শুক্রবার, ০৯ মে ২০২৫, ২৬ বৈশাখ ১৪৩২

ব্রিকস সম্প্র্রসারণ বাংলাদেশ ও সৌদি আরব

চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ প্রকল্পে বাংলাদেশে বিনিয়োগ ও ঋণ অন্যান্য দেশের তুলনায় সর্বোচ্চ। এই ঋণের ফাঁদ বাংলাদেশের ক্ষমতার পালাবদলেও ভূমিকা রাখতে পারে। সবার জ্ঞাত যে, বাংলাদেশের পোশাকের খদ্দের হলো ইউরোপ এবং আমেরিকা। ক্রমাগত বাংলাদেশ সরকারের চীন ও রাশিয়া অভিমুখী হওয়া অনাগত ভবিষ্যতে পোশাকের মার্কেটের প্রতি মহাবিপদ আসারও সম্ভাবনা রয়েছে।
মো. তারেকুল ইসলাম
  ০৭ জুলাই ২০২৩, ০০:০০
ব্রিকস সম্প্র্রসারণ বাংলাদেশ ও সৌদি আরব

পৃথিবীর সবচেয়ে দ্রম্নতগামী অর্থনৈতিক বর্ধনশীল জোটের নাম হলো ব্রিকস (ইৎরপং)। ২০০১ সালে মার্কিন আর্থিক প্রতিষ্ঠান গোল্ডম্যান স্যাক্সের সে সময়কার প্রধান অর্থনীতিবিদ জিম ও'নীলা প্রথম অদ্যাক্ষর ইৎরপ (ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত এবং চীন) বর্ণ সমষ্টি দ্বারা নামকরণ করেছেন। জোটের সদস্যরা ধারণাটিকে গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেন। ২০০৬ সালে নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সম্মেলনে চার দেশের মন্ত্রীদের নিয়ে রুশ প্রধানমন্ত্রী ভ্‌লাদিমির পুতিন এ নিয়ে আলোচনায় বসেন। ২০০৯ সালে এর প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেই সম্মেলনে উদীয়মান ও উন্নয়নশীল দেশে পারস্পরিক সহযোগিতা ও সমৃদ্ধি অর্জনে কাজ করবে এমন নীতি গ্রহণ করা হয়। ২০১০ সালে আফ্রিকার প্রধান প্রভাবশালী দেশ দক্ষিণ আফ্রিকা এই সংস্থায় যোগদান জোটে নতুন মাত্রা নিয়ে আসে। এই দেশ যোগদানের সঙ্গে সঙ্গে এই জোটের নাম হয় ব্রিকস (ইৎরপং)। নতুন সদস্য দেশ নিয়ে ২০১১ সালে চীনের বেইজিং-এ আবার সম্মেলন হয়। এই জোটের উদ্যোগে ২০১৫ সালের ২১ জুলাই যাত্রা করে নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক-এনডিবি। ২০২১ সালের আগস্ট মাসে এনডিবির বোর্ড অব গভর্নরসের সভায় নতুন সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের যোগদান অনুমোদিত হয়। অপ্রতিদ্বন্দ্বী ডলারকে চ্যালেঞ্জ করা, আঞ্চলিক ভু-রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের একাধিপত্য খর্ব করে বিশ্বব্যবস্থার নয়া রূপ নিয়ে আসতে বিশ্বের ভৌগোলিকভাবে তাবড়-তাবড় দেশগুলোর নেতারা ব্রিকসকে মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম প্রভাবশালী দেশে রাশিয়ার নেতা ভ্‌লাদিমির পুতিন হলেন অন্যতম। এই প্রতিষ্ঠানের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে ভ্‌লাদিমির পুতিনের খোদিত ইংরেজি বক্তব্যে দেখা যায়, যার বাংলা অনুবাদ হলো, 'ব্রিকস গ্রম্নপ এখনো একটি সংগঠন হিসেবে তরুণ, কিন্তু ইতোমধ্যেই এর কার্যকারিতা প্রমাণ করেছে। ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন এবং দক্ষিণ আফ্রিকা আন্তর্জাতিক মূল বিষয়গুলোতে তাদের নীতিগুলোকে আরও ঘনিষ্ঠভাবে সমন্বয় করছে। একটি বহুমুখী বিশ্বব্যবস্থা গঠনে এবং বিশ্বের আর্থিক ও বাণিজ্য ব্যবস্থার জন্য আধুনিক মডেল তৈরিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে।' বিশ্ব রাজনীতিতে প্রভাবশালী ও আধিপত্য বজায় রাখা উন্নত দেশের জোট জি-৭ এর মূল প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে রাশিয়া ও চীন ব্রিকসের মাধ্যমে নতুন বিশ্ব বলয় তৈরি করতে চায়। আমেরিকান সিকু্যরিটি প্রজেক্ট নামক ওয়েবসাইটের মাধ্যমে জানা যায়, 'ইউক্রেনের যুদ্ধ ব্রিকস গ্রম্নপের শক্তিশালীকরণকে প্ররোচিত করেছে, যা কার্যকরভাবে মোকাবিলা করতে না পারলে বর্তমান পশ্চিমা নেতৃত্বাধীন বিশ্বব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে।' তার কারণ হলো, বর্তমান ব্রিকসের ৫টি দেশে পৃথিবীর ৪০ শতাংশ জনসংখ্যা রয়েছে। পৃথিবীর মোট ভূমির ৩০ শতাংশ এই রাষ্ট্রগুলোর দখলে। বিশ্ববাণিজ্যের ১৮ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করছে ব্রিকস। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারের ২৫ শতাংশ নোমিনাল জিডিপির দখলে রয়েছে এই জোটটির। অধিকন্তু, এই দেশগুলো আন্তর্জাতিক খাদ্য সরবরাহে অবিরত ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। যেমন, পৃথিবীর গম রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে রাশিয়া বৃহত্তম। ব্রাজিল শস্যে তৃতীয় বৃহত্তর এবং সয়াবিন উৎপাদক ও সরবরাহকারী দেশ হিসেবে সবচেয়ে অগ্রগামী। একই সঙ্গে ভারত চাল রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে শীর্ষে অবস্থান করছে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক এনার্জি মার্কেটে চীন, রাশিয়া ও ভারতের বেশ প্রভাব রয়েছে। নিউক্লিয়ার পাওয়ার, হাইড্রো, বায়ু বিদু্যৎ এবং সোলার এনার্জির মতো পরিবেশ সুরক্ষিত ক্লিন এনার্জি ট্রান্সিশনের ব্যবহারে ভারত ও চীন কাজ করে যাচ্ছে। ব্রিকসের অন্যতম সদস্য দেশ রাশিয়া, বৃহত্তর তেল ও দ্বিতীয় বৃহত্তর গ্যাস রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে বিশ্বের এনার্জি নিয়ন্ত্রণে প্রভাবশালী অবস্থানে রয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধকেন্দ্রিক রাশিয়ার ওপর আমেরিকা ও পশ্চিমা দেশের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা এই জোটটিকে আরও বেশি শক্তিশালী করেছে। বিশ্ববাজারে তেলের দাম যখন ব্যারেল প্রতি ১২০ ডলার হয় তখন রাশিয়া ৩০-৩৫ ডলার মূল্যে অপরিশোধিত তেল রপ্তানি শুরু করে। ফলে, ইউরোপ এবং চীন ও ভারত রাশিয়া থেকে রুবলের মাধ্যমে তেল ক্রয় শুরু করে। জ্ঞাত হওয়া প্রয়োজন যে, ২০২২ সালের প্রথম দিকেই এই বস্নকটি বিশ্ববাণিজ্যের ৩৮ শতাংশ আন্তঃবাণিজ্য করতে সক্ষম হয়েছে। বেচাকেনাই নয় কেবল, অভ্যন্তরীণ বিরোধ মীমাংসায় এই বস্নকটির ভূমিকা রয়েছে। যেমন, হিমালয় বর্ডার কেন্দ্রিক ভারত-চীন বিরোধে এই জোট উভয় দেশের উত্তেজনা হ্রাস করতে পেরেছে। সম্প্র্রতি ব্রিকসের সম্প্র্রসারণের জন্য সৌদি আরব, আর্জেন্টিনা, মিসর, থাইল্যান্ড এবং বাংলাদেশসহ মোট ১৯টি দেশকে এই বস্নকে যোগদানের জন্য আহ্বান জানিয়েছে। ইরান ও সৌদি আরব ইতোমধ্যে বস্নকে যোগদানের জন্য আবেদন করেছে। সৌদি আরব ব্রিকসে যোগদানে বিশ্ব রাজনীতিতে নয়া সমীকরণ তৈরি হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের সৌদিতে যুক্তরাষ্ট্রের বিকল্প মিত্র চীন সৌদি আরব ও ইরানের মধ্য সমঝোতার মাধ্যমে কুটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে নব দুয়ার উন্মোচন করেছে। রিয়াদ ও তেহরান দ্বন্দ্বে সবচেয়ে বেশি সুবিধাভোগী ছিল আমেরিকা ও ইসরাইল। আরব দেশগুলোর ভেতর সংঘাত লাগাতে রেফারির ভূমিকায় থাকা আমেরিকা সৌদি-ইরান মীমাংসায় চীনের ভূমিকায় বেশ বিরম্বনার ভেতর রয়েছে। এরই মাঝে নতুন বার্তা হিসেবে দেখা দিয়েছে, সৌদি আরবের ব্রিকসে যোগদান যা চীনের এ দেশে কুটনৈতিক সম্পর্ক আরও দৃঢ় ও মজবুত করবে। গত বছর সৌদি আরব তেল উৎপাদনের পরিমাণ দুই শতাংশ কমানোর সিদ্ধান্ত নিলে যুক্তরাষ্ট্র যারপরনাই ক্ষুব্ধ হয়। ফলে, তেল সমৃদ্ধ এই দেশকে আমেরিকা নো পেক বিলের মাধ্যমে ওপেক পস্নাসভুক্ত তেল কোম্পানির ওপর নিরাপত্তা উঠিয়ে নেওয়ার হুঁশিয়ারি দেন। এতে সালমান বিন আব্দুল আজিজ ক্রুদ্ধ হয়ে ব্রিকসে যোগদানের সিদ্ধান্ত নেন। এ ছাড়া সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে জো বাইডেনের ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব রিয়াদ ব্রিকস অভিমুখী হয়েছে। এতে করে বাইডেন আরও বেশি রাগান্বিত হন। কারণ ব্রিকসের অন্যতম সদস্য তেল সমৃদ্ধ দেশ রাশিয়া এবং সৌদি আরব যুগপৎভাবে বিশ্ববাজারের পেট্রোলিয়াম নিয়ন্ত্রণ করবে। এদিকে, আন্তঃবাণিজ্য করার জন্য প্রয়োজন হবে ডলারের বিপরীতে নতুন মুদ্রা প্রচলন যা পুতিন কৌশলগতভাবে ঠিক করে রেখেছে। সুতরাং বলা যায়, তেহরান ও রিয়াদের ভেতর মীমাংসা এবং সালমান বিন আব্দুল আজিজের ব্রিকসে যোগদান মার্কিনিদের মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাব-প্রতিপত্তি ক্রমহ্রাসমান হারে তলানিতে ঠেকিয়েছে। এদিকে, বাংলাদেশ ব্রিকসে যোগদান করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এ নিয়ে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য বিডিনিউজ ২৪-এর মাধ্যমে জানা যায়, 'আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এককভাবে কারো ওপর যেন নির্ভরশীল থাকতে না হয়, সেজন্যেই ব্রিকসে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।' সংবাদ সম্মেলনের প্রশ্নোত্তর পর্বে একজন সাংবাদিক জানতে চান, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের বাস্তবতায় যে অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হয়েছে, সেই সময়ে ব্রিকসে যোগ দিলে কোনো সুবিধা বাংলাদেশের হবে কি না। প্রধানমন্ত্রী উত্তরে বলেন, 'ব্রিকসে আমরা যোগ দেব এই কারণে, ব্রিকস প্রথম যখন এটার প্রস্তুতি নেয় তখন থেকেই আমরা এর সঙ্গে ছিলাম এবং আছি। কিন্তু আমরা ফাউন্ডার মেম্বার হতে পারিনি। এখন আমরা চেয়েছি সেটার মেম্বার হতে।' আন্তর্জাতিক মুদ্রা যদি কোনো দেশ চালু করে তাহলে সে মুদ্রায় কেনাবেচা করতে আগ্রহী প্রধানমন্ত্রী। ডলারের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে চান তিনি। প্রধানমন্ত্রীর উলিস্নখিত বক্তব্য নিঃসন্দেহে সাহসী ও প্রশংসার দাবি রাখে। তবে মোড়ল রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্রের খরগহস্ত হওয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ ডলারের একাধিপত্য খর্ব হোক সেটি কখনো আমেরিকা চাইবে না। এদিকে ব্রিকসে জি-৭-এর বিপরীত মেরুর দেশ রয়েছে বলে বাংলাদেশের এই বস্নকে প্রবেশ আমেরিকা তা ভালো চোখে দেখবে না। উপরন্তু ব্রিকস বৈশ্বিক জিডিপি অবদানের ক্ষেত্রে জি-৭ কেও ছাড়িয়ে গেছে। \হচীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ প্রকল্পে বাংলাদেশে বিনিয়োগ ও ঋণ অন্যান্য দেশের তুলনায় সর্বোচ্চ। এই ঋণের ফাঁদ বাংলাদেশের ক্ষমতার পালাবদলেও ভূমিকা রাখতে পারে। সবার জ্ঞাত যে, বাংলাদেশের পোশাকের খদ্দের হলো ইউরোপ এবং আমেরিকা। ক্রমাগত বাংলাদেশ সরকারের চীন ও রাশিয়া অভিমুখী হওয়া অনাগত ভবিষ্যতে পোশাকের মার্কেটের প্রতি মহাবিপদ আসারও সম্ভাবনা রয়েছে। সার্বিকভাবে বলা যায়, ব্রিকসে যোগদানে আশঙ্কা রয়েছে যেমন সুবিধাও কম নেই। অনেকে মনে করেন, বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের মতো ব্রিকসের নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক থেকে বাংলাদেশ অবকাঠামোগত বিনিয়োগ ও ঋণ পেতে পারে। বাংলাদেশ আগস্টে সদস্যপদ পেয়ে গেলে ভারত-বাংলাদেশ বাণিজ্যিক অ-ভারসাম্য দূরিকরণ, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারকে চাপ প্রদান, অর্থনৈতিক ঋণদান ও বিনিয়োগ করণসহ প্রয়োজনীয় সব দাবি সরকার রাখবে বলে আশা করা যায়। মো. তারেকুল ইসলাম : নবীন কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে