রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

ব্যাঙ্কাসুরেন্স : প্রায়োগিক ভাবনা

ব্যাঙ্কাসুরেন্স, ইন্সু্যরটেক, ব্রোকারেজ, করপোরেট এজেন্ট ইত্যাদির সফল বাস্তবায়ন কামনা করি। তবে সব বিষয়ের সুবিধা-অসুবিধা ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া যেসব দেশে এই প্রক্রিয়াগুলো চালু আছে তা পর্যবেক্ষণ করে আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে সে অভিজ্ঞতার আলোকে নিয়ম-নীতি প্রণয়ন করা বাঞ্ছনীয় বলে মনে করি। সেই সঙ্গে বীমা কোম্পানিগুলোতে বীমা পেশায় কর্মরতদের আর্থিক নিরাপত্তার বিষয়টিও বিবেচনায় নেওয়ার অনুরোধ জানাচ্ছি।
মীর নাজিম উদ্দিন আহমেদ
  ২৯ মে ২০২৩, ০০:০০

বর্তমান ডিজিটাল যুগে বীমার আধুনিকীকরণ অত্যন্ত জরুরি। সেদিকটি বিবেচনা করে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের যৌথ উদ্যোগে ব্যাঙ্কাসুরেন্সের কার্যক্রম বাস্তবায়নের পথে। দেশে সরকারি ও বেসরকারি নন-লাইফ বীমা কোম্পানি ৪৬টি ও লাইফ বীমা কোম্পানি ৩৫টি, পক্ষান্তরে সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংক রয়েছে ৬২টি। ব্যাঙ্কাসুরেন্সের প্রস্তাবনা অনুসারে প্রতিটি ব্যাংক ০৪টি নন-লাইফ ও ০৪টি লাইফ বীমা কোম্পানির সঙ্গে করপোরেট এজেন্ট হিসেবে চুক্তিবদ্ধ হতে পারবে।

আরো উলেস্নখ্য যে, ব্যাংক করপোরেট এজেন্ট হিসেবে অ্যাকাউন্টহোল্ডার বা গ্রাহকের নিকট লাইফ এবং নন-লাইফ বীমা কোম্পানির বীমা পরিকল্প বিক্রয়ের জন্য বিপণন চ্যানেলসমূহ যেমন: শাখা, টেলিমার্কেটিং, এজেন্ট ব্যাংকিং, ওয়েবসাইট, অ্যাপস ইত্যাদির মাধ্যমে বীমা সুবিধার প্রস্তাবনা, বিজ্ঞাপন, বিক্রয়, বিতরণ অথবা বাজারজাতকরণ করতে পারবে। এই নির্দেশনা অনুযায়ী বীমা বিপণনে ব্যাংক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। সেবিবেচনায় বীমা ব্যবসা অনেকটা ব্যাংক নির্ভর হয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

বেসরকারি নন-লাইফ বীমা কোম্পানিগুলো এজেন্টের মাধ্যমে সব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ব্যবসা সংগ্রহ করে থাকে। যখনই ব্যাংক বীমা কোম্পানির করপোরেট এজেন্ট হিসেবে কাজ শুরু করবে তখন বীমা কোম্পানিতে বর্তমানে বিদ্যমান এজেন্ট ও উন্নয়ন কর্মকর্তাদের ব্যাংক থেকে ব্যবসা সংগ্রহ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। ফলে ব্যক্তি ও পরিবার আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং সমাজে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করবে।

বাংলাদেশে বেকারত্ব একটি অন্যতম আর্থসামাজিক সমস্যা। বীমা কোম্পানিগুলো লাখ লাখ এজেন্ট নিয়োগের মাধ্যমে এই বেকারত্ব লাঘবে কাজ করে যাচ্ছে। ব্যাঙ্কাসুরেন্স এর কারণে এজেন্ট নিয়োগ নয় বরং এজেন্টদের এই পেশা ছেড়ে চলে যেতে হতে পারে।

গত ৩ মে, ২০২৩ইং তারিখে বিআইপিএস-এর পূণর্মিলনী অনুষ্ঠানে শ্রদ্ধেয় সোহরাব হোসেন স্যার বলেছিলেন, তিনি ১০-১২ বছর আগে ব্যাঙ্কাসুরেন্স বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন তখন কেহ আগ্রহ দেখায়নি। বর্তমানে সে বীমার বিষয়েই বাংলাদেশ ব্যাংক আগ্রহ দেখাচ্ছে, এটা খুবই খুশির বিষয়।

গত ০৮ মে, ২০২৩ইং তারিখে বাংলাদেশ ইন্সু্যরেন্স এসোসিয়েশন ও বিমটেক কর্তৃক ঢাকা শেরাটন হোটেলে দিনব্যাপী এক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। চারটি সেশনে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। শেষ সেশনে ব্যাঙ্কাসুরেন্স, হেলথ ইন্সু্যরেন্স ও মাইক্রো ইন্সু্যরেন্সের ব্যাপারে বেশ প্রাণবন্ত আলোচনা হয়।

'প্রিফারড পার্টনার ইন্সু্যরেন্স ব্রোকার'-এর প্রতিনিধি সামিরণ লাহিড়ীর সঞ্চালনায় বিভিন্ন বক্তা আলোচনায় অংশ নেন। তার মধ্যে অন্যতম হলেন ডা. রাকেশ আগারওয়াল, যিনি 'দি ইন্সু্যরেন্স টাইমস এবং ব্যাংকিং ফিন্যান্স'-এর এডিটর, তিনি সঞ্চালকের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে বলেন ভারতে ব্যাঙ্কাসুরেন্স ব্যবসা ধীরে ধীরে বাড়ছে- তবে আগে ব্যাংক থেকে ব্যবসা করাটা যতটা সহজ ছিল এখন ততটাই কঠিন। ব্যাংক এখন এজেন্ট কমিশনের বাইরে আরো অনেক প্রত্যাশা করে এবং এই ব্যাপারে বার্গেনিং করে অতিরিক্ত অনেক কিছু আদায় করে নেয়- যা ব্যাঙ্কাসুরেন্স চালুর আগের অবস্থার চেয়েও খারাপ। অনেক সুযোগ-সুবিধা না দিলে ব্যাংক থেকে ব্যবসা পাওয়া যায় না।

আলোচনাকালে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে দুইজন সিইও এই ব্যাপারে বিভিন্ন বিষয় জানতে চাইলে সঞ্চালক এবং ডা. আগরওয়াল ভারতের ব্যাঙ্কাসুরেন্সের অভিজ্ঞতা বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ব্যাঙ্কাসুরেন্স চালুর পূর্বেই শেয়ার করার পরামর্শ দেন।

জনসংখ্যার স্বল্পতার কারণে ইউরোপের মুষ্টিমেয় কয়েকটি দেশে মোটামুটি ব্যাঙ্কাসুরেন্স ফরমেটে জীবন বীমা ইন্সু্যরেন্স জনপ্রিয়তা পেলেও বেশির ভাগ দেশেই ব্যাঙ্কাসুরেন্স এখনো তেমনভাবে জনপ্রিয় হয়নি। তাছাড়া আমাদের দেশের মতো জনবহুল দেশের লোকজনের কর্মসংস্থান যেখানে একটি বড় সমস্যা সেখানে এই ব্যবস্থা চালু হলে অনেক এজেন্ট/উন্নয়ন কর্মকর্তা বেকার হয়ে পড়ার সম্ভাবনা দেখা দেবে।

অপরদিকে, ব্যাংকের আয় বাড়বে। এজেন্ট/উন্নয়ন কর্মকর্তা না থাকাতে কোম্পানিগুলোর শাখা করার দরকার হবে না। ফলে ওভারহেড কষ্ট কমবে কিন্তু বীমা ব্যবসা অনেকটা ব্যাংকের কাছে জিম্মি হয়ে যাবে ও অনেক বীমা কোম্পানির প্রিমিয়াম ইনকাম কমে যাবে।

বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক বাজারে সব ব্যাংকই সমান সফলতার সঙ্গে ব্যবসা করতে পারছে না। বীমা কোম্পানির মতো বহু দুর্বল ব্যাংকও রয়েছে। যে সব বীমা কোম্পানি ব্যবসা সফল ব্যাংকের সঙ্গে করপোরেট চুক্তিবদ্ধ হতে পারবে, তারা ভালো ব্যবসা করতে পারবে আর যারা মানসম্পন্ন ব্যাংকের সঙ্গে করপোরেট চুক্তি করতে পারবে না তাদের ব্যবসায় ধ্বস নামবে।

তাছাড়া ব্যাংকগুলো ব্যবসা দেওয়ার অজুহাতে এখন সব বীমা কোম্পানি থেকে ডিপোজিট কালেকশন করে থাকে। ব্যাঙ্কাসুরেন্স চালু হলে তাদের ডিপোজিট সংগ্রহে অনেকটা ভাটা পড়বে। তারা ইচ্ছা করলেও নির্ধারিত ০৪ (চার)টি লাইফ ও ০৪ (চার)টি নন-লাইফ বীমা কোম্পানি ছাড়া অন্য কারো কাছে ডিপোজিট চাইলেও না পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যেহেতু অন্য বীমা কোম্পানিগুলোর সঙ্গে করপোরেট চুক্তি নেই এর ফলশ্রম্নতিতে চুক্তিবদ্ধ বীমা কোম্পানিগুলোতে ব্যাংক ডিপোজিটের জন্য ব্যাপক চাপ প্রয়োগ করতে পারে।

তাই করপোরেট এজেন্ট হিসেবে ব্যাংক কয়টি বীমা কোম্পানির সঙ্গে কাজ করবে তা প্রতিটি ব্যাংক তার নিজস্ব সক্ষমতার ওপর নির্ভর করে সিদ্ধান্ত নিলে তা অধিকতর কার্যকর হবে। ব্যাংক তার কর্ম অভিজ্ঞতা, লোকবল, শাখার সংখ্যা, ব্যবসার পরিধি, ব্যাংকের জন্য প্রয়োজনীয় ডিপোজিট, ব্যাঙ্কাসুরেন্স সার্ভিস ডেলিভারেট করার সক্ষমতা ইত্যাদি বিবেচনা করে কতটি লাইফ ও নন-লাইফ বীমার সঙ্গে কাজ করবে তা নির্ধারণের ক্ষমতা তাদের নিজস্ব ব্যাপার। যার কারণে অনেক বীমা কোম্পানি ব্যবসা সফল ব্যাংকের সঙ্গে কাজ করে ব্যবসা বৃদ্ধি করতে পারবে ও ব্যাংকগুলো অনেক বীমা কোম্পানির ডিপোজিট পেয়ে ভালো অবস্থানে থেকে ব্যাঙ্কাসুরেন্স কার্যক্রম সুন্দরভাবে চালিয়ে যেতে পারবে।

লাইফ ইন্সু্যরেন্সগুলোর প্রত্যক্ষভাবে ব্যাংকের সঙ্গে ব্যবসা নেই। সে বিবেচনায় লাইফ ইন্সু্যরেন্স ও ব্যাংকের জন্য ব্যবসা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ব্যাঙ্কাসুরেন্স একটি উপযুক্ত মাধ্যম হতে পারে কিন্তু নন-লাইফ ইন্সু্যরেন্সের কার্যক্রম অনেকটাই সংকুচিত ও স্থবির হয়ে আসবে।

নির্ধারিত ০৪ (চার)টি ব্যাংকের বাইরে বীমা ব্যবসা করা যাবে কিনা বা গেলেও তা কি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে করা সম্ভব হবে- সে বিষয়টি ব্যাঙ্কাসুরেন্স চালুর পূর্বেই কর্তৃপক্ষের উপযুক্ত দিকনির্দেশনা দেওয়া দরকার বলে বিজ্ঞজনরা মনে করেন।

ব্যাঙ্কাসুরেন্স, ইন্সু্যরটেক, ব্রোকারেজ, করপোরেট এজেন্ট ইত্যাদির সফল বাস্তবায়ন কামনা করি। তবে সব বিষয়ের সুবিধা-অসুবিধা ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া যেসব দেশে এই প্রক্রিয়াগুলো চালু আছে তা পর্যবেক্ষণ করে আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে সে অভিজ্ঞতার আলোকে নিয়ম-নীতি প্রণয়ন করা বাঞ্ছনীয় বলে মনে করি। সেই সঙ্গে বীমা কোম্পানিগুলোতে বীমা পেশায় কর্মরতদের আর্থিক নিরাপত্তার বিষয়টিও বিবেচনায় নেওয়ার অনুরোধ জানাচ্ছি।

\হ

মীর নাজিম উদ্দিন আহমেদ : ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও, ইসলামী কমার্শিয়াল ইন্সু্যরেন্স কোং লিমিটেড

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে