সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

ব্যাংক খাতে ঝুঁকি প্রতিরোধে করণীয় ে

দক্ষ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনাই যথাযথ ব্যাংকিং সেবা নিশ্চিত করতে পারে। এজন্য ঝুঁকির সংস্কৃতি অনুধাবন, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, সুশাসন নিশ্চিত এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালার আলোকে আলাদা গাইডলাইন তৈরি করতে হবে।
রজাউল করিম খোকন
  ০১ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংক খাতে গত বেশ কিছু দিনে যা ঘটেছে তা নিয়ে সবাই কমবেশি আতঙ্কিত। কিন্তু সব আলোচনাই যেন একটি জায়গায় এসে আটকে পড়ছে আর তা হলো অর্থনীতির সংকট ও ফেডারেল রিজার্ভের সুদহার বাড়ানোর কারণেই ব্যাংকগুলোর পতন হয়েছে। অথবা আমানতকারীরা আস্থা হারিয়ে অর্থ তুলতে থাকায় ব্যাংকগুলো ধসে পড়েছে। বিষয়টি কি শুধুই এর মধ্যে সীমাবদ্ধ? আমানতকারীরা কি কোনো কারণ ছাড়াই অর্থ তুলতে ব্যাংকে লাইন দিয়েছে- নাকি এর পেছনে অন্য কিছু রয়েছে? একের পর এক ব্যাংকের পতনের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংক খাতের দুর্বলতাগুলোই নতুন করে সামনে চলে আসছে। ২০০৮ সালের আর্থিক সংকটের পর দেশটির সরকার আমানতকারীদের সুরক্ষার জন্য ডড-ফ্রাঙ্ক আইন পাস করেছিল। উদ্দেশ্য ছিল বড় ব্যাংকগুলোর পতন বা বন্ধ হলে যেন অর্থনীতির সংকট তৈরি না হয় এবং লাখ লাখ মানুষকে পথে বসতে না হয়। নিয়ন্ত্রক সংস্থা কর্তৃক বন্ধ করে দেয়ার আগে সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক (এসভিবি) যুক্তরাষ্ট্রের ১৬তম বৃহৎ ব্যাংকে পরিণত হয়েছিল। অথচ ব্যাংকটির শীর্ষ নির্বাহীরা দাবি করেছিলেন, তারা এত বৃহৎ ব্যাংক নয় যে, তাদের কঠোর তদারকি করতে হবে। এমনকি আইন মানতে ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনাসংক্রান্ত বিদ্যমান গাইডলাইন অনুসরণেও তাদের উদাসীনতা ছিল লক্ষণীয়। দুঃখজনক বিষয় হলো, ফেডারেল ডিপোজিট ইন্সু্যরেন্স করপোরেশন এসভিবির দখল নিতে ছুটে আসার কয়েক ঘণ্টা আগেও এসভিবির কর্মকর্তারা নিজেদের মধ্যে 'বোনাস' বণ্টনে ব্যস্ত ছিলেন। অথচ ব্যাংকটি অসংখ্য গ্রাহকদের অর্থ প্রদানে ব্যর্থ হয়েছিল, এমনকি কর্মচারীদের বেতনও পরিশোধ করতে পারছিল না। ব্যাংকটি পতনের কয়েকদিন আগে এসভিবির মালিক ও এসভিবি ফাইন্যান্সিয়াল গ্রম্নপের কর্মকর্তারা তাদের হাতে থাকা শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন। এমনকি এসভিবির প্রধান নির্বাহীও সপ্তাহখানেক আগে তার অধীনে থাকা শেয়ার বিক্রি করেছেন। যেটি অনেকেই এড়িয়ে যাচ্ছেন সেটি হলো এসভিবির স্বেচ্ছাচারিতা, নিয়ম ভঙ্গ ও দুর্বল ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা। সবাই এসভিবি পতনের জন্য ফেডারেল রিজার্ভের সুদহার বৃদ্ধিকে দায়ী করছেন। এটি একটি কারণ বটে, তবে একমাত্র কারণ নয়। ব্যাংকটির অভ্যন্তরীণ পরিচালনা ব্যবস্থার দুর্বলতা ও সুশাসনের ঘাটতির কারণে ব্যাংকটি সংকটে পতিত হয়েছে। অতিমাত্রায় ঝুঁকি নেওয়ার কারণেই তারা সংকটে পড়েছে। এ কথাও সত্য, ফেডারেল রিজার্ভ এসভিবির পতনের দায় এড়াতে পারে না। কারণ ব্যাংকটি তদারকিতে তারা উদাসীনতার পরিচয় দিয়েছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা ব্যাংকটির ঝুঁকি সঠিকভাবে নিরূপণ করেনি। যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাংক বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঘটনা এটাই প্রথম নয়। গত ২২ বছরে ৫৬৩টি ব্যাংক বন্ধ হয়ে গেছে। আবার নতুন করে কার্যক্রমে এসেছে অনেকে। অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগবে, এতে কি আমানতকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হন না। অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত হন। আগে আমানতকারীরা অর্থ হারাতেন, এখন তাদের আমানতের কিছু অংশ বীমা করা থাকায় ক্ষতির শঙ্কা কিছুটা কম। বীমার পরিমাণ আড়াই লাখ ডলার। যারা এর বেশি আমানত ব্যাংকে রেখেছেন তাদের শঙ্কা বেশি। তাদের রক্ষা করতে সরকার এগিয়ে এসেছে। অন্য ব্যাংকের সঙ্গে মার্জার করার কথা চলছে। এরই মধ্যে কিছু শেয়ার লেনদেনও হয়েছে। তবে কমবেশি সব আমানতকারীই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন এতে। অর্থ পেতে দেরি হওয়া থেকে শুরু করে সম্পূর্ণ অর্থ না পাওয়ার ঘটনাও ঘটবে। তবে তাদের একটা ভরসা হলো দেশটির ফেডারেল রিজার্ভ।

স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশে কোনো ব্যাংক বন্ধ না হলেও একটি-দুটি ব্যাংক যে সংকটে পড়েনি তা নয়। নব্বইয়ের দশকে একটি ব্যাংক আমানতকারীদের অর্থ প্রদানে ব্যর্থ হলে বাংলাদেশ ব্যাংক সেটি বন্ধ করে দেয় এবং একাধিকবার হাত বদল হওয়ার পরও তার গ্রাহকরা সঠিক সময়ে সঠিক পরিমাণে অর্থ পায়নি। বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোও এসভিবি ও সিগনেচার ব্যাংকের মতো ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ করেছে। একটি কোম্পানি বা একটি খাতে অধিক বিনিয়োগের সমস্যা বাংলাদেশের ব্যাংক খাতেও বিদ্যমান। প্রতিটি ব্যাংকেরই বড় তিন থেকে পাঁচটি ঋণগ্রহীতা ব্যর্থ হলে ব্যাংকগুলো আমানতকারীদের অর্থ পরিশোধ করতে পারবে না। তাছাড়া ব্যাংকের ঋণ ঢাকা ও চট্টগ্রামের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোতেও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় নানা দুর্বলতা রয়ে গেছে। বিভিন্ন সময়ে সেটি স্পষ্ট হয়েছে। বাংলাদেশেও সরকারি ও বেসরকারি উভয় ব্যাংক বাঁচাতে সরকার অর্থ প্রদান করেছে। কিন্তু যেসব অনিয়মের কারণে ব্যাংকগুলো দুরবস্থায় পতিত হচ্ছে তা বন্ধে কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। যুক্তরাষ্ট্রের সরকার ব্যাংক বাঁচাতে বা আমানতকারীদের রক্ষায় বিলিয়ন ডলার বেইলআউট করতে পারলেও বাংলাদেশ পারবে কিনা সন্দেহ রয়েছে। মাঝে ইসলামী ধারায় পরিচালিত ব্যাংক থেকে আমানত ওঠানোর হিড়িক পড়লে বড় ধরনের বিপদে পড়ে যায় ব্যাংকগুলো। বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের রক্ষায় এগিয়ে আসে। কিন্তু যেসব কারণে ব্যাংকগুলো সংকটে পড়েছিল তা রোধে কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি। এমনকি দুর্বল ব্যবস্থাপনা ও নিয়ম অমান্য করে ব্যবসা পরিচালনার জন্য কাউকে জবাবদিহিও করতে হয়নি।

ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ব্যাংকের জন্য প্রয়োজনীয় একটি বিষয়। ব্যাংক সাধারণ জনগণের আমানত ও সঞ্চয়ের জিম্মাদার। সাধারণত ব্যাংক একটি সুনির্দিষ্ট নীতি কাঠামোর আওতায় ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা পরিচালন ও নিয়ন্ত্রণ করে, যেখানে বিনিয়োগকারীর স্বার্থ সংরক্ষণের বিষয়টিও নিশ্চিত করা হয়। ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার সবচেয়ে জটিল এ পরিস্থিতিতে উচ্চমাত্রার মূলধন বা 'ক্যাপিটাল অ্যাডিকোয়েসি রেশিও' বজায় রাখা ব্যাংকের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ব্যাংকের দিক দিয়ে দেখতে গেলে উচ্চমাত্রার মূলধন ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণের সামর্থ্য নির্দেশ করে। বর্তমান পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃক নির্ধারিত সর্বনিম্ন ক্যাপিটাল বা মূলধন যথেষ্ট নয়। উপরন্তু, কোনো কোনো ব্যাংকে মূলধনের ঘাটতিও রয়েছে। বিশ্বের উন্নত অন্যান্য দেশের ব্যাংকগুলোর তুলনায় আমাদের দেশের ব্যাংকগুলো ক্যাপিটাল বা মূলধনের দিক দিয়ে অনেকটাই পিছিয়ে। 'সমন্বিত ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা' হচ্ছে সবচেয়ে সময়োপযোগী ও কার্যকরী পন্থা- যা ব্যাংকগুলোকে সহায়তা করতে পারে। এ ব্যাপারে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ও শীর্ষ নেতৃত্ব প্রধান ভূমিকা রাখতে পারে। 'সমন্বিত ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা'-এর অংশ হিসেবে একটি চৌকস দল নিয়মিত তথ্য সংগ্রহ, পর্যবেক্ষণ ও নিরীক্ষণ, পরিচালনা পর্ষদ ও শীর্ষ নেতৃত্বকে অবগতকরণ এবং এসবের ভিত্তিতে পরিস্থিতি বিশ্লেষণমূলক কার্যক্রমে নিয়োজিত থাকা আবশ্যক। ব্যাংক খাতে স্থিতিশীল অবস্থা আনার জন্য এ ধরনের কার্যক্রম চলমান রাখা জরুরি। সম্ভাব্য ঝুঁকি ও আর্থিক সামর্থ্যের ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারক ও অংশীদারি পক্ষগুলোর কাছে স্বচ্ছ ধারণা থাকা জরুরি। ব্যাংক খাতে ঝুঁকিগুলো চিহ্নিতকরণ ও প্রকৃত মূলধনের পরিমাণ নিরূপণ এবং যথেষ্ট পরিমাণ সংরক্ষণ করে আগামী দিনের সম্ভাব্য বিপদ মোকাবিলায় প্রস্তুত হওয়ার বিকল্প নেই।

দক্ষ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনাই যথাযথ ব্যাংকিং সেবা নিশ্চিত করতে পারে। এজন্য ঝুঁকির সংস্কৃতি অনুধাবন, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, সুশাসন নিশ্চিত এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালার আলোকে আলাদা গাইডলাইন তৈরি করতে হবে।

ব্যাংকিং খাতে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ ব্যাংক বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক আরো কিছু উদ্যোগ নিচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় সরকারি-বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো কার্যকর ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার দিক বিবেচনায় ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা বিভাগ (আরএমডি) খুলেছে। বোর্ড রিস্ক ম্যানেজমেন্ট কমিটি (বিআরএমসি), নির্বাহী ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কমিটি (ইআরএমসি) এবং প্রধান ঝুঁকি কর্মকর্তা (সিআরও) এরই মধ্যে কাজ করছে। ব্যাংকের সব ধরনের ঋণে ঝুঁকি থাকে, তা দক্ষতার সঙ্গে ব্যবস্থাপনা করতে হবে ব্যাংকারদের। তবে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় প্রথম কাজ হলো, ব্যাংকারদের ঝুঁকি চিহ্নিত করা। ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার জন্য একটি সূচক তৈরি করে কাজ করতে হবে। বিশেষ করে ঋণ প্রদানে ঝুঁকিগুলো খুঁজে বের করতে হবে। ব্যাংকিং খাতে ঝুঁকিকে এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। বরং দক্ষতার সঙ্গে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা জরুরি। ঝুঁকির ক্ষেত্রে নিজেকে সচেতন হতে হবে। ব্যাংকারদের নিজ দায়িত্বেই ঝুঁকি চিহ্নিত করতে হবে। করোনাভাইরাস সংক্রমণের প্রভাবে বড় ধরনের সংকটের মুখে পড়েছে দেশের অর্থনীতি। এতে শিল্প, কারখানা, ব্যবসাবাণিজ্যের পাশাপাশি অর্থনীতির চালিকাশক্তি ব্যাংক খাতও সবচেয়ে বড় ঝুঁকির মুখে রয়েছে। করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত প্যাকেজ বাস্তবায়নের দায়িত্ব পড়েছে ব্যাংকগুলোর ওপর। এই সময় খেলাপি ঋণ, তারল্য সংকট, মুনাফা কমে যাওয়াসহ নানা ধরনের সংকটে পড়েছে ব্যাংক খাত। অর্থনৈতিক ও আর্থিক পুনরুদ্ধারে ব্যাংক খাতের সুসংগঠিত কার্য প্রস্তুতি প্রয়োজন। সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের করোনাসংক্রান্ত অর্থনৈতিক ও আর্থিক কার্যক্রমে ব্যাংকগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। যে ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোকে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে সহযোগিতার পাশাপাশি নিজস্ব ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায়ও মনোযোগ দিতে হবে। সম্ভাব্য ঝুঁকির বিষয়গুলো চিহ্নিত করা, সম্ভাব্য অবকাঠামোগত পরিবর্তনে প্রস্তুতি নেওয়া, ঋণ ব্যবস্থাপনার ঝুঁকির দিকগুলোর পদ্ধতি সংস্কার আনা, বর্তমান ও সম্ভাব্য তারল্য ব্যবস্থাপনার দিকগুলো পর্যালোচনা করা, প্রণোদনা প্যাকেজগুলোর সর্বোচ্চ সুষ্ঠু ব্যবহার, অর্থনীতিতে তারল্য বাড়াতে বিনিয়োগ পরিকল্পনা নেওয়া, নিয়ন্ত্রক সংস্থার সঙ্গে সব কাজে স্বচ্ছতা বজায় রাখা, প্রতিষ্ঠানের সুনাম ও অর্থনৈতিক ঝুঁকির বিষয়ে দেখভাল করা, সব পর্যায়ে শক্তিশালী যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা এবং আস্থা ও বিশ্বাস বাড়াতে কাজ করা। ব্যাংকগুলোকে ঋণ দিতে হলেও এখনই তারল্য সংকট হবে না। তবে ভবিষ্যতে নানা সংকট হতে পারে।

একথা সর্বজনবিদিত যে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ব্যাংকের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি বিষয়। ব্যাংক সাধারণ জনগণের আমানত ও সঞ্চয়ের জিম্মাদার। সাধারণত ব্যাংক একটি সুনির্দিষ্ট নীতি কাঠামোর আওতায় ঝুঁকি ব্যবস্থাপনাকে পরিচালন ও নিয়ন্ত্রণ করে, যেখানে বিনিয়োগকারীর স্বার্থ সংরক্ষণের বিষয়টিও নিশ্চিত করা হয়। সর্বোপরি ব্যাংকে জমা অর্থের বিনিময়ে নেতিবাচক সুদহার কোনোভাবেই প্রত্যাশিত নয়। কোভিড-১৯ এর কারণে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার সবচেয়ে জটিল এ পরিস্থিতিতে উচ্চমাত্রার মূলধন বা 'ক্যাপিটাল অ্যাডিকোয়েসি রেশিও' বজায় রাখা ব্যাংকের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। ব্যাংকের দিক দিয়ে দেখতে গেলে উচ্চমাত্রার মূলধন ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণের সামর্থ্য নির্দেশ করে। বর্তমান পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃক নির্ধারিত সর্বনিম্ন ক্যাপিটাল বা মূলধন যথেষ্ট নয়। উপরন্তু, কোনো কোনো ব্যাংকে মূলধনের ঘাটতিও রয়েছে। বিশ্বের উন্নত অন্যান্য দেশের ব্যাংকগুলোর তুলনায় আমাদের দেশের ব্যাংকগুলো ক্যাপিটাল বা মূলধনের দিক দিয়ে অনেকটাই পিছিয়ে, এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার দেশ ভারত ও শ্রীলংকার চেয়েও আমরা পিছিয়ে আছি। আমরা এখন পর্যন্ত বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে পারিনি- যা বিশ্বের অন্যান্য দেশের চেয়ে ব্যতিক্রম নয়। এ রকম পরিস্থিতিতে 'এন্টারপ্রাইজ রিস্ক ম্যানেজমেন্ট' বা 'সমন্বিত ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা' হচ্ছে সবচেয়ে সময়োপযোগী ও কার্যকরী পন্থা- যা ব্যাংকগুলোকে সহায়তা করতে পারে। এ ব্যাপারে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ও শীর্ষ নেতৃত্ব প্রধান ভূমিকা রাখতে পারে। 'সমন্বিত ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা'র অংশ হিসেবে একটি চৌকস দল নিয়মিত তথ্য সংগ্রহ, পর্যবেক্ষণ ও নিরীক্ষণ, পরিচালনা পর্ষদ ও শীর্ষ নেতৃত্বকে অবগতকরণ এবং এসবের ভিত্তিতে পরিস্থিতি বিশ্লেষণমূলক কার্যক্রমে নিয়োজিত থাকবে। পরিচালনা পর্ষদ ও শীর্ষ নেতৃত্ব অনেক বেশি দায়িত্বশীল আচরণ করবে। কোভিড-১৯ এর প্রথম ঢেউয়ের পর বেশ কিছু ব্যাংক এ ধরনের উদ্যোগ নিয়েছিল। বিপর্যয় কাটিয়ে উঠে ব্যাংক খাতে স্থিতিশীল অবস্থা আনার জন্য এ ধরনের কার্যক্রম চলমান রাখা অত্যন্ত জরুরি। সঙ্গে প্রয়োজন বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে যথেষ্ট বিনিয়োগ। কোনো সন্দেহ নেই যে, ডিজিটাল পস্ন্যাটফর্ম নিশ্চিত করা ও তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার একটি প্রয়োজনীয় ও ব্যয়বহুল প্রক্রিয়া। এ রকম নাজুক একটি সময়ে এ খাতে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ সহজ নয়। এক্ষেত্রে পরিচালনা পর্ষদের সহায়তা অত্যন্ত জরুরি। আর সঙ্গে সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সাইবার ঝুঁকি ও পরিচালনগত ঝুঁকি- যা মোকাবিলা না করলে নতুন সমস্যা সৃষ্টি হবে। বিনিয়োগ করতে হবে নতুন পরিস্থিতিতে কার্যকর ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার জন্য দক্ষ, যোগ্য ও মেধাবী জনবল তৈরিতেও। এ অবস্থায় সম্ভাব্য ঝুঁকি ও আর্থিক সামর্থ্যের ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারক ও অংশীদারি পক্ষগুলোর কাছে স্বচ্ছ থাকা জরুরি। ব্যাংক খাতে ঝুঁকিগুলো চিহ্নিতকরণ ও প্রকৃত ক্যাপিটাল বা মূলধনের পরিমাণ নিরূপণ এবং যথেষ্ট পরিমাণ সংরক্ষণ করে আগামী দিনের সম্ভাব্য বিপদ মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুত হওয়ার বিকল্প নেই।

রেজাউল করিম খোকন : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার ও কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে