রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

জনসংখ্যাকে সম্পদে পরিণত করতে হবে

শহুরে অর্থনীতির পাশাপাশি গ্রামীণ অর্থনীতি বিকাশে প্রবাসী আয় বড় ধরনের ভূমিকা রাখছে।
অন্‌জন কুমার রায়
  ১১ মে ২০২৩, ০০:০০

বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ হিসেবে চলতি বছরের মধ্যবর্তী সময়ে চীনকে টপকাতে যাচ্ছে ভারত। দেশটির মোট জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি ৩০ বছরের কম। অর্থাৎ কর্মক্ষম তরুণদের সংখ্যা বেশি। ২০২৫ সাল নাগাদ দেশটির জনসংখ্যায় কর্মক্ষম বয়সি মানুষের অনুপাত হবে সর্বোচ্চ। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম এ কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী শুধু ভারত নয়, প্রতিটি দেশই কোনো না কোনো পর্যায়ে এই শিখরে পৌঁছায়। একটি নির্দিষ্ট সময় পর তা আবার কমতে শুরু করে। প্রতিটি দেশের অর্থনীতিও এই শিখরকে কেন্দ্র করে উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়। যার সুফল ভোগ করছে হংকং, জাপান, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ড, তাইওয়ানসহ আরো অনেক দেশ। অর্থাৎ ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বা জনমিতি যথাযথভাবে কাজে লাগিয়ে দেশসমূহের অর্থনীতিতে বিস্ময়কর উত্থান হয়েছে।

একটি দেশের জনসংখ্যার বয়সভিত্তিক কাঠামো অনুযায়ী কর্মক্ষম জনসংখ্যা (১৫-৬৪ বছর) যখন নির্ভরশীল জনসংখ্যাকে (০-১৪ বছর এবং ৬৫ বছরের ঊর্ধ্বে) অতিক্রম করে তখন ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরো (বিবিএস) প্রকাশিত সর্বশেষ চূড়ান্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯৮ লাখ ২৮ হাজার ৯১১ জন। মোট জনসংখ্যার ২৮ শতাংশ তরুণ যাদের সংখ্যা ৪ কোটি ৭৪ লাখ। অপরদিকে, কর্মক্ষম জনসংখ্যা ৬২ শতাংশ যাদের বয়স ১৫ থেকে ৫৯ বছরের মধ্যে, সংখ্যায় যা ১০ কোটি ৫০ লাখ। ২০০৭ সাল থেকে বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড সুবিধা ভোগ করে আসছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এ সুবিধা ২০৩৮ সাল পর্যন্ত চলমান থাকবে। সে অনুসারে বর্তমানে আমরা ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের মধ্যবর্তী সময়ে অবস্থান করছি।

একটি দেশের মোট জনসংখ্যার কর্মক্ষম জনসংখ্যা বেশি হলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে গুরুত্বর্পূণ ভূমিকা রাখে তরুণ জনগোষ্ঠী। তরুণদের বিপুল অংশ সম্ভাবনার সুযোগ হিসেবে গণ্য হবে যদি প্রতিটি কর্মক্ষম মানুষকে উপযুক্ত কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করে দেয়া যায়। সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে দেশের কর্মক্ষম জনগণকে ব্যবহার করতে পারলে অর্থনৈতিক প্রবৃিদ্ধর ধারাসহ সামাজিক অন্যান্য সূচকগুলোর উন্নয়ন হবে। অর্থাৎ জিডিপি থেকে শুরু করে সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগ, রেমিট্যান্স আহরণ, দারিদ্র্য নিরসন, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, মানবসম্পদ উন্নয়ন, ডিজিটাল বাংলাদেশ, স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণসহ ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড হতে পারে বিরাট সুযোগ। তাই এ কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীকে উৎপাদনশীল কাজে নিয়োজিত করে দেশের অর্থনীতিকে চাঙা করার সুযোগকে কাজে লাগাতে হবে। সেজন্য বর্তমান বাজার ব্যবস্থায় চতুর্থ শিল্পবিপস্নবকে সামনে রেখে তারুণ্যকে চাকরির বাজারের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে ডিজিটাল প্রযুক্তি ও কারিগরি শিক্ষার ওপর জোর দিতে হবে। এছাড়াও ২০২৬ সালে এলডিসি থেকে উত্তরণ ঘটলে অনেক বাজার সুবিধা থাকবে না। সেক্ষেত্রে প্রতিযোগিতামূলক বাজার ব্যবস্থায় সক্ষমতার জন্য দক্ষতার ভিত্তিতে তরুণদের গড়ে তোলতে হবে।

\হদেশের জনসংখ্যাকে সম্পদে পরিণত করতে কাজ করছে সরকার। স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সূচকগুলোতে বিস্ময়কর উন্নয়ন ঘটেছে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রসহ অন্যান্য খাতে সাফল্যের পেছনে কয়েক দশকে জনসংখ্যার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা বড় ভূমিকা রেখেছে। বিগত বছরগুলোর তুলনায় সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে বিনিয়োগের হার বেড়েছে। তাতে কর্মক্ষম মানুষের জন্য যেমন নতুন কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি হয়েছে তেমনি অর্থনৈতিক খাতেও গতিশীলতা বেড়েছে।

আশার কথা, করোনাপরবর্তী সময়েও তরুণদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে উলেস্নখযোগ্য সংখ্যক জনবল নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া বিভিন্ন সেক্টরে নতুন নতুন কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি হচ্ছে। তবে, আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহ অর্থনৈতিক চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে। নতুন নতুন উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে ব্যাংকগুলো ব্যাপক ভূমিকা পালন করছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে উদ্যোক্তা খোঁজে ঋণ প্রদানে ব্যাংকগুলো উদ্বুদ্ধ করছে। ফলে, ঋণ গ্রহণে পুরুষদের পাশাপাশি মহিলা উদ্যোক্তারাও এগিয়ে আসছে। নারী বা পুরুষ স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি বহু লোকের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের এক সমীক্ষা অনুযায়ী, আমাদের দেশে শ্রমশক্তিতে নারীদের অংশগ্রহণের হার ৪৫% এ উন্নীত করা হলে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অতিরিক্ত বাড়বে শতকরা এক ভাগ। বিবিএসের সর্বশেষ জরিপের তথ্যমতে, ২০২২ সালে বাংলাদেশের শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ ৪২.৬৮ শতাংশ। তাই, একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনে নারীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

দ্রম্নত রূপান্তরশীল বিশ্ব ম্যানুফ্যাকচারিং বাজার থেকে পূর্ণ সুবিধা পেতে বাংলাদেশে প্রযুক্তি, পুঁজি ও নিবিড় উৎপাদন দক্ষতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়াও শিল্পায়নের ফলে প্রতি বছর দেশে প্রায় ২১ লাখ তরুণের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে। ইতোমধ্যে বিনিয়োগের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে সারাদেশে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার পরিকল্পনা চলমান রয়েছে। প্রতি বছর নতুন নতুন কলকারখানা গড়ে উঠছে। তাতে শ্রমশক্তির কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের বহু আকাঙ্ক্ষিত পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের ফলে দেশে সামগ্রিকভাবে ব্যবসাক্ষেত্রে অগ্রগতি সাধিত হচ্ছে- যা অর্থনীতিতে গুরুত্বপূূর্ণ ভূমিকা রাখছে। শিল্পায়নে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর দক্ষতা কাজে লাগানো হচ্ছে মূল লক্ষ্য।

তবে, প্রযুক্তি এনে দেয় নতুন মাত্রা। চাকরিদাতারা চায় সৃষ্টিশীল চিন্তার সমস্যার সমাধান এবং তথ্যপ্রযুক্তি ও দক্ষতাগত জ্ঞান অর্জন করা। ৫০ বছর আগের প্রযুক্তি এবং বর্তমান সময়ের প্রযুক্তি অনেক পার্থক্য গড়ে দেয়। অন্যদিকে, কোভিড-১৯ জনিত কারণে প্রযুক্তিগত চাহিদা আরো বেড়ে যায়। তাই, দেশের আইটি শিল্পের প্রসার ও কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে বিভিন্ন স্থানে হাইটেক পার্ক বা সফটওয়্যার টেকেনোলজি স্থাপন করা হচ্ছে। এছাড়াও সরকারি দপ্তরসমূহে ইন্টার্নশিপ চালু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাতে সদ্য গ্র্যাজুয়েট অর্জন করা তরুণদের সমস্যা সমাধানের দক্ষতা, চিন্তার দক্ষতা এবং নেতৃত্বের গুণাবলি বাড়বে- যা দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে সহায়তা করবে। পাশাপাশি বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে নতুন নতুন কর্মক্ষেত্র সৃষ্টির ফলে দেশে কর্মসংস্থান বাড়ছে।

শহুরে অর্থনীতির পাশাপাশি গ্রামীণ অর্থনীতি বিকাশে প্রবাসী আয় বড় ধরনের ভূমিকা রাখছে।

\হবিএমইটি'র এক তথ্যমতে, ২০১৯ সালে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৭ লাখ কর্মী বিদেশ যান। ২০২০ সালে করোনার জন্য ২ লাখ ১৮ হাজারে নেমে আসে। পরবর্তী সময়ে ২০২১ সালে ৬ লাখ ১৭ হাজার কর্মী বিদেশে যান। ২০২২ সালে ১১ লাখ ৩৬ হাজার কর্মী এবং চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে ৩ লাখ ২৩ হাজার কর্মী বিদেশ গমণ করেন। চতুর্থ শিল্পবিপস্নবের প্রভাবে ইউরোপসহ সারা বিশ্বে দক্ষ কর্মীর চাহিদা তৈরি হচ্ছে। সেক্ষেত্রে, প্রবাসী আয় বৃদ্ধির জন্য বিশেষ কৌশল নির্ধারণ করে দক্ষ কর্মী তৈরি করা আবশ্যক। সে চাহিদা পূরণকল্পে প্রয়োজনে কারিকুলামে পরির্বতন এনে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। শিক্ষা ও কর্মভিত্তিক প্রশিক্ষণে যথোপযুক্ত বিনিয়োগ ও প্রণোদনার মাধ্যমে এই কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীকে একটি সুশিক্ষিত ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শ্রমশক্তিতে রূপান্তর করতে হবে। প্রশিক্ষণ কৌশলের লক্ষ্য হবে কর্মসংস্থান উপযোগী দক্ষতা। এছাড়াও চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন স্কিল ডেভেলপ করতে হবে।

জনমিতির এ সুবিধা যথাযথ কাজে লাগানোর একটি নির্দিষ্ট সময় থাকে। জন্মহার হ্রাস ও স্বাস্থ্যসেবার উন্নতির কারণে পূর্বের কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীই ৩-৪ দশক পর সমাজ তথা দেশের জন্য বোঝা হিসেবে পরিগণিত হবে। অর্থাৎ ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড পিরিয়ড শেষ হলে নির্ভরশীল জনসংখ্যা বাড়তে থাকে। তাই, জনমিতির নির্দিষ্ট সময়ে সঠিক ব্যবস্থার মাধ্যমে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধারা বজায় রাখাই মূল লক্ষ্য। এছাড়াও ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি বাস্তবায়নসহ ২০৪১ সাল নাগাদ উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার যে স্বপ্ন তা নির্ভর করছে যথাযথ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ওপর। তা অনেকটাই এগিয়ে থাকবে যদি ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বা জনমিতিক লভ্যাংশকে যথাযথভাবে কাজে লাগানো যায়।

অন্‌জন কুমার রায় : ব্যাংক কর্মকর্তা ও কলামিস্ট

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে