সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

আত্মহত্যার মহামারি

নতুনধারা
  ০৪ জুন ২০২৩, ০০:০০

আত্মহত্যা এখন আমাদের স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেন মহামারির মতোই ছড়িয়ে পড়ছে। ক্লাসে সব সময় হাসিখুশি থাকা বন্ধুটি হতাশাগ্রস্ত হয়ে কখন আত্মহত্যা করে ফেলে বলাই বাহুল্য। হাসিখুশি থাকা বন্ধুটিও আত্মহত্যা করতে পারে, এটি এখন আর বিস্ময়কর নয় বরং প্রতিনিয়ত ঘটছে। সম্প্রতি, বুয়েট এবং রাজশাহী বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে এক শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা করার ঘটনা দেশজুড়ে বেশ আলোচিত। রুয়েট শিক্ষার্থী তানভীর আহমেদ আত্মহত্যার বিরুদ্ধে দীর্ঘ সময় লেখালিখি করেছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে। আত্মহত্যাকে একটি নীরব ঘাতক রোগ বললেও ভুল হবে না। প্রতি বছর দেশে শত শত শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা করেন।

শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার প্রবণতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। বেকারত্ব, পারিবারিক কলহ, প্ররোচনা, চাপ, হতাশা, প্রেমে ব্যর্থতা, চাহিদা এবং আকাঙ্ক্ষার মধ্যে পার্থক্য, নেতিবাচক চিন্তাভাবনা, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যহীনতা, সাইবার ক্রাইমের শিকার, যৌন নির্যাতনের শিকার, আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি ইত্যাদিকে আত্মহত্যার কারণ হিসেবে দেখা হয়। এর বাইরেও বর্তমানে মিডিয়াও এর দায় এড়াতে পারবে না।

শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার ঘটনা এখন প্রতিনিয়তই ঘটছে। গণমাধ্যমে যতটুকু আসছে, বাস্তবচিত্র আরও ভয়াবহ। এর অন্যতম দুটি কারণ, লোকলজ্জার ভয়ে আত্মহত্যার ঘটনা অনেক সময় পরিবার প্রকাশ করতে চায় না এবং ক্ষেত্রবিশেষে পরিবার এটিও আশঙ্কা করে, আত্মহত্যার খবর প্রকাশ হলে পরিবারের প্রতি পারিপার্শ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যেতে পারে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোয়, আত্মহত্যার সংখ্যা ভয়ংকরভাবে বেড়েছে। ২০২২ সালের প্রকাশিত বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আঁচলের রিপোর্ট অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয়সহ স্কুল ও কলেজ পর্যায়ের ৫৩২ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন।

আত্মহত্যাকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৩৪০ জন বা ৬৪ শতাংশই স্কুল পর্যায়ের। কলেজ পর্যায়ে ১০৬ জন শিক্ষার্থী। আত্মহত্যার প্রবণতা থেকে বাদ পড়ছেন না মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরাও। সমমান প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মাদ্রাসাগামী শিক্ষার্থী রয়েছেন ৫৪ জন। দেশের সরকারি এবং বেসামরিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ৮৬ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে এর মধ্যে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা সংখ্যাটাই বেশি।

স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার প্রধান কারণ পরিবারের সদস্যদের ওপর মান-অভিমান। ২৭ শতাংশ স্কুল-কলেজ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে অভিমান করে। তরুণরা অতি ক্ষুদ্র বিষয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে যাওয়া বা পরিবারের কারও আচরণে কষ্ট পেয়ে আত্মহত্যা করার প্রবণতা বেশি।

এদিকে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার প্রবণতা দিন দিন আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার প্রধান কারণ বেকারত্ব, হতাশাগ্রস্ত, আর্থিক সমস্যা। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করে যখন শিক্ষার্থীরা চাকরি খুঁজে পায় না তখন নিজেদের মধ্যে মানসিক চাপ সৃষ্টি হয়, পারিবারিক আর্থিক চাপে হতাশাগ্রস্ত হয়ে আত্মহত্যার খবর বেশি শোনা যায়।

আত্মহত্যার প্রবণতা ক্রমেই একটি সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এভাবে আত্মহত্যার প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়া মোটেও স্বাভাবিক বিষয় নয়। এটির প্রভাব আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের ওপর বেশ ভালোই পড়বে বলে মনে করছেন সমাজ বিশেষজ্ঞরা। আত্মহত্যার ব্যাপারে এখনই সচেতন হওয়া জরুরি।

সাম্প্রতিক সময়ে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে আত্মহত্যা করছে অনেকে। আত্মহত্যা ভিডিও প্রতিনিয়ত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে ছড়িয়ে পড়ছে এবং এসব ভিডিও কোটি কোটি মানুষ দেখছেন। নাটক, সিনেমায় আত্মহত্যাকে নরমালাইজ করে প্রচার করা হয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরে বেড়ায় এসব লেখা, ভিডিও আত্মহত্যাকে আরও উৎসাহিত করে। এতে হতাশাগ্রস্ত ব্যক্তিরা এসব লেখা পড়ে বা ভিডিও দেখে আত্মহননের জন্য আরও উৎসাহিত হয়। আত্মহত্যার ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়া থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে। মিডিয়ায় আত্মহত্যার ইতিবাচক প্রচার বন্ধ করতে হবে। আত্মহত্যার সম্পর্কে সোশ্যাল মিডিয়ায় জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। ইতিবাচক চিন্তাভাবনা সমাজে ছড়িয়ে দিতে হবে। আত্মহত্যার প্ররোচনা দেওয়া একটা ফৌজদারি অপরাধ। তাই যারা আত্মহত্যাকে সোশ্যাল মিডিয়ায় ইতিবাচকভাবে প্রচার করবে তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে।

আত্মহত্যা করার আগে সাধারণত কিছু লক্ষণ দেখা যায়। যেমন- মানসিকভাবে হতাশাগ্রস্ত মনে হওয়া, শরীরে আঘাতের চিহ্ন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মৃতু্য আর আত্মহত্যা নিয়ে নিজের ইচ্ছার কথা প্রকাশ করা, মাদকাসক্ত, ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়াই ঘুমের ওষুধ খাওয়া ইত্যাদি।

আত্মহত্যা একটি মানসিক রোগ তাই এটি প্রতিরোধযোগ্য। সঠিক সময়ে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারলে আত্মহত্যা ঠেকানো সম্ভব। আত্মহত্যা প্রতিরোধ করতে হলে সমাজের সবাইকে সচেতন হতে হবে। শিশুদের বিকাশের সময় তাদের এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে, যাতে তাদের মধ্যে ব্যর্থতাকে মেনে নেওয়ার মানসিকতা গড়ে ওঠে। বয়ঃসন্ধিকালে সন্তানের অনুপ্রেরণা, ধর্মীয় আদর্শ, উদার মনোভাব, সুষম খাদ্যাভ্যাস, সুষ্ঠু পরিবেশে রাখা জরুরি। আত্মহত্যার উপকরণ, যেমন- ঘুমের ওষুধ, কীটনাশকের সহজলভ্যতা কমাতে হবে। প্রেসক্রিপশন ছাড়া ঘুমের ওষুধ বিক্রি বন্ধ করতে হবে।

আত্মহত্যার মূল কারণ হতাশাগ্রস্ত। তাই আমাদের কোনো বন্ধু মানসিকভাবে হতাশাগ্রস্ত থাকলে তাকে একা একা থাকতে দেওয়া যাবে না। তার পাশে থেকে সব সময় তাকে উৎসাহিত করতে হবে। গবেষণায় দেখা গেছে আত্মহত্যাকারী ব্যক্তি তার এই হতাশাগ্রস্ত দূর করার জন্য কারও উৎসাহ বা সঙ্গ না পাওয়ার কারণে আত্মহত্যা করেন। যারা হতাশাগ্রস্ত আছেন আগে তাদের হাতাশার মূল কারণ জানতে হবে। তাদের দুঃসময়ে পাশে থেকে সবসময় উৎসাহ যোগাতে হবে। কারও মনে আত্মহত্যার মনোভাব তৈরি হলে যত দ্রম্নত সম্ভব একজন সাইকোলজিস্টের শরণাপন্ন হওয়া। পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাতে হবে। সোশ্যাল মিডিয়া থেকে যথাসম্ভব দূরে থাকা। সামাজিক যোগাযোগ বাড়ানো, নিজেকে সবসময় ব্যস্ত রাখা। আসুন, আমাদের বন্ধু-বান্ধব বা সমাজে বসবাসরত হতাশাগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়াই। উদার, মানবিকতা ছড়িয়ে দিই সমাজে। আপনার একটু উৎসাহ-অনুপ্রেরণা বাঁচিয়ে দিতে পারে একটি সুন্দর জীবন।

মোহাম্মদ হাসান

শিক্ষার্থী

কুমিলস্না বিশ্ববিদ্যালয়

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে