বৃহস্পতিবার, ১৬ মে ২০২৪, ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

বাংলাদেশে জাকাতের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জসমূহ

অনেকে বছরের বিভিন্ন সময়ে বিশেষ করে রমজান মাসে নিজ দরিদ্র আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশীকে জাকাত দেন। মসজিদ, মাদ্রাসায় জাকাত দেন- যা অনেকটাই সঠিক নয় ও অপরিকল্পিত। তাই সচেতনতা বৃদ্ধি ও সামর্থ্যবানদের জাকাত প্রদানে উৎসাহী করাই প্রধান চ্যালেঞ্জ বলে মনে হয়েছে।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নূর (অব.)
  ২৭ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০
বাংলাদেশে জাকাতের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জসমূহ

জাকাত শব্দের অর্থ বৃদ্ধি পাওয়া বা পবিত্র করা। জাকাত ইসলামের একটি অন্যতম স্তম্ভ এবং ইসলামী অর্থনীতির উলেস্নখযোগ্য চালিকা শক্তি। মহান আলস্নাহ পবিত্র কোরআনে ৩২ বার জাকাতের কথা উলেস্নখ করেছেন। তন্মধ্যে ২৮ বার নামাজের সঙ্গে জাকাতের কথা বলেছেন মহানবী হযরত মুহম্মদ (স.)-এর আগমনের বহু পূর্ব থেকেই মহান আলস্নাহ জাকাতের নির্দেশ দিয়েছেন। পবিত্র কোরআনের সুরা মারিয়ামের ৫৪ ও ৫৫ নম্বর আয়াতে হযরত ইসমাইল (আ.)-এর কথা উলেস্নখ করে আলস্নাহ বলেন, 'তিনি তার পরিবারবর্গকে নামাজ ও জাকাত আদায়ের নির্দেশ দিতেন এবং তিনি তার পালনকর্তার কাছে পছন্দনীয় ছিলেন' পবিত্র কোরআনের সুরা আম্বিয়ার ৭৩ নম্বর আয়াতে মহান আলস্নাহ হযরত ইসহাক (আ.) ও হযরত ইয়াকুব (আ.)-এর উদ্দেশে বলেন, 'আমি তাদের প্রতি ওহী নাজিল করলাম সৎকর্ম করার, নামাজ কায়েম করার এবং জাকাত আদায় করার সুরা মারিয়ামের ৩১ নম্বর আয়াতে উলেস্নখ আছে তিনি (হযরত ঈসা আ.) বলেন, 'তিনি (মহান আলস্নাহ) আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন যতদিন জীবিত থাকি, ততদিন নামাজ ও জাকাত আদায় করতে' সামর্থ্যবান মুসলমানদের জাকাত না দেয়া আলস্নাহর আদেশকে অমান্য করার শামিল। ইমাম আয-যাহাবী (রহ.) তার 'আল কাবায়ের' গ্রন্থে জাকাত না দেওয়াকে ৫ম কবিরা গুনাহ হিসেবে উলেস্নখ করেছেন।

বাংলাদেশে জাকাতের প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার শতকরা ৯১.০৪ ভাগ মুসলমান। বিগত দশকগুলোতে বাংলাদেশে জিডিপি প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি সামর্থ্যবান মুসলমানের সংখ্যা বেড়েছে বহুগুন। বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২২ সালের প্রথম কোয়ার্টারে দেশের ব্যাংকগুলোতে মিলিওনিয়ার একাউন্টের সংখ্যা ছিল ১১৩৫৯৭টি। এই একাউন্টগুলোতে সঞ্চয়ের পরিমাণ ছিল ৬,৬৩,৫০৫ কোটি টাকা। (ঞযব ইঁংরহবংং ঝঃধহফধৎফ ২২ ঔঁহব, ২০২২) প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, মাত্র ০৩ মাসে মিলিওনিয়ার একাউন্টের সংখ্যা বেড়েছে ১৬২১টি। শতকরা আড়াই টাকা হিসেবে শুধু মিলিওনিয়ার একাউন্টে সঞ্চিত অর্থের জাকাত আসবে ১৬,৫৮৭ কোটি টাকা। অনেকে প্রশ্ন করেন ইনকাম ট্যাক্স দিলে জাকাত কেন দিতে হবে? অথচ ইনকাম ট্যাক্সে সঙ্গে জাকাতের কোনো সম্পর্ক নেই। এ ব্যাপারে পরবর্তী কোনো এক সময়ে লিখার ইচ্ছে আছে।

এমফিল করার সময় আমার গবেষণার বিষয় ছিল, 'দারিদ্র বিমোচন ও অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণে জাকাতের ভূমিকা'। এই গবেষণার সময় আমি দেশে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে যারা স্বল্প পরিসরে জাকাত নিয়ে কাজ করছেন তাদের সঙ্গে কথা বলি। একই সঙ্গে ইতোপূর্বে যারা জাকাত নিয়ে গবেষণা করেছেন তাদের গবেষণাগুলো পর্যালোচনা করি। এই গবেষকদের মধ্যে ছিলেন এম কবির হাসান (প্রফেসর, নিউ অরলিন্স বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাষ্ট্র), প্রফেসর শাহ মুহাম্মাদ হাবীবুর রহমান এবং মোহাম্মদ আব্দুল লতিফা। এই তিন গবেষকই বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে বিভিন্ন খাত থেকে সম্ভাব্য জাকাত সংগ্রহের পরিমাণ হিসাব করেছিলেন।

মোহাম্মদ আব্দুল লতিফ ১৯৯০-৯১ অর্থবছরে বাংলাদেশে সম্ভাব্য জাকাতের হিসাব করেছিলেন- যা ছিল ২৬৬৮ কোটি টাকা। ১৯৯৫-৯৬ অর্থবছরে শাহ মোহাম্মদ হাবিবুর রহম-নের হিসাবে সম্ভাব্য জাকাতের পরিমাণ ছিল ২৮৩৭ কোটি টাকা। প্রফেসর এম কবির হাসান ১৯৯৭-৯৮ সাল থেকে ২০০৫-০৬ সাল পর্যন্ত জাকাতের আটটি উৎস যথা- রেমিট্যান্স, খনিজসম্পদ, ব্যবসায়িক পণ্য, ব্যাংক সঞ্চয়, মৎস্যখাত, কৃষি খাত, শেয়ার, পশুসম্পদ নিয়ে গবেষণা করেন। তার হিসাব অনুযায়ী ২০০৫-০৬ সালে সম্ভাব্য জাকাত ছিল ১২,৭৬০ কোটি টাকা।

গবেষণার অংশ হিসেবে আমি ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বাংলাদেশে জাকাতের মাত্র ০৫টি খাত চিহ্নিত করে হিসাব করি। খাতগুলো ছিল কৃষি উৎপাদন, খনিজসম্পদ, পশুসম্পদ, মৎস্যসম্পদ ও ব্যাংক সঞ্চয়। আমি দেখেছি, এই পাঁচটি খাত থেকেই সঠিক জাকাত আদায় করলে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা পাওয়া সম্ভব। এর সঙ্গে ব্যবসায়িক পণ্য, শেয়ার, রেমিট্যান্স যোগ করলে জাকাত অর্থের পরিমাণ আরো অনেক বেড়ে যাবে নিঃসন্দেহে।

গত ১১ ও ১২ মার্চ, ২০২৩ তারিখে সেন্টার ফর জাকাত ম্যানেজমেন্ট কর্তৃক গুলশান আলোকি কমিউনিটি সেন্টারে ১১তম জাকাত মেলা অনুষ্ঠিত হয়। এবারে জাকাত মেলার প্রতিপাদ্য ছিল, 'গধশরহম ধ উরভভবৎবহপব রিঃয তধশধঃ'। জাকাত মেলা উপলক্ষে আয়োজিত সেমিনারে বক্তারা সামর্থ্যবান মুসলমানদের জাকাত প্রদানে উদ্বুদ্ধ করার পাশাপাশি সঠিক ব্যবস্থাপনার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। বক্তারা মনে করেন, যথাযথ জাকাত সংগ্রহ ও ব্যবস্থাপনা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সামাজিক সুরক্ষার পাশাপাশি ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য দূরীকরণ ও এসডিজি অর্জনে সহায়ক হবে। সেমিনারে প্রফেসর এম কবির হাসানের গবেষণা প্রবন্ধ 'ঊংঃরসধঃরহম :যব চড়ঃবহঃরধষ ড়ভ তধশধঃ ঈড়ষষবপঃরড়হ রহ ইধহমষধফবংয ঁংরহম ঝবপড়হফধৎু ঝড়ঁৎপবং.' উপস্থাপন করা হয়। এই গবেষণা অনুযায়ী ২০২২ সালে বাংলাদেশে সম্ভাব্য জাকাত সংগ্রহের পরিমাণ হতো ৮৪ হাজার কোটি টাকা। (ঞযব ইঁংরহবংং চড়ংঃ ১২ গধৎ ২০২৩).

বাংলাদেশে জাকাতের প্রভূত সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হলে প্রয়োজন গবেষণা, সঠিক পরিকল্পনা ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা। তবে সামর্থ্যবানদের জাকাত প্রদানে উদ্বুদ্ধকরণ অতটা সহজ নয়। বর্তমানে আমি 'ঝবপরবহঃরভরপ গধহধমবসবহঃ ড়ভ তধশধঃ রহ ইধহমষধফবংয: চৎড়ংঢ়বপঃং ধহফ ঈযধষষবহমবং' নিয়ে পিএইচডি করছি। গবেষণার অংশ হিসেবে আমি রাজধানী ঢাকার একটি অভিজাত এলাকা বেছে নিয়েছিলাম। বসবাসকারী সম্পদশালী লোকদের সঙ্গে কথা বলে আমার মনে হয়েছে বেশির ভাগ মানুষ জাকাতের ব্যাপারে সচেতন নন। অনেক ধর্মপ্রাণ মানুষকে দেখেছি, তারা নামাজ রোজা কিংবা হজের ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন হলেও জাকাত প্রদানের ব্যাপারে অনেকটাই উদাসীন। অনেকেই ঘোষণা দিয়ে জাকাতের শাড়ি, লুঙ্গি প্রদান করেন। এসব ক্ষেত্রে মানুষের ভিড়ে পদদলিত হয়ে অনেক মৃতু্যর খবর আমাদের জানা আছে।

অনেকে বছরের বিভিন্ন সময়ে বিশেষ করে রমজান মাসে নিজ দরিদ্র আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশীকে জাকাত দেন। মসজিদ, মাদ্রাসায় জাকাত দেন- যা অনেকটাই সঠিক নয় ও অপরিকল্পিত। তাই সচেতনতা বৃদ্ধি ও সামর্থ্যবানদের জাকাত প্রদানে উৎসাহী করাই প্রধান চ্যালেঞ্জ বলে মনে হয়েছে।

\হ

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নূর (অব.) : পিএইচডি গবেষক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
X
Nagad

উপরে