক এবং সিরিয়ায় অবস্থিত মার্কিন সেনাদের ওপর হামলান সম্ভাবনা আছে কিনা, সেদিকে সতর্ক নজর রাখছে ওয়াশিংটন। তবে সিরিয়া ও ইরাকে আমেরিকার সেনাদের ওপর ইরান-সমর্থিত গ্রম্নপগুলোর হামলার বিষয়ে মার্কিন গোয়েন্দাদের দিক থেকে এখনো পর্যন্ত তথ্য পাওয়া যায়নি। গত শুক্রবার ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ জামশিদি 'এক্স' পস্নাটফর্মে লিখেছেন, নেতানিয়াহু যে ফাঁদ তৈরি করেছে, আমেরিকার নেতারা যাতে নিজেদের সেখানে টেনে না আনে। তিনি লিখেছেন, 'আপনারা দূরে থাকুন, যাতে আঘাত না লাগে।' তিনি দাবি করেন, তার এই বার্তার পর আমেরিকা ইরানকে বলেছে, তারা যাতে আমেরিকার স্থাপনার ওপর আঘাত না করে।

'সিবিএস নিউজ' নিশ্চিত হয়েছে, ইরানের কাছ থেকে আমেরিকা লিখিত বার্তা পেয়েছে। মার্কন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের (স্টেট ডিপার্টমেন্ট) একজন মুখপাত্র সিবিএস নিউজকে জানিয়েছেন, ইরানের চিঠির জবাবে আমেরিকাও পাল্টা হুঁশিয়ারি দিয়ে চিঠির উত্তর দিয়েছে। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর লিখেছে, ইসরাইলের হামলার বিষয়টিকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে আমেরিকার স্বার্থে যাতে কোনো আঘাত না করা হয়।

ইরান একদিকে চাইছে, এমন একটি জবাব দিতে, যাতে ভবিষ্যতে ইসরাইল এ ধরনের হামলা করতে সাহস না পায়। অন্যদিকে, ইরান এটাও চায় না যে, তাদের জবাবের মধ্য দিয়ে যাতে আবার মধ্যপ্রাচ্যে বড় ধরনের কোনো যুদ্ধের সূত্রপাত হয়ে যায়। এ বিষয়টি নিয়ে এক ধরনের দোলাচলে রয়েছে তেহরান।

এই উত্তেজনা তৈরির মাধ্যমে ইসরাইল দেখাতে চেয়েছে যে, ইরান আসলে 'একটি কাগুজে বাঘ'। লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্স-এর আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক অধ্যাপক ফাওয়াজ গের্গস বলেন, 'এক্ষেত্রে ইরান যদি কোনো জবাব না দেয়, তাহলে এটা এমন একটা বার্তা দেবে যে, ইরান শুধু একটি কাগুজে বাঘ, জবাব দেওয়ার কোনো ক্ষমতা তাদের নেই,।

ইরানের সামনে পথ কী?

সে ক্ষেত্রে ইরান হয়তো বিদেশে অবস্থিত ইসরাইলি দূতাবাস এবং বিভিন্ন ইহুদি স্থাপনার ওপর হামলা চালাতে পারে। মার্কিন গবেষণা সংস্থা 'কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্স'-এর মধ্যপ্রাচ্য-বিষয়ক বিশেষজ্ঞ এলিয়ট আব্রামস বলেন, ইরান ইসরাইলের সঙ্গে সর্বাত্মক যুদ্ধে লিপ্ত হতে চায় না বলে তার বিশ্বাস। তবে ইসরাইলের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন জায়গায় তারা হামলা চালাতে পারে।

ইরান আরেকটি উপায়ে জবাব দিতে পারে। সেটি হচ্ছে, তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি তরান্বিত করা। ইউরেনিয়াম আরও সমৃদ্ধ করে সেটিকে পারমাণবিক বোমা তৈরির উপযোগী করে তোলা। অথবা প্রকৃত পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির নকশা পুনরায় শুরু করা। কিন্তু এসব পদক্ষেপ ইরানের জন্য উল্টো ফল বয়ে আনতে পারে বলে পর্যবেক্ষকদের অনেকে মনে করেন। ইরান এসব কাজ করতে গেলে আমেরিকা ও ইসরাইলের হামলাকে আমন্ত্রণ জানানো হবে।

ওয়াশিংটন-ভিত্তিক থিংক ট্যাংক সিএসআইএস-এর মধ্যপ্রাচ্য-বিষয়ক বিশেষজ্ঞ জন অল্টারম্যান মনে করেন, ইসরাইলের দূতাবাসে হামলার মতো পদক্ষেপ ইরান নেবে না। ইসরাইলকে শিক্ষা দেওয়ার ব্যাপারে ইরান ততটা আগ্রহী নয়। বরং ইরান তাদের মিত্রদের দেখাতে চায় যে, তারা দুর্বল নয়। ইরান এখন কোন্‌ পথে হাঁটবে? এ বিষয়টি নির্ভর করছে দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুলস্নাহ আলি খামেনির সিদ্ধান্তের ওপর। তথ্যসূত্র : বিবিসি নিউজ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে