সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

নতুন শিক্ষাক্রম এবং আমাদের করণীয়

অভাব, দারিদ্র্য আমাদের নিত্যদিনের ছায়াসঙ্গী হলেও স্ব-স্ব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠদানকালে প্রিয় শিক্ষার্থীদের হাসিমাখা মুখ আর লাবণ্যভরা চোখগুলোর দিকে তাকালেই আমরা পুলকিত হই। তাদের আন্তরিক ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা আমাদের চুম্বকের মতো কাছে টানে; কেউ কেউ অল্প স্বল্প জ্বালায় কিন্তু ভালোবাসে ঢের বেশি। শিক্ষকদের শিক্ষার্থীরা আজীবন স্মরণ করে। আমরাও যথাসাধ্য চেষ্টা করি ঝিনুকের মতো মুক্তার দানাগুলোকে পরম যত্ন করে স্বচ্ছ রাখতে যেন অযথা ধুলোবালিতে নষ্ট না হয়।
কায়ছার আলী
  ৩০ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

শিকারে অত্যন্ত পটু, শক্তিশালী এবং বড্ড পাখি ঈগল। যদিও এরা জঙ্গলে বাস করে কিন্তু আকাশের অনেক উঁচুতে আনন্দচিত্তে উড়ে বেড়ায়। ভিন্ন প্রকৃতির ঈগল সাধারণত ৭০ বছর পর্যন্ত বাঁচে। ৪০ বছর পর শারীরিক কিছু প্রতিবন্ধকতার কারণে তারা পূর্বের মতো শিকার ধরতে পারে না। তাদের ঠোঁট অনেক বেশি মোটা এবং ভোতা হয়ে যায়। ডানা ও পালকগুলো ভারী এবং পুরাতন হয়ে যায়। পায়ের নখগুলো বড় হয়ে বেঁকে যায়। এমতাবস্থায় কিছু ঈগল সারভাইভ করার জন্য উঁচু পাহাড়ে গিয়ে ৩/৪ মাস নিজের ঠোঁট ও পায়ের নখগুলোকে শক্ত পাথর ঘষে ঘষে ভেঙে ফেলে এবং পালকগুলোকে টেনেহিঁচড়ে তুলে ফেলে। রক্তাক্ত অবস্থায় অসহ্য যন্ত্রণা বুকে চেপে সে সময় তারা অনাহারে থাকে। পরবর্তী সময়ে নতুন ঠোঁট, পায়ের নখ ও পালকগুলো আবার গজায়। নবোদ্যমে জীবন শুরু করে তারা আরও ৩০ বছর পর্যন্ত বাঁচে। ঈগলের জীবনের অবসান মানে মৃতু্য, আরেকটি বিচিত্র চমক বা অধ্যায়। প্রথমবারের মতো এবারই একসঙ্গে সারাদেশে সাপ্তাহিক ছুটির পাঁচ দিনে বিরতি দিয়ে (৬, ৭, ১৩, ১৪, এবং ১৫ জানুয়ারি) বিপুল উৎসব মুখর পরিবেশে দুই লাখ আশি হাজার শিক্ষকের নতুন কারিকুলাম বা শিক্ষাক্রম বিস্তরণের প্রশিক্ষণ সমাপ্ত হলো। বাদ পড়া শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ চলমান রয়েছে। শিক্ষাক্রমের সফল বিস্তরণ এবং শিক্ষকদের পেশাগত জ্ঞান ও দক্ষতা বৃদ্ধির প্রধান উপায় হলো প্রশিক্ষণ। তাইতো প্রশিক্ষণের প্রশিক্ষকরা পাখিরাজ ঈগলের জীবনে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা আমাদের প্রজেক্টের মাধ্যমে দেখালেন। সেই ভিডিওর মাধ্যমে আমাদের স্মরণ করিয়ে দিলেন যে, ৪০/৫০ বছর বয়সি শিক্ষকরা ঈগল পাখির মতো নিজেদের ধ্যানধারণা পাল্টে ফেলেন। দ্রম্নত পরিবর্তনশীল বিশ্বের চতুর্থ শিল্পবিপস্নবের যুগে শিক্ষাকে আধুনিক উন্নত মানসম্মত করার জন্য মাধ্যমিক (সমমানসহ) পর্যায়ে আমরা সরকারের সারথি হই। ক্রমমানে ধাপে ধাপে বা স্তরে স্তরে, বর্তমান সরকার শিক্ষাক্রমকে সেভাবেই ঢেলে সাজাচ্ছেন। শিক্ষাক্রমের কিছু তথ্য আমি লিখছি, পুরোটা নয়। জ্ঞান ও দক্ষতার সঙ্গে প্রযুক্তির উৎকর্ষের কারণে প্রতিনিয়ত বদলে যাচ্ছে জীবন ও জীবিকা। প্রাত্যহিক জীবন যাত্রায় সংযোজিত হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিকাশে কর্মসংস্থান এবং জীবনযত্রার প্রণালিতে পরিবর্তন এসেছে। যুগের সঙ্গে তালে তাল মিলিয়ে এবং শিক্ষাকে সঠিকভাবে রূপদানের জন্য প্রয়োজন শিক্ষাক্রম। যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গেই শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। প্রাচীনকালে মানুষের বেঁচে থাকার জন্য দক্ষতা অর্জনই ছিল শিক্ষার মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। ফলে তখনকার অনানুষ্ঠানিক শিক্ষায় এ দিকটি গুরুত্ব পেয়েছিল। পরবর্তী সময়ে ধীরে ধীরে শিক্ষা সম্পর্কিত মানুষের চিন্তার ফসল হিসেবে আনুষ্ঠানিক শিক্ষার ধারণা বাস্তবরূপ পেতে থাকে। অনেকে মনে করেন শিক্ষাক্রমের নিজস্ব কোনো লক্ষ্য নেই। কোনো সমাজ, জাতি বা রাষ্ট্রের নাগরিকের জীবনের পরম পাওয়ার ওপর শিক্ষাক্রমের লক্ষ্য নির্ধারিত হয়। শিক্ষাক্রমের প্রকৃতি, পরিসর, প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব নির্ভর করে শিক্ষাক্রমের মূলভিত্তি তথা জাতীয় শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যেকে সুবিবেচনা করে। জাতীয় শিক্ষনীতি ২০১০-এর সুপারিশক্রমে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক শিক্ষা আইন-২০১৩ প্রণীত হয়। নতুন শিক্ষাক্রমে পরীক্ষর পরিবর্তে মূল্যায়নের ওপর অধিকতর গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। যথাক্রমে শিখনকালীন মূল্যায়ন এবং সামষ্টিক মূল্যায়ন। শিখনকালীন মূল্যায়নে ধারাবাহিকতা থাকবে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এ মূল্যায়নের তথ্য ও উপাত্ত যোগ্যতার বা পারদর্শিতার লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের প্রমাণ দেবে। শিক্ষর্থীর উন্নয়নের জন্য পরামর্শ বা উৎসাহ প্রদানের জন্য শিক্ষককে মন্তব্য করতে হবে এবং প্রমাণাদি সংরক্ষণ করতে হবে। সামষ্টিক মূল্যায়নসমূহ কাগজ কলম নির্ভর, পরীক্ষা নয় বরং যোগ্যতার বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী মূল্যায়নের বহুমুখী পদ্ধতির (কাজ, এসাইনমেন্ট, উপস্থাপন যোগাযোগ, কোনো অনুষ্ঠানের আয়োজন ইত্যাদি) সমন্বিত প্রয়োগের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর যোগ্যতা অর্জনের অবস্থান জানতে হবে। নতুন শিক্ষাক্রম হবে শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক ও আনন্দময়। বইয়ের বোঝা, চাপ এবং মুখস্থ নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসা। তারা শ্রেণিকক্ষেই লেখাপড়া শিখবে। জ্ঞান, দক্ষতা, মূল্যবোধের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে তারা পারদর্শিতা অর্জন করবে। মাধ্যমিক পর্যায়ে বিভাগ বিভাজন থাকবে না, উচ্চমাধ্যমিকে থাকবে। শ্রেণিতে রোল নম্বর, ফেল, নম্বর প্রদান এবং বছরের শেষে কোনো পরীক্ষা থাকবে না। আইডি নম্বর এবং তিনটি ইন্ডিকেটর থাকবে। আবশ্যিক বিষয়ের সঙ্গে পাঁচটি নতুন বিষয় যোগ করা হয়েছে ডিজিটাল প্রযুক্তি, জীবন ও জীবিকা, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য এবং সুরক্ষা ধর্ম শিক্ষা এবং শিল্প ও সংস্কৃতি। শিল্প ও সংস্কৃতির মাধ্যমে তারা নান্দনিকতা কি? তা জানতে পারবে। নন্দন অর্থ সৌন্দর্য, নান্দনিক অর্থ সৌন্দর্যমন্ডিত। যে কোনো কাজ করার ক্ষেত্রে তা সুন্দর করে করা, সাজিয়ে গুছিয়ে রাখতে পারবে। যা চোখে পড়লেই যেন সুন্দর বলে প্রতীয়মান হয়, তাকে নান্দনিকতা বলে। শিক্ষাসাদৃশ্য এর ছোট বড় জীবনের কাজ নান্দনিকতার উদাহরণ। এনটিআরসিএ কর্মরত অধ্যাপক মতিউর রহমান নতুন কারিকুলাম প্রণয়নের পূর্বে পার্বত্য এলাকায় এক শ্রমজীবী বৃদ্ধাকে জিজ্ঞাসা করেন 'আপনার শেষ ইচ্ছা কি? উত্তরে তিনি বলেন, আমার জীবনের শেষ দিনগুলোতে যেন আমার সন্তান আমাকে দেখভাল করেন। স্যার অনুধাবন করলেন, অবশ্যই পাঠ্যপুস্তকে মূল্যবোধ মানে নিজ নিজ ধর্মীয় শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। নীতি, নৈতিকতা ছাড়া মানুষ অমানুষ হতে বাধ্য। আমাদের আর্থসামাজিক এবং বৈশ্বিক পরিস্থিতির চুলচেরা বিশ্লেষণ করে বিষয়গুলো সন্নিবেশিত করা হয়েছে। বাস্তব অভিজ্ঞতা, শিক্ষার্থী কেন্দ্রিক এই কারিকুলামে ৪ টি ধাপ রয়েছে, প্রেক্ষাপট নির্ভর অভিজ্ঞতা, প্রতিফলনমূলক পর্যবেক্ষণ, বিমূর্ত ধারণায়ন এবং সক্রিয় পরীক্ষণ। প্রশিক্ষণ চলাকালীন কেউ কেউ মনে করেন শিক্ষর্থীদেরকে বাড়ির কাজ প্রদান, পরীক্ষা গ্রহণ (ভীতির বদলে আনন্দময়) করা যায় কিনা? তা পুনরায় সুবিবেচনার আবেদন। দেশীয় ওজন পদ্ধতি থেকে মেট্রিক পদ্ধতি, ডিভিশন প্রথা থেকে গ্রেডিং মানে জিপিএ, কম্পিউটার ভীতি যেভাবে ক্লিয়ার হয়ে গেছে, এই কারিকুলামও নিকট ভবিষ্যতে সেভাবেই পরিষ্কার হয়ে যাবে। সমাজে আর দশটি পেশার মতো আমাদের আর্থিক স্বচ্ছলতা নেই, এটা সবাই জানেন। আলোকিত সমাজ বিনির্মাণে এবং মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে আমরা সমাজের সবার কাছেই শ্রদ্ধাশীল।

অভাব, দারিদ্র্য আমাদের নিত্যদিনের ছায়াসঙ্গী হলেও স্ব-স্ব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠদানকালে প্রিয় শিক্ষার্থীদের হাসিমাখা মুখ আর লাবণ্যভরা চোখগুলোর দিকে তাকালেই আমরা পুলকিত হই। তাদের আন্তরিক ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা আমাদের চুম্বকের মতো কাছে টানে; কেউ কেউ অল্প স্বল্প জ্বালায় কিন্তু ভালোবাসে ঢের বেশি। শিক্ষকদের শিক্ষার্থীরা আজীবন স্মরণ করে। আমরাও যথাসাধ্য চেষ্টা করি ঝিনুকের মতো মুক্তার দানাগুলোকে পরম যত্ন করে স্বচ্ছ রাখতে যেন অযথা ধুলোবালিতে নষ্ট না হয়।

কায়ছার আলী : শিক্ষক, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে