শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশে রেলপথ বিকাশ

বাংলাদেশের অন্যান্য যানবাহনের তুলনায় রেলওয়ের নিরাপত্তা ব্যবস্থা মোটামুটি ভালো। ১৯৯৯ জুলাই থেকে জুন ২০০০ সালের মধ্যে মোট ৪৫৬টি রেল দুর্ঘটনা ঘটে, তার মধ্যে ৬টি হয় মুখোমুখি সংঘর্ষে, ৪০৫টি সংঘটিত হয় লাইনচুু্যত হয়ে, ১টি অগ্নিকান্ডে, ৪৪টি অন্যান্য কারণে।
আরাফাত রহমান
  ২৩ মার্চ ২০২৩, ০০:০০

উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ব্রিটিশ সরকারের সহযোগিতায় উপনিবেশিক বাংলায় রেল স্থাপনের জন্য প্রাথমিকভাবে ইংল্যান্ডে চিন্তাভাবনা ও পরিকল্পনা হতে থাকে। এরূপ পরিকল্পনার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল রাজনৈতিক, ভৌগোলিক ও কৌশলগত সুবিধাদিসহ বাণিজ্যিক স্বার্থ বিবেচনা। রেলওয়ে উনিশ শতকে প্রবর্তিত হয়ে যোগাযোগের ক্ষেত্রে ব্যাপক বিপস্নবের সূচনা করে। ভারতের ভাইসরয় লর্ড ডালহৌসি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পরিচালক পর্ষদের কাছে ভারতবর্ষে রেলওয়ে স্থাপন কাজ শুরু করার জন্য অনেকগুলো প্রস্তাব পাঠান।

তবে প্রয়োজনীয় অনুমোদন পেতে ও সরকারের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদনে বেশ কয়েক বছর লেগে যায়। ইতোমধ্যে, ১৮৫০ সালে গ্রেট ইন্ডিয়ান পেনিনসুলার রেলওয়ে নামক কোম্পানি মুম্বাই থেকে ৩৩ কিমি দীর্ঘ রেললাইন স্থাপন করতে থাকে। এটিই ছিল ব্রিটিশ ভারতে রেলওয়ের প্রথম যাত্রা। বর্তমান বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমারেখার মধ্যে রেললাইন স্থাপনের কাজ শুরু করার বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে ব্রিটিশ আমলেই বিবেচনা করা হয়েছিল। ১৮৫২ সালে গঙ্গা নদীর পূর্ব তীর ধরে সুন্দরবন হয়ে ঢাকা পর্যন্ত রেললাইন বসানোর প্রস্তাব দেয়া হয়।

বিশ্বজুড়ে পাটের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণের জন্য প্রধান পাট উৎপাদনকারী এলাকা ঢাকা এবং ময়মনসিংহ থেকে কলকাতা বন্দরে পাট সরবরাহ করার জন্য উন্নতমানের যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রয়োজন দেখা দেয়। ১৮৮৫ সালে মূলত কাঁচা পাট নদীপথে কলকাতায় আনার জন্য ঢাকা স্টেট রেলওয়ে নামে খ্যাত ময়মনসিংহ থেকে ঢাকা হয়ে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত ১৪৪ কিমি দীর্ঘ মিটারগেজ রেললাইন স্থাপন করা হয়। ক্রমান্বয়ে এটিকে ময়মনসিংহ থেকে জামালপুর হয়ে জগন্নাথগঞ্জ ঘাট এবং পরবর্তীকালে বাহাদুরাবাদ ঘাট পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়।

১৯১৪ সালে পদ্মার উপরে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ প্রকল্প বাস্তবায়ন উপলক্ষে শান্তাহার পর্যন্ত মিটারগেজ লাইনকে ব্রডগেজ লাইনে রূপান্তর করা হয়। ১৯১৫ সালের ৪ মার্চ দুই লেনবিশিষ্ট হার্ডিঞ্জ ব্রিজ রেল চলাচলের জন্য উদ্বোধন করা হয়। ঢাকার সঙ্গে চট্টগ্রামের সরাসরি যোগাযোগের জন্য ১৯৩৭ সালে ৬ ডিসেম্বর মেঘনা নদীর উপর রেলসেতু উদ্বোধন করা হয়। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট ভারত বিভক্তির পর পূর্ববাংলা তথা পূর্ব পাকিস্তান উত্তরাধিকারসূত্রে পায় ২,৬০৬.৫৯ কিমি রেললাইন এবং তা ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে নামে পরিচিত হয়। ১৯৬১ সালের ১ ফেব্রম্নয়ারি এর নতুন নামকরণ হয় পাকিস্তান ইস্টার্ন রেলওয়ে। ব্রডগেজ রেলইঞ্জিন বা ব্রডগেজ রেললাইনের উপরে চলাচল করার উপযুক্ত রেলযানসমূহ মেরামত করার কোনো কারখানা পূর্ব পাকিস্তানে ছিল না।

তবে, পূর্ব পাকিস্তান রেলওয়ে সৈয়দপুরে একটি মিটারগেজ রেল কারখানা পেয়েছিল। রেল পরিচালনার ক্ষেত্রে কতগুলো মারাত্মক অসুবিধা ও সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় তখন, যেমন, সংযোগবিহীন রেললাইন, যানান্তরকরণের অসুবিধা, যমুনা নদীর দুই ধরে নাব্য পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ফেরিঘাটসংলগ্ন রেললাইনের নিত্য স্থানান্তর সমস্যা ইত্যাদি। উপরন্তু, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রেললাইনের উপর দিয়ে প্রবল ধকল যায়। দেশ বিভাগের আগ পর্যন্ত সেগুলো সঠিকভাবে মেরামত করা সম্ভব হয়নি।

দেশ বিভাগের পরপরই সঙ্গত কারণে সৈয়দপুর কারখানায় ব্রডগেজ রেলইঞ্জিন ও যানবাহন মেরামতের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়। স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ আত্মপ্রকাশের পর এ দেশের রেলওয়ের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় বাংলাদেশ রেলওয়ে, যা উত্তরাধিকারসূত্রে পায় ২,৮৫৮.৭৩ কিমি রেলপথ ও ৪৬৬টি স্টেশন। স্বাধীনতা যুদ্ধে রেলওয়ে একেবারে বিধ্বস্ত হয়ে যায়। ফলে প্রচুর অর্থ ব্যয় করে অনেক বছরে সেগুলো মেরামত করতে হয়।

১৯৯৪ সালে যমুনা বহুমুখী সেতুর কাজ শুরু হয়। চার লেন সড়কপথ ও এক লেন ডুয়েলগেজ রেলপথবিশিষ্ট এই সেতুর উপরে আছে বৈদ্যুতিক সংযোগ, গ্যাস লাইন ও টেলিফোন লাইনের বন্দোবস্ত। ১৯৯৮ সালের ২৩ জুন সেতু উদ্বোধন করা হয়। রেলওয়ে গেজ পদ্ধতিকে সুসঙ্গত করার জন্য যমুনা সেতুর পূর্ব প্রান্ত থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত ১১৫ কিমি ডুয়েলগেজ লাইন নির্মিত হয় এবং জয়দেবপুর থেকে ঢাকা পর্যন্ত ৩৫ কিমি লাইনকে ব্রডগেজে রূপান্তর করা হয়। ২৪৫ কিমি দৈর্ঘ্য পার্বতীপুর-ঈশ্বরদী-জামতৈল ব্রডগেজ রেলপথ যমুনা সেতুর পশ্চিম প্রান্তে মিলেছে।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর রেলওয়ের সাংগঠনিক কাঠামোতে কিছু মৌলিক পরিবর্তন দরকার হয়ে পড়ে। সেই অনুসারে ১৯৭৩ সালে রেলওয়ে কমিশন রিপোর্ট-১৯৭৬ ও ১৯৮২ সালে মার্শাল ল' অর্ডিন্যান্স এবং ১৯৯৫ সালে সরকারি আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে রেলওয়ের উঁচু পর্যায়ে প্রশাসনিক ব্যবস্থায় আবারও অনেক পরিবর্তন সাধন করা হয়। বাংলাদেশ রেলওয়ে বর্তমানে সরকারি সংস্থা হিসেবে সরকারি সহায়তায় এবং ব্যবস্থাপনায় রেলপথ মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত হচ্ছে। ১ জুলাই, ২০০০ সালে বাংলাদেশে মোট ২,৭৬৮ কিমি রেললাইন ছিল, তার মধ্যে পশ্চিম জোনে ৯৩৬ কিমি ব্রডগেজ, ৫৫৩ কিমি মিটারগেজ এবং পূর্ব জোনে ১,২৭৯ কিমি মিটারগেজ।

নিরাপদ ও সুসংহতভাবে রেল পরিচালনা করা এবং লাইনের পরিবহণ ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য সমগ্র রেল ব্যবস্থাপনায় যথাযথ সাংকেতিক ব্যবস্থা ও টেলিযোগাযোগের বিন্যাস করা হয়। নিরাপত্তা আরও জোরদার করার জন্য অনংড়ষঁঃব ইষড়পশ ডড়ৎশরহম ঝুংঃবস অনুযায়ী রেলওয়ের পরিবহণ ব্যবস্থা চালিত হয়। ১৯৯৫-৯৭ সালে ময়মনসিংহ-জামালপুর লাইনের ৬টি স্টেশনে এই ব্যবস্থা চালু হয়। ১৯৮০-৮৫ সালে ৩টি বড় বড় ব্রডগেজ স্টেশনে একই ব্যবস্থা চালু হয়। পার্বতীপুর-ঈশ্বরদী-খুলনা ব্রডগেজ লাইনে দ্রম্নতগতিতে ঘণ্টায় ৯৫ কিমি বেগে ট্রেন চলাচল করে। অন্যান্য স্টেশনগুলোতে বিভিন্ন ধরনের যান্ত্রিক সাংকেতিক ব্যবস্থাপনায় রেল পরিবহণ পরিচালনা করা হয়।

বাংলাদেশের অন্যান্য যানবাহনের তুলনায় রেলওয়ের নিরাপত্তা ব্যবস্থা মোটামুটি ভালো। ১৯৯৯ জুলাই থেকে জুন ২০০০ সালের মধ্যে মোট ৪৫৬টি রেল দুর্ঘটনা ঘটে, তার মধ্যে ৬টি হয় মুখোমুখি সংঘর্ষে, ৪০৫টি সংঘটিত হয় লাইনচুু্যত হয়ে, ১টি অগ্নিকান্ডে, ৪৪টি অন্যান্য কারণে।

এসব দুর্ঘটনায় ২০ জনের মৃতু্য হয়, আহত হয় ২৩৩ জন এবং আর্থিক মূল্যে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৪৫.৫০ লাখ টাকা। রেল পরিচালনায় দক্ষতা এবং নিরাপত্তা আরও বৃদ্ধি করার জন্য ১৯৮৫ থেকে ১৯৯০ সালের মধ্যে প্রায় ৩০০ রেলস্টেশনের সঙ্গে ২,৭৬৮ কিমি'র মধ্যে ১,৮০০ কিমি রেলপথের উপর সর্বাধুনিক সমন্বিত অপটিক্যাল ফাইবার টেলিযোগাযোগ স্থাপন করা হয়।

এই ব্যবস্থায় ৩০টি ড্রপ ইনসার্ট এবং মাল্টিপেস্নক্সিং স্টেশন আছে। নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ ও সার্বিক পরিদর্শনের জন্য ১৮৯০ সালে প্রণীত রেলওয়ে অ্যাক্ট এবং পরবর্তী আদেশানুক্রমে সরকারি রেলওয়ে পরিদর্শককে রেললাইনের উপর দিয়ে যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচলের যোগ্যতা, রেললাইন, সেতু, সিগন্যাল ও রোলিং স্টকসমূহের উপযুক্ততা, বিশেষ দুর্ঘটনার তদন্ত করা এবং আরও অনেক আনুষঙ্গিক কাজ পরিদর্শন ও প্রয়োজনীয় সুপারিশ করার জন্য ক্ষমতা দেওয়া হয়। ১৯৮৪-৮৫ সালের শেষ দিকে সমস্ত বাষ্পচালিত রেলইঞ্জিন বাতিল ঘোষণা করা হয়। রেলইঞ্জিন দুই ধরনের, যথা- ডিজেল ইলেক্ট্রিক ও হাইড্রো ইলেক্ট্রিক। যাত্রী যানবাহনে বিদু্যতায়ন নিশ্চিত করার জন্য আধুনিক প্রযুক্তির মিড-অন-জেনারেশন ব্যবস্থা চালু করা হয়।

বাংলাদেশ রেলওয়ের আছে ৬টি কারখানা: ১টি সৈয়দপুরে, ২টি পাহাড়তলীতে, ২টি পার্বতীপুরে ও ১টি ঢাকায়। সবচেয়ে বড় কারখানা সৈয়দপুরে। এখানে উভয় প্রকার গেজের রেলকোচ এবং ওয়াগনের বড় ধরনের মেরামতের কাজসহ নতুন রেলকোচ ও ওয়াগন সন্নিবেশ করা হয়। পাহাড়তলীতে দুটি কারখানার মধ্যে ১টিতে সম্পন্ন হয় মিটারগেজ রেলযান ও ওয়াগন মেরামত ও সমাবেশ, অন্যটিতে মেরামত করা হয় মিটারগেজের ডিজেল ইলেকট্রিক রেলইঞ্জিন। ১৯৯২ সালে পার্বতীপুরে ক্রমবর্ধমান ডিজেল রেল ইঞ্জিনের মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ করার জন্য ১টি কেন্দ্রীয় ডিজেল কারখানা স্থাপন করা হয়। এটি হচ্ছে ইঞ্জিনের সব ধরনের বড় মেরামত এবং ওভারহলিংয়ের প্রধান ও আধুনিক কারখানা। পার্বতীপুরে অন্য আরেকটি কারখানায় ব্রডগেজ ডিজেল রেল ইঞ্জিনের সাধারণ মেরামতের কাজ চলে এবং ঢাকা ওয়ার্কশপে মিটারগেজ রেল ইঞ্জিনের সাধারণ মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়।

তুলনামূলকভাবে দ্রম্নত ও উত্তম সার্ভিসের জন্য, গুদাম থেকে গুদামে সহজে যাতায়াতের কারণে মালামাল পরিবহণে রেলপথের চেয়ে সড়কপথই বেশি প্রাধান্য পায়। মূল্যবান মালামাল বহনের জন্য রেলওয়েকে খুব কঠিন প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। দেশের অন্যান্য অঞ্চলে শিল্পায়ন প্রক্রিয়া গড়ে না ওঠার কারণে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে মালবাহী রেলগাড়িগুলোর যাতায়াত একমুখী হয়ে থাকে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে মালবাহী গাড়ি গন্তব্যস্থলে মালামাল খালাস করার পর খালি ফিরে আসে। অপরদিকে, জাতীয় পরিবহণ মাধ্যমের অঙ্গ হিসেবে বাংলাদেশ রেলওয়েকে অপরিহার্য দ্রব্যাদি, যেমন খাদ্যশস্য, সার, পাট, সিমেন্ট, কয়লা, লোহা, ইস্পাত, পাথর, পেট্র্রোলিয়াম, লবণ, চিনি ইত্যাদি স্বল্পমূল্যে প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছে দিতে হয়।

বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে সর্ববৃহৎ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। বাংলাদেশ রেলওয়ের সব কর্মকর্তা এবং পরিচালনাকারী স্টাফকে চট্টগ্রামে অবস্থিত রেলওয়ে প্রশিক্ষণ একাডেমি থেকে স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রাথমিক প্রশিক্ষণ এবং দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে হয়। রেলওয়ে খাতে বর্তমানের সংস্কার প্রক্রিয়ায় বাণিজ্যিক সেবা বেসরকারীকরণের উদ্যোগ অব্যাহত আছে। এর ফলে রেলওয়ের অধিকতর আর্থিক স্বয়ংনির্ভরতা অর্জন সম্ভব হবে। সংস্কার প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারে এমন অন্যান্য কার্যক্রমের মধ্যে আছে উন্নততর প্রযুক্তি সংযোজন, নতুন রেললাইন স্থাপন, কর্মচারীর সংখ্যা হ্রাস করা, লোকসানি শাখা লাইনসমূহ বন্ধকরণ এবং রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণাধীন জমির যথোপযুক্ত ব্যবহার নিশ্চিত করা।

আরাফাত রহমান : কলাম লেখক।

\হ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে