সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

কিডনি প্রতিস্থাপন মহৎ কাজ হিসেবে বিবেচিত

চিকিৎসা সেবাদান অত্যন্ত মানবিক পেশা। কিন্তু অবকাঠামোর অভাব, সংশ্নিষ্টদের অদক্ষতা, দায়িত্ববোধের ঘাটতির পাশাপাশি এমন অব্যবস্থার দায় সরকার এড়াতে পারে না। চিকিৎসা ব্যবস্থায় বিপর্যয় রোধে কঠোর ও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার বিকল্প নেই। কী করে চিকিৎসাকেন্দ্রের নামে এত 'বাণিজ্যকেন্দ্র' গড়ে উঠছে- যা চরম জীবনঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে- এ প্রশ্নের জবাব দেওয়ার দায়ও সংশ্নিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগ এড়াতে পারে না। চিকিৎসাকেন্দ্রে অনুশাসন ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি চিকিৎসায় অবহেলাজনিত কারণে সৃষ্ট বিপর্যয়ের দৃষ্টান্তযোগ্য প্রতিকার নিশ্চিত করতেই হবে।
আর কে চৌধুরী
  ২৭ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

বাংলাদেশে কিডনি রোগে প্রতি বছরই প্রাণ হারায় বিপুলসংখ্যক মানুষ। আমার স্ত্রী শিরীন চৌধুরীর মৃতু্য হয়েছেও এই রোগে। দেশে কিডনি প্রতিস্থাপনের সুযোগ থাকলেও কুসংস্কারের কারণে বিপদাপন্ন রোগীদের জন্য কিডনি পাওয়া যায় না। ব্রেন ডেড রোগীর দেহ থেকে কিডনি রোগীদের দেহে প্রতিস্থাপন করলে প্রতি বছর অসংখ্য জীবন রক্ষা পায়। একটি কিডনি হলেই মানুষ যেহেতু বেঁচে থাকতে পারে সেহেতু দুর্ঘটনা কিংবা অন্য কারণে ব্রেন ডেড হয়ে যাওয়া রোগীর দুটি কিডনি দিয়ে দুজনকে বাঁচানো যায়। এ ধরনের কিডনি প্রতিস্থাপন সম্ভব হয়েছে গত বুধবার।

প্রথমবারের মতো 'ব্রেন ডেড' রোগীর শরীর থেকে নেওয়া দুটি কিডনি দুজনের শরীরে সফলভাবে প্রতিস্থাপন হলো বাংলাদেশে। এতে নেতৃত্ব দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের (বিএসএমএমইউ) রেনাল ট্রান্সপস্নান্ট সার্জন অধ্যাপক হাবিবুর রহমান দুলাল। ২০ বছর বয়সি 'ব্রেন ডেড' নারী সারার শরীর থেকে নেওয়া দুটি কিডনি দুই নারী কিডনি রোগীর শরীরে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে বুধবার রাতে। একটি কিডনি প্রতিস্থাপন বিএসএমএমইউতে হয়েছে, আরেকটি প্রতিস্থাপন করেছে ন্যাশনাল কিডনি ফাউন্ডেশন। বর্তমানে দুজনই ভালো আছেন। জেনেটিক ডিজিজে আক্রান্ত ২০ বছর বয়সি সারা নামের এক রোগীর বিএসএমএমইউতে সার্জারি হয়। তারপর অবস্থার অবনতি হলে তাকে আইসিইউতে রাখা হয়। তিনি যখন ব্রেন ডেডের দিকে যাচ্ছেন তখন তার মাকে কাউন্সিলিং করেন চিকিৎসকরা। তার স্কুল শিক্ষক মা ব্রেন ডেড সারার দুটি কিডনি ও দুটি কর্নিয়া ট্রান্সপস্নান্টের অনুমতি দেন। স্কুল শিক্ষক মা তার কন্যা সারা ইসলামকে হারিয়েছেন জীবনের জন্য। কিন্তু ব্রেন ডেড হয়ে যাওয়া কন্যার দুটি কিডনি প্রতিস্থাপন করে বেঁচে গেল দুটি জীবন। তার দুটি কর্নিয়া দুজন অন্ধ মানুষকে পৃথিবীর আলো দেখার সৌভাগ্য নিশ্চিত করবে। আমরা সারা ইসলামের শিক্ষক মায়ের সিদ্ধান্তকে অভিবাদন জানাই। এ ঘটনা ব্রেন ডেড হওয়া রোগীদের কিডনি দানে স্বজনদের উৎসাহ জোগাবে। যে সিদ্ধান্তের কল্যাণে বেঁচে যাবে অনেক মানুষ। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও যা মহৎ কাজ হিসেবে বিবেচিত হবে।

শরীরকে সুস্থ ও সচল রাখে কিডনি। কিডনি সুস্থ রাখতে খাবার তালিকায় পরিবর্তন আনা জরুরি। কিছু খাবার নিয়মিত খেলে শরীরে এমন কিছু উপাদানের মাত্রা বাড়তে শুরু করে, যা কিডনির কোনো ধরনের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা তো কমায়ই, সেই সঙ্গে কিডনি ফাংশনের এত মাত্রায় উন্নতি ঘটায় যে রোগভোগের আশঙ্কা একেবারে কমে যায়। যেসব খাবার কিডনি ফাংশন বাড়াতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে সেগুলো হলো- দারুচিনি, ক্যানবেরি, অলিভ অয়েল, পেঁয়াজ ও রসুন, চেরি, বাদাম।

এদিকে, দেশের অনেক হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে নৈরাজ্য চলছে। একজন রোগী চিকিৎসকের দ্বারস্থ হন তার রোগযন্ত্রণা থেকে মুক্তির আশায়। কিন্তু চিকিৎসা নিতে গিয়ে যদি ভুল চিকিৎসার কারণে রোগীর জীবনাশঙ্কাই প্রকট হয়ে ওঠে কিংবা মৃতু্যরও কারণ হয়, তাহলে শুধু চিকিৎসকের দক্ষতা কিংবা অবহেলা নিয়েই প্রশ্ন ওঠে না; একই সঙ্গে এ প্রশ্নও দাঁড় করায় যে, শুধু ভুল নয় বরং এমনটি কি অবহেলাজনিত কারণেই সৃষ্ট নয়?

দেশের প্রায় সর্বত্র গজিয়ে উঠেছে প্রাইভেট ক্লিনিক কিংবা হাসপাতাল। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এগুলোতে চিকিৎসার নামে চলছে অপচিকিৎসা ও রমরমা বাণিজ্য। বলার অপেক্ষা রাখে না, মানুষের মৌলিক অধিকারের অন্যতম চিকিৎসাসেবা প্রাপ্তির পথ দেশে যেমন অমসৃণ, তেমনি অনেক ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণও। একই সঙ্গে ব্যয়বহুল। ভুল চিকিৎসার খরচ মেটাতে গিয়ে অনেকেই নিঃস্ব হয়ে গেছেন- এমন নজিরও আছে। অনেকেই হয়ে পড়ছেন পঙ্গু। চিকিৎসকের অবহেলাজনিত কারণে অপ্রীতিকর ঘটনাও এর মধ্যে কম ঘটেনি। চিকিৎসকের অবহেলা কিংবা ভুলের কারণে সৃষ্ট এসব ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। এর পুনরাবৃত্তি রোধে সংশ্নিষ্ট ঊর্ধ্বতনদের অঙ্গীকার-প্রতিশ্রম্নতিও শোনা যায়। কিন্তু যথাযথ প্রতিবিধানের দৃষ্টান্ত বিরলই বলা যায়।

প্রতিটি ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে- চিকিৎসক, সেবিকা বা সংশ্নিষ্ট অন্যদের অসতর্কতা ও ভ্রান্তির কারণে কী বিপুল ও অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে! কিন্তু এমন ভ্রান্তি কি ব্যতিক্রম? অবহেলার ফলে রোগীর অপচিকিৎসা এমনকি মৃতু্যর বাস্তবিক কত ঘটনা ঘটছে; বিগত কয়েক মাসের চিত্রই এর ইঙ্গিত দেয়। অভিযোগ আছে, দেশে চিকিৎসার প্রতি আস্থার পারদ নামছে। আমরা জানি, অনেক সাধারণ মানুষও এখন সুচিকিৎসার জন্য প্রতিবেশী দেশ ভারতে চলে যান।

চিকিৎসা সেবাদান অত্যন্ত মানবিক পেশা। কিন্তু অবকাঠামোর অভাব, সংশ্নিষ্টদের অদক্ষতা, দায়িত্ববোধের ঘাটতির পাশাপাশি এমন অব্যবস্থার দায় সরকার এড়াতে পারে না। চিকিৎসা ব্যবস্থায় বিপর্যয় রোধে কঠোর ও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার বিকল্প নেই। কী করে চিকিৎসাকেন্দ্রের নামে এত 'বাণিজ্যকেন্দ্র' গড়ে উঠছে- যা চরম জীবনঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে- এ প্রশ্নের জবাব দেওয়ার দায়ও সংশ্নিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগ এড়াতে পারে না। চিকিৎসাকেন্দ্রে অনুশাসন ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি চিকিৎসায় অবহেলাজনিত কারণে সৃষ্ট বিপর্যয়ের দৃষ্টান্তযোগ্য প্রতিকার নিশ্চিত করতেই হবে।

আর কে চৌধুরী : মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদ, সাবেক চেয়ারম্যান রাজউক, উপদেষ্টা, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম, প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আর কে চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে