বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

অহিংসার প্রতীক মহাত্মা গান্ধী

গান্ধী ছিলেন অহিংসা, মানবতা ও অসাম্প্রদায়িকতার প্রতীক। তার অহিংস মতবাদ মানবিক চেতনাবোধের অনন্য নজির হয়ে আছে। গান্ধী ব্রিটিশ সরকারের কৃতকর্ম এরং ভারতীয়দের প্রতিশোধপরায়ণ আচরণ উভয়কেই নিন্দা করেছেন।
তারাপদ আচার্য্য
  ০২ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০
অহিংসার প্রতীক মহাত্মা গান্ধী

মহাত্মা গান্ধী (মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, জন্ম ২ অক্টোবর, ১৮৬৯; মৃতু্য ৩০ জানুয়ারি, ১৯৪৮) ভারতীয় উপমহাদেশের একটি উজ্জ্বল নাম। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে তার ভূমিকা ও অবদান অনস্বীকার্য। অথচ স্বাধীনতার মাত্র এক বছরের মধ্যে মহাত্মা গান্ধীকে ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি নতুন দিলিস্নর একটি সুবৃহৎ প্রাসাদ বিড়লা হাউস প্রাঙ্গণে (এখন গান্ধী স্মৃতি) হত্যা করা হয়েছিল। তার ঘাতক ছিলেন নাথুরাম গডসে। হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা, রাজনৈতিক দল হিন্দু মহাসভার সদস্য এবং হিন্দু জাতীয়তাবাদী আধাসামরিক স্বেচ্ছাসেবক সংস্থা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) একজন সাবেক সদস্য। গডসে মনে করেছিলেন, এর আগের বছর ১৯৪৭ সালের ভারত বিভাজনের সময় গান্ধীজী মুসলমানদের পক্ষে খুব বেশি সহায়তা করেছিলেন। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে সন্ধ্যা ৫টার কিছু পরে, গান্ধী, বিড়লা হাউসের পেছনের দিকে লনে যাওয়ার সিঁড়ির মাথায় পৌঁছেছিলেন। সেখানে তিনি প্রতি সন্ধ্যায় সর্ব ধর্মের প্রার্থনা সভা পরিচালনা করতেন। যেইমাত্র গান্ধী বেদির দিকে হাঁটতে শুরু করেছিলেন, গডসে ভিড় থেকে বেরিয়ে এসে গান্ধীর পথের সামনে দাঁড়িয়ে তাকে বুকে এবং পেটে তিনটি গুলি করে ছিলেন। গান্ধী মাটিতে পড়ে গেলে সেখান থেকে কিছুক্ষণ পরে একজন প্রতিনিধি এসে তার মৃতু্যর কথা ঘোষণা করেন। গান্ধীর প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছিল। সবাই খুব জোরে কাঁদছিল। অনেকবার হাসপাতালে ফোন করা হয়েছিল, কিন্তু কোনো সাহায্য পাওয়া যায়নি। জনতা গডসেকে ধরে ফেলে এবং পুলিশের হাতে সমর্পণ করে। গান্ধী হত্যার বিচার ১৯৪৮ সালের মে মাসে দিলিস্নর ঐতিহাসিক লাল কেলস্নায় শুরু হয়েছিল। প্রধান আসামি ছিলেন গডসে এবং তার সহযোগী নারায়ণ আপ্তে।

১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বরের গোড়ার দিকে দিলিস্ন এবং পার্শ্ববর্তী প্রদেশে পূর্ব পাঞ্জাব হিংস্র দাঙ্গা রোধে সাহায্য করার জন্য গান্ধী দিলিস্ন চলে গিয়েছিলেন। ব্রিটিশ ভারতীয় সাম্রাজ্যের বিভাজনের পরিপ্রেক্ষিতে দাঙ্গা শুরু হয়েছিল। বিভাজনের পর ভারত ও পাকিস্তান নতুন স্বাধীন দেশ তৈরি হয়েছিল। নাথুরাম, বিনায়ক এবং তার সহযোগীরা দাক্ষিণাত্যের বাসিন্দা ছিলেন। গডসে এর আগে ব্রিটিশ ভারতের দাক্ষিণাত্যে অঞ্চলে দেশীয় রাজ্য হায়দরাবাদের মুসলিম শাসক ওসমান আলী খানের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। গডসে ১৯৩৮ সালে হায়দরাবাদে একটি প্রতিবাদ মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন, সেখানে হিন্দুদের প্রতি বৈষম্য করা হচ্ছিল। রাজনৈতিক অপরাধের জন্য তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল এবং তিনি কারাবাসের সাজা ভোগ করেছিলেন। কারাগার থেকে বেরিয়ে, গডসে তার অসহযোগ আন্দোলন চালিয়ে যান।

অরবিন্দ শর্মার মতে, ১৯৪৮ সালে গডসে এবং তার সহযোগীরা গান্ধীকে হত্যার পরিকল্পনা শুরু করেছিলেন, ভারত ও পাকিস্তান ততদিনে কাশ্মীরের দখল নিয়ে যুদ্ধ শুরু করেছে। কংগ্রেস নেতাদের নেতৃত্বে ভারত সরকার, ১৯৪৮ সালের জানুয়ারিতে, পাকিস্তানকে যুদ্ধের সময় অর্থাগম বন্ধ করার জন্য তাদের অর্থ প্রদান বন্ধ করে দিয়েছিল। গান্ধী এই অর্থ প্রদান বন্ধ করার সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিলেন। ভারত সরকার গান্ধীর চাপের কাছে নতিস্বীকার করে এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে। গডসে এবং তার সহকর্মীরা এই ঘটনাক্রমকে ব্যাখ্যা করেছিলেন- মহাত্মা গান্ধী শক্তি নিয়ন্ত্রণ করে ভারতকে আঘাত করছেন। যেদিন গান্ধী অনশন শুরু করেছিলেন, গডসে এবং তার সহযোগীরা, কীভাবে গান্ধীকে হত্যা করা যায় তার পরিকল্পনা করতে শুরু করেছিলেন। নাথুরাম এবং নারায়ণ আপ্তে একটি বেরেট্টা এম ১৯৩৪ কিনেছিলেন। পিস্তল কেনার পাশাপাশি, গডসে এবং তার সহযোগীরা গান্ধীকে ছায়ার মতো অনুসরণ করতে শুরু করেছিলেন।

গান্ধী ছিলেন অহিংসা, মানবতা ও অসাম্প্রদায়িকতার প্রতীক। তার অহিংস মতবাদ মানবিক চেতনাবোধের অনন্য নজির হয়ে আছে। গান্ধী ব্রিটিশ সরকারের কৃতকর্ম এরং ভারতীয়দের প্রতিশোধপরায়ণ আচরণ উভয়কেই নিন্দা করেছেন।

১৯২১ সালের ডিসেম্বরে মহাত্মা গান্ধী ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নির্বাহী হন। তার নেতৃত্বে কংগ্রেস স্বরাজের লক্ষ্যকে সামনে রেখে নতুন সংবিধান গ্রহণ করেন। গান্ধী তার অহিংস নীতির পরিবর্ধন করেন স্বদেশি নীতি যোগ করে। স্বদেশি নীতি মতে সব বিদেশি পণ্য বিশেষত ব্রিটিশ পণ্য বর্জন করা হবে। এর পথ ধরে তিনি সব ভারতীয়কে ব্রিটিশ পোশাকের বদলে খাদি পরার আহ্বান জানান। গান্ধী লবণের ওপর কর আরোপের বিরুদ্ধে নতুন সত্যাগ্রহ অভিযান শুরু করেন। হাজার হাজার ভারতীয় তার সঙ্গে হেঁটে সাগরের তীরে পৌঁছান। এটি ছিল ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে তার অন্যতম সফল প্রয়াস।

গান্ধীর ইচ্ছানুযায়ী, তার দেহভস্ম বিশ্বের বেশ কয়েকটি প্রধান নদী যেমন- নীলনদ, ভোলগা, টেমস প্রভৃতিতে ডুবানো হয়। যা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল। গান্ধী তার জীবনকে সত্য অনুসন্ধানের বৃহৎ উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করেছিলেন। তিনি নিজের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে এবং নিজের ওপর নিরীক্ষা চালিয়ে তা অর্জন করেছিলেন।

১৯৬০-এর দশকে ভারত সরকার গান্ধীর রচনাবলি (ঞযব পড়ষষবপঃবফ ড়িৎশং ড়ভ গধযধঃসধ এধহফযর) প্রকাশ করে। তিনি গণতন্ত্রকামী মানবতাবাদী মানুষের হৃদয়ে আজো দেদীপ্যমান। জন্মদিনে তার প্রতি গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাই।

তারাপদ আচার্য্য : প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে