রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

জৈব কৃষিতে টিসু্য কালচারের ভূমিকা

সামগ্রিকভাবে, জৈব কৃষিতে টিসু্য কালচারের অনেক প্রয়োগ রয়েছে, বিরল এবং বিপন্ন উদ্ভিদ প্রজাতির বংশবিস্তার থেকে শুরু করে কৃত্রিম রাসায়নিক বা জিএমও ব্যবহার ছাড়াই রোগপ্রতিরোধী ফসল উৎপাদন পর্যন্ত।
ফারজানা আকতার : কলাম লেখক
  ০৯ মে ২০২৩, ০০:০০

মানবদেহের সুস্থতা বজায় রাখতে প্রয়োজন কোনো প্রকার কেমিক্যালমুক্ত প্রাকৃতিক পরিবেশে বেড়ে উঠা সবজি, ফলমূল এবং অন্যান্য খাদ্যদ্রবাদি। কৃষিক্ষেত্রই আমাদের খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহের প্রধান উৎস। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে জনসংখ্যা ও প্রাকৃতিক সম্পদের চাহিদা- সঙ্গে সব মৌলিক চাহিদাও।

জৈব কৃষি এমন এক কৃষি ব্যবস্থা- যা সামাজিক এবং আর্থিক উন্নয়নের একটি উপায়। জৈব কৃষি পদ্ধতি প্রাকৃতিক উৎস বা সম্পদের সংরক্ষণ, পরিবেশ ও মানুষের স্বাস্থ্য উন্নয়নের দিকে গুরুত্ব দেয়। ইউএসডিএ ন্যাশনাল অর্গানিক স্ট্যান্ডার্ডস বোর্ড (এনওএসবি) অনুসারে, জৈব কৃষি হলো একটি পরিবেশগত উৎপাদন ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থা- যা জীববৈচিত্র্য, জৈবচক্র এবং মাটির জৈবিক কার্যকলাপকে প্রচার করে এবং বৃদ্ধি করে- যা পরিবেশগত সম্প্রীতি পুনরুদ্ধার, বজায় রাখে বা উন্নত করে। জৈব কৃষির প্রাথমিক লক্ষ্য হলো মাটি, উদ্ভিদ, প্রাণী এবং মানুষের পরস্পর নির্ভরশীল সম্প্রদায়ের স্বাস্থ্য ও উৎপাদনশীলতাকে অপ্টিমাইজ করা।

বর্তমানে জৈব কৃষির চাহিদা বেড়েই চলছে; কেননা, মানুষ এখন পূর্বের থেকে অনেক বেশি সতর্ক ও সচেতন। সুস্থ পরিবেশ ও সুস্বাস্থ্য এখন সবারই কাম্য। সীমিত প্রাকৃতিক সম্পদকে কীভাবে কাজে লাগিয়ে অতিরিক্ত চাহিদা পূরণ করা যায়, সে ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা সর্বদা গবেষণা করে আসছেন। সেইসব গবেষণার মাঝে সফল এক ফলাফল হলো টিসু্য কালচার।

উদ্ভিদের যে কোনো বিভাজনক্ষম অঙ্গ থেকে (যেমন- শীর্ষমুকুল, কক্ষমুকুল, কচিপাতা বা পাপড়ি ইত্যাদি) বিচ্ছিন্ন করে কোনো টিসু্য সম্পূর্ণ জীবাণুমুক্ত অবস্থায় উপযুক্ত পুষ্টির মাধ্যমে বৃদ্ধিকরণ (এবং পূর্ণাঙ্গ চারাউদ্ভিদ সৃষ্টি) করাকে টিসু্য কালচার বলে। অর্থাৎ গবেষণাগারে কোনো টিসু্যকে পুষ্টির মাধ্যমে কালচার করাই হলো টিসু্য কালচার।

টিসু্য কালচার প্রযুক্তির ধাপসমূহ হলো, মাতৃউদ্ভিদ বা এক্সপস্ন্যান্ট নির্বাচন, টিসু্য কালচারের জন্য সুস্থ, নীরোগ ও উৎকৃষ্ট বৈশিষ্ট্যমন্ডিত উদ্ভিদ থেকে টিসু্য সংগ্রহ করা হয। এর পর কালচার মিডিয়াম বা আবাদ মাধ্যম তৈরি, যেখানে বিভিন্ন ধরনের মুখ্য ও গৌণ উপাদান, ভিটামিন, সুকরোজ, ফাইটোহরমোন প্রভৃতি এ মিডিয়ামে থাকা প্রয়োজন। পাত্রটিকে নির্বীজকরণ যন্ত্র দিয়ে জীবাণুমুক্ত করা হয়। মিডিয়ামকে অটোক্লেভ যন্ত্রে নির্দিষ্ট তাপ, চাপ ও সময়ে রাখা হয়। এক্সপস্ন্যান্টকে সম্পূর্ণ নির্বীজ অবস্থায় কাচেরপাত্রে রাখা মিডিয়ামে স্থাপন করা হয়। পাত্রটিকে একটি বৈদু্যতিক আলো, তাপমাত্রা ও আপেক্ষিক আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রিত কক্ষে রাখা হয়। কয়েকদিন পর টিসু্যটি বারবার বিভাজিত হয়ে একটি কোষীয় মন্ডে পরিণত হয়। যে অবয়বহীন অবিন্যস্ত টিসু্যগুচ্ছ সৃষ্টি হয় তাই ক্যালাস। ক্যালাস থেকে এক সময় অসংখ্য মুকুল সৃষ্টি হয়। উপযুক্ত সংখ্যক সুগঠিত মূল সৃষ্টি হলে পূর্ণাঙ্গ চারাগাছ কালচার করা পাত্র থেকে সরিয়ে সাবধানতার সঙ্গে টবে স্থানান্তর করা হয়। এভাবে টিসু্য কালচারের মাধ্যমে চারাগাছ উৎপাদন কাজ সম্পন্ন করা হয়। মুকুলগুলোকে সাবধানে কেটে নিয়ে মূল উৎপাদনকারী মিডিয়ামে রাখা হয় এবং সেখানে প্রতিটি মুকুল, মূল সৃষ্টি করে পূর্ণাঙ্গ চারাগাছে পরিণত হয়। টবসহ চারাগাছকে কিছুটা আর্দ্র পরিবেশে রাখা হয়, তবে রোপিত চারাগাছগুলো কক্ষের বাইরে রেখে মাঝে মাঝে বাইরের প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হয়। পূর্ণাঙ্গ চারাগাছগুলো সজীব ও সবল হয়ে উঠলে সেগুলোকে একপর্যায়ে প্রাকৃতিক পরিবেশে মাটিতে লাগানো হয়। এই সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটিতে কোনোরকম কেমিক্যাল কীটনাশক ব্যবহূত হয় না এবং নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে সম্পন্ন করা হয় বলে রোগমুক্ত থাকে। সেজন্য এ পদ্ধতিতে সব থেকে উচ্চমানের ফসল পাওয়া সম্ভব।

সাধারণভাবে, শস্য উৎপাদন বা পণ্য তখনই জৈবকৃষির আওতায় পরবে, যখন পুরো প্রক্রিয়া জেনেটিক পরিবর্তন থেকে মুক্ত হবে, প্রচলিত সার এবং কীটনাশক ছাড়া বৃদ্ধি পাবে, খাদ্য সংযোজন বা আয়নাইজিং বিকিরণ ছাড়াই প্রক্রিয়াজাত করা হয়। জৈব কৃষিতে টিসু্য কালচারের এক অনবদ্য ভূমিকা রয়েছে- যার মাধ্যমে একটি ফসলের চারা থেকে শুরু করে পরিপক্ব হওয়া অবধি সম্পূর্ণরূপে প্রাকৃতিক উপায়ে প্রস্তুত হয়ে থাকে।

রোগমুক্ত উদ্ভিদ উপাদান: বহু বছর পূর্ব থেকেই গতানুগতিক কৃষিতে নানা ধরনের রোগমুক্ত করে ফলন বৃদ্ধির জন্য কীটনাশকের ব্যবহার আমরা ব্যাপকহারে দেখতে পাই। দিনের পর দিন এর চাহিদা বেড়েই চলছে। কিন্তু কীটনাশকের ক্ষতিকর দিকগুলো আমরা যেন ভাবতে পারিনি আগে। ফসলে কীটপতঙ্গ আক্রমণ করবে, নানা ধরনের রোগ হবে এটা প্রাকৃতিক নিয়ম, কিন্তু মানব চাহিদা যে হারে বেড়ে চলছে সেই হারের সঙ্গে খাদ্য উৎপাদন বজায় রাখতে আমরা ব্যবহার করি নানা ধরনের কেমিক্যাল কীটনাশক। কিন্তু এই কীটনাশক কৃষি ক্ষেত্রে ব্যবহারের পর মাটির সঙ্গে এবং পানির সঙ্গে মিশে গিয়ে দূষণ ঘটায়। এমন কিছু কীটনাশক আছে- যা দীর্ঘদিন পরিবেশে অবস্থান করে দূষিত করতে থাকে; যেমন উউঞ, উরবষফৎরহ, অষফৎরহ ইত্যাদি। এই কেমিক্যাল কীটনাশকগুলো মাটিতে থেকে বৃষ্টির পানির মাধ্যমে আশপাশের জলাশয় এ প্রবেশ করে, ফলে জলাশয়ের পানির গুণগত মান নষ্ট হয়ে যায়। দূষিত পানিতে প্রাকৃতিক ইকোসিস্টেমটা নষ্ট হতে শুরু করে এবং মাছগুলো খাবার যোগ্য থাকে না। মাছের মধ্যে কেমিক্যাল জমা হয়, পরিশেষে আমরা সেই মাছ বেশি পরিমাণে খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করলে আমরা সেই কেমিক্যাল বেশি হারে গ্রহণ করতে থাকি- যাকে বলা হয় বায়োএকুমুলেশন, ফলস্বরূপ মানুষ বেশি ক্ষতির শিকার হচ্ছে। এই সমস্যা দূর করতেই জৈব কৃষি এগিয়ে আসছে, যেখানে টিসু্য কালচারের মাধ্যমে রোগমুক্ত ফসল তৈরি করে। টিসু্য কালচার প্যাথোজেনমুক্ত উদ্ভিদ উপাদান তৈরি করতে পারে- যা জৈব চাষের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে সিন্থেটিক কীটনাশক এবং ছত্রাকনাশক অনুমোদিত নয়। এর কারণ হলো টিসু্য-কালচার গাছগুলো প্রায়ই সাধারণভাবে প্রচারিত গাছের তুলনায় কীটপতঙ্গ এবং রোগ প্রতিরোধী হয়- যা রাসায়নিক কীটনাশকের প্রয়োজনীয়তা হ্রাস করে।

দ্রম্নত বংশবিস্তার: টিসু্য কালচার একটি একক উপাদান থেকে দ্রম্নত প্রচুর পরিমাণে উদ্ভিদ উৎপাদন করতে পারে। এটি বিরল বা মূল্যবান উদ্ভিদ প্রজাতির দক্ষ বংশবিস্তার করেতে পারে, বা বাণিজ্যিক পরিবেশে ব্যবহারের জন্য বিপুলসংখ্যক উদ্ভিদের দ্রম্নত উৎপাদন করে থাকে। যার ফলে বর্ধিত চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে। স্বল্প ভূমি কিন্তু উৎপাদন বৃদ্ধিও সমস্যার সমাধান একমাত্র টিসু্য কালচারের মাধ্যমেই এখন সফল হচ্ছে।

টিসু্য কালচার ঋতু নির্বিশেষে জৈব কৃষকদের সারা বছর ফসল উৎপাদনে সহায়তা করতে পারে। এর কারণ হলো টিসু্য কালচার কৃষকদের একটি নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে গাছপালা বৃদ্ধি করতে দেয়, যার মানে তারা উদ্ভিদের বৃদ্ধিকে অনুকূল করতে তাপমাত্রা, আলো এবং আর্দ্রতার মতো বিষয়গুলো নিযন্ত্রণ করতে পারে।

উন্নত উদ্ভিদ কর্মক্ষমতা: টিসু্য কালচার উদ্ভিদের পছন্দসই বৈশিষ্ট্য যেমন রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বা মান বৃদ্ধির জন্য বৈশিষ্ট্য নির্বাচন করতেও ব্যবহার করা যেতে পারে। এটি ফসলের ফলন এবং গুণমান উন্নত করতে পারে।

বিরল বা বিপন্ন প্রজাতির সংরক্ষণ: টিসু্য কালচার বিরল বা বিলুপ্তপ্রায় উদ্ভিদ প্রজাতি সংরক্ষণ ও প্রচারের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে- যা তাদের সংরক্ষণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। জৈব কৃষিতে টিসু্য কালচারের একটি প্রাথমিক সুবিধা হলো এটি বিরল বা বিপন্ন উদ্ভিদ প্রজাতির বংশবৃদ্ধির অনুমতি দেয়। এটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ এই গাছগুলো নানা পদ্ধতিতে প্রচার করা কঠিন, টিসু্য কালচার দ্রম্নত এবং দক্ষতার সঙ্গে এই গাছগুলোর বিপুলসংখ্যক উৎপাদন করার একটি উপায় প্রদান করে।

সামগ্রিকভাবে, জৈব কৃষিতে টিসু্য কালচারের অনেক প্রয়োগ রয়েছে, বিরল এবং বিপন্ন উদ্ভিদ প্রজাতির বংশবিস্তার থেকে শুরু করে কৃত্রিম রাসায়নিক বা জিএমও ব্যবহার ছাড়াই রোগপ্রতিরোধী ফসল উৎপাদন পর্যন্ত।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে