রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

সমুদ্র অর্থনীতির অপার সম্ভাবনা

সমুদ্র অর্থনীতির ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল এখন চীন, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ অনেক দেশ। এ মুহূর্তে ক্ষুদ্র নগর রাষ্ট্র সিঙ্গাপুরের জিডিপির ৪০ ভাগ সমুদ্রনির্ভর। ইন্দোনেশিয়া ৭৫ হাজার মানুষের নতুন কর্মসংস্থানসহ বছরে ১১৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয়ের কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। অস্ট্রেলিয়া সমুদ্রসম্পদ ও সমুদ্রনির্ভর পর্যটনের মাধ্যমে ৪৭.২ বিলিয়ন অস্ট্রেলিয়ান ডলার আয় করছে। যা তাদের জিডিপির ৩ শতাংশের বেশি। চীনের মোট জিডিপির ১০ শতাংশ আসছে সমুদ্র অর্থনীতি থেকে। বাংলাদেশকে এ খাত এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে সফল দেশগুলোকে অনুসরণ করতে হবে।
দয়াল কুমার বড়ুয়া
  ১২ মে ২০২৩, ০০:০০

ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা সংক্রান্ত বিরোধের সালিশে বিপুলভাবে লাভবান হয়েছে বাংলাদেশ। এ সালিশে বাংলাদেশের আয়তনের প্রায় কাছাকাছি বিপুল সমুদ্রসীমায় বাংলাদেশের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু অধিকার প্রতিষ্ঠার ১১ বছরেও বাংলাদেশের সমুদ্রসম্পদ আহরণের মাত্রা প্রায় শূন্য। বলা হয়, বঙ্গোপসাগরের তলে রয়েছে মূল্যবান খনিজ ও প্রাণিজসম্পদের বিপুল সম্ভার। বিলিয়ন ডলার আয়ের সুযোগ রয়েছে শুধু সমুদ্র পর্যটন থেকেই। হংকং, জাপান, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, চীনের মতো সমুদ্রঘেঁষা দেশগুলোর ভিত মজবুত করেছে সমুদ্র অর্থনীতি। সমুদ্র অর্থনীতির মাধ্যমে দেশকে সমৃদ্ধ করার সুযোগ থাকলেও আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় এখন পর্যন্ত আসল কাজটিই শুরু করা সম্ভব হয়নি। কীভাবে সমুদ্রসম্পদ আহরণ করা হবে তার পথই উন্মোচিত হয়নি। বিশেষজ্ঞদের মতে, ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটারের বেশি সমুদ্র এলাকার দখল পাওয়া দেশের জন্য এক বড় অর্জন। সমুদ্র অর্থনীতির ওপর ভর করে দেশের জিডিপি নিয়ে যাওয়া সম্ভব ১০ শতাংশের ওপরে। ২০৪১ সালে উন্নত দেশের কাতারে বাংলাদেশকে দাঁড় করাতে বড় অবদান রাখতে পারে নীল অর্থনীতি। যত তাড়াতাড়ি এ সম্পদ ব্যবহার করা যাবে ততই মঙ্গল। কিন্তু এত বড় একটি ক্ষেত্রকে সমন্বয় করতে ১১ বছরেও পৃথক কোনো কর্তৃপক্ষ গড়ে ওঠেনি। পর্যটন, বাণিজ্য, জ্বালানি, পররাষ্ট্র, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, নৌপরিবহণ, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়সহ আরও অনেক মন্ত্রণালয় বস্নু-ইকোনমির সঙ্গে সম্পর্কিত। প্রতিটি মন্ত্রণালয় আলাদাভাবে প্রকল্প প্রণয়ন এবং গবেষণার নামে সরকারি অর্থের খরচই শুধু নিশ্চিত করছে, সমুদ্র অর্থনীতিকে এক ইঞ্চিও এগিয়ে নিতে পারছে কিনা সন্দেহ। বঙ্গোপসাগরে নিজেদের অংশ থেকে মিয়ানমার গ্যাস উত্তোলন করে রপ্তানিও করছে। বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার গ্যাস উত্তোলন নিয়ে চলছে সিদ্ধান্তহীনতা। এ সংকটের অবসানে সমুদ্র অর্থনীতির স্বতন্ত্র মন্ত্রণালয় গড়ে তোলার কথা ভাবতে হবে। কোনো সময় ক্ষেপণই আর কাম্য নয়।

সমুদ্র অর্থনীতি পাল্টে দিতে পারে বাংলাদেশকে। বাংলাদেশকে নিয়ে যেতে পারে সমৃদ্ধির সোনালি শিখরে। এ খাতটিকে ঠিকমতো ব্যবহার করা গেলে বাংলাদেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশে উন্নীত করা সম্ভব। ২০৪১ সালে উন্নত দেশের কাতারে বাংলাদেশকে দাঁড় করাতে সবচেয়ে বড় অবদান রাখতে পারে সমুদ্র অর্থনীতি। ২০১২ সালের ১৪ মার্চ আন্তর্জাতিক সালিশি আদালতের রায়ে মিয়ানমারের সঙ্গে মামলায় বাংলাদেশ প্রায় ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটারের বেশি সমুদ্র এলাকার দখল পায়। ২০১৪ সালের ৮ জুলাই ভারতের সঙ্গে বিরোধপূর্ণ সমুদ্রসীমার প্রায় ২৫ হাজার ৬০২ বর্গকিলোমিটারের মধ্যে ১৯ হাজার ৪৬৭ বর্গকিলোমিটারের অধিকার পায় বাংলাদেশ। এরপরই সমুদ্রসম্পদ আহরণ ও গবেষণায় সরকার নানা উদ্যোগ নেয়। সমুদ্রসীমা অর্জনের পরের বছরই ২০১৩ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশ। সামুদ্রিকসম্পদ আহরণ এবং এর যথাযথ ব্যবস্থাপনায় ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিবকে আহ্বায়ক করে কমিটি গঠন করা হয়। ২০১৫ সালে সমুদ্রসম্পদ গবেষণায় প্রতিষ্ঠা করা হয় বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট। ২০১৭ সালে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে গঠন করা হয় 'বস্নু-ইকোনমি সেল।'

বাংলাদেশের সমুদ্রসীমাকে বলা হয় মাছের সোনালি ক্ষেত্র। বঙ্গোপসাগর থেকে প্রতি বছর ধরা হয় ৮০ লাখ টন মাছ। অথচ সবচেয়ে সমৃদ্ধ এলাকার অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগর থেকে মাছ শিকার করছে বছরে গড়ে মাত্র সাত লাখ টন। এটি দেশে উৎপাদিত মোট মাছের সাত ভাগের এক ভাগ মাত্র। সমুদ্রসীমা নিয়ে ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে বিরোধ মীমাংসার পর বঙ্গোপসাগরের বিশাল এলাকার মালিকানা পেয়েছে বাংলাদেশ। প্রায় বাংলাদেশের ভূ-ভাগের সমান সমুদ্রসীমার অধিকারী হওয়া সম্ভব হয়েছে। এর ফলে ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটারের বেশি টেরিটোরিয়াল সমুদ্র, ২০০ নটিক্যাল মাইল একচ্ছত্র অঞ্চল এবং চট্টগ্রাম উপকূল থেকে ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহীসোপানের তলদেশে অবস্থিত সব ধরনের প্রাণিজ ও অপ্রাণিজ সম্পদের ওপর সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যার ফলে সমুদ্রসীমার বিপুল সম্পদ আহরণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে সরকার যাকে বলা হচ্ছে বস্নু-ইকোনমি বা সমুদ্রসম্পদ নির্ভর অর্থনীতি।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় তেল ও গ্যাস রয়েছে বলে আশা করা হচ্ছে। এখানে নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার হলে সেটা দেশের জন্য বস্নু-ইকোনমির আরেকটি বড় শক্তি হয়ে উঠবে। তেল ও গ্যাস ছাড়াও বঙ্গোপসাগরের বাংলাদেশ অংশে সালফার, মেটালিক মডিউল, কোবাল্ট পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় অনুসন্ধান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ গ্যাস হাইড্রেট বা মিথেন গ্যাসের জমাট স্তরের উপস্থিতি নিশ্চিত হওয়া গেছে। বিশেষজ্ঞদের গবেষণায় বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার একান্ত অর্থনৈতিক এলাকার ০.১১ থেকে ০.৬৩ ট্রিলিয়ন কিউসিক ফুট সম্ভাব্য প্রাকৃতিক গ্যাস হাইড্রেট থাকার বিষয়টি অনুমিত হয়েছে- যা ১৭ থেকে ১০৪ ট্রিলিয়ন কিউবিক ফুট প্রাকৃতিক গ্যাস সম্পদের সমান। বাংলাদেশ জ্বালানি সংকটের শিকার একটি দেশ। স্থলভাগে মজুত প্রাকৃতিক গ্যাস শেষ হওয়ার পথে। সাগর প্রান্তে গ্যাস পেলে দেশের অগ্রগতির চাকা আরো বেগবান করা সম্ভব হবে। বস্নু-ইকোনমির কল্যাণে বাংলাদেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধ হবে এমনটিও আশা করা হচ্ছে ব্যাপকভাবে।

সমুদ্র অর্থনীতির ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল এখন চীন, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ অনেক দেশ। এ মুহূর্তে ক্ষুদ্র নগর রাষ্ট্র সিঙ্গাপুরের জিডিপির ৪০ ভাগ সমুদ্রনির্ভর। ইন্দোনেশিয়া ৭৫ হাজার মানুষের নতুন কর্মসংস্থানসহ বছরে ১১৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয়ের কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। অস্ট্রেলিয়া সমুদ্রসম্পদ ও সমুদ্রনির্ভর পর্যটনের মাধ্যমে ৪৭.২ বিলিয়ন অস্ট্রেলিয়ান ডলার আয় করছে। যা তাদের জিডিপির ৩ শতাংশের বেশি। চীনের মোট জিডিপির ১০ শতাংশ আসছে সমুদ্র অর্থনীতি থেকে। বাংলাদেশকে এ খাত এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে সফল দেশগুলোকে অনুসরণ করতে হবে।

দয়াল কুমার বড়ুয়া : কলামিস্ট ও রাজনীতিবিদ।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে