সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

নির্বাচনের মাধ্যমে পাকিস্তানে স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে কি?

এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানে স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে কি? বিষয়টাতে ধোঁয়াশাই থেকে যাচ্ছে- কেন না, দলগুলোর বিরোধ ব্যাপক রূপ লাভ করতে পারে বলে শঙ্কা রয়েছে। ডলার সংকট ও তারল্য সংকট থেকে পাকিস্তান বের হতে পারেনি। মুদ্রাস্ফীতির ফলে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিও সহসা রোধ করা যাবে না।
আহমদ মতিউর রহমান
  ২৩ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০

পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন অবশেষে দেশটির আসন্ন সাধারণ নির্বাচনের শিডিউল ঘোষণা করেছে। দলগুলো এর দাবি জানাচ্ছিল এবং নির্বাচন আরেক দফা পেছানোর বিষয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছিল। এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে তা দূর হলো। প্রশ্ন আসছে নির্বাচন কি দেশে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে পারবে? নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, আগামী ২০ থেকে ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত মনোনয়ন পত্র জমা দিতে হবে। বাছাই ও আপিল শুনানি শেষে ১২ জানুয়ারি প্রার্থীপদ প্রত্যাহারের শেষ দিন। এর পর প্রকাশ হবে চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা। আর ভোটগ্রহণ করা হবে ৮ ফেব্রম্নয়ারি। পাকিস্তানে পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়ার ৯০ দিনের মাথায় নির্বাচনের বিধান রয়েছে। কিন্তু তা হয়নি। ফলে নির্বাচনের দাবিতে সুপ্রিম কোর্টে দায়ের করা হয়েছিল একাধিক মামলা। কয়েকদিন আগে সেই মামলায় রায় দিতে গিয়ে দেশটির শীর্ষ আদালত জানিয়েছিল যে প্রস্তাবিত ৮ ফেব্রম্নয়ারি ভোটগ্রহণের কোনো আপত্তি নেই রাজনৈতিক দলগুলোর। এরপরেই নির্বাচনী প্রস্তুতি শুরু করার জন্য নির্বাচন কমিশনকে দেওয়া হয়েছিল নির্দেশ। সেই নির্দেশ মেনেই জারি করা হলো নির্বাচনী তফসিল। প্রসঙ্গত, এর আগে নির্বাচন কমিশন ১১ ফেব্রম্নয়ারি ভোটগ্রহণের দিনক্ষণ স্থির করেছিল। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টে এ ব্যাপারে দেশটির প্রেসিডেন্টের সঙ্গে পরামর্শ করার জন্য কমিশনকে দিয়েছিল পরামর্শ। এরপর প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন কমিশনের কর্তারা। সেই বৈঠকে ৮ ফেব্রম্নয়ারি দেশে সাধারণ নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা নিয়ে প্রেসিডেন্টর দপ্তর ও নির্বাচন কমিশনের মধ্যে মিঠেকড়া বিরোধও দেখা দিয়েছিল।

দেশটিকে গত কয়েক বছর ধরে অস্থিতিশীলতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। গত ১৬ মার্চ পার্লামেন্টের মেয়াদ শেষ হওয়ার দিন তিনেক আগে শাহবাজ শরিফের কোয়ালিশন সরকার পার্লামেন্ট ভেঙে দেন। সংবিধান অনুযায়ী সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে পার্লামেন্ট নির্বাচন হওয়ার কথা। কিন্তু সেটা হয়নি। আদমশুমারির কাজ চলমান থাকায় এবং এর ফলে কয়েকটি আসনে সীমানা নির্ধারণ নিয়ে জটিলতা ইত্যাদির কারণে সময় বেশি লাগছে। সরকারের মেয়াদ শেষে তত্ত্বাবধায়ক সরকার যথারীতি দায়িত্ব নিয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব নিয়ে একটি নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের দল মুসলিম লীগ (এন) নেতা শাহবাজ শরিফের নেতৃত্বাধীন কোয়ালিশন সরকারের প্রধান শরিক সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজীর ভুট্টোর দল পিপিপির সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার ইঙ্গিত মিলছে। সাড়ে তিন বছর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশ পরিচালনার পর পিটিআই নেতা ইমরান খান ও তার দল এখন ত্রিশংকু অবস্থায়। ভারতের একটি দৈনিক লিখেছে : সমস্যায় পড়েছে সাবেক পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই ইনসাফ। দলের প্রধান জেলবন্দি। এমন অবস্থায় প্রার্থীপদ ঠিক করা যে কঠিন, তা মানছেন পিটিআই নেতৃত্ব। সে যাই হোক রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে প্রার্থী ঠিক করতে শুরু হয়ে গেছে ব্যস্ততা।

দেড় বছর আগে কোয়ালিশনের শরিকরা সমর্থন প্রত্যাহারের ইঙ্গিত দিলে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান পদত্যাগ করেন এবং তেলে জলে মিশ না খাওয়ার মতো দুই সাবেক শাসক দল মুসলিম লীগ (এন) ও পিপিপি সবাইকে অবাক করে দিয়ে এক বছরের বেশি সময় দেশ শাসন করেন। এখন নির্বাচনে দুটি দল আলাদাভাবে লড়বে বলে প্রতীয়মান। ফলে দেশটিতে তিনটি দলের মধ্যে প্রধানত লড়াইয়ের আভাস দিচ্ছেন বিশ্লেষকরা। আরো কিছু ঘটনা ঘটেছে ইতোমধ্যে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ প্রবাসে বহু বছর কাটিয়ে দেশে ফিরেছেন। দেশের অর্থনীতি নাজুক অবস্থার দিকে যাচ্ছে আর যথারীতি দেশে সহিংসতাও অব্যাহত রয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী আনোয়ারুল হক কাকারের সঙ্গে প্রেসিডেন্টের মিঠেকড়া বিরোধের দৃশ্যও দেখা গেছে। নির্বাচনের তারিখ নিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও প্রেসিডেন্টের দপ্তরের মধ্যে টানাপোড়েন গেছে সে কথা আগেই বলেছি। ঘোলাটে এই রাজনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পাকিস্তানের টালমাটাল অর্থনৈতিক অবস্থা। বন্যা পরিস্থিতিতে পর্যুদস্ত ছিল পাকিস্তান। ছিল ব্যাপক তারল্য সংকট। দ্য ডনের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, এ বছরের ফেব্রম্নয়ারিতে গত বছরের তুলনায় পাকিস্তানের মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়ায় ৩১ দশমিক ৫ শতাংশে। প্রায় ৮ মাসব্যাপী আলোচনার পর গত ১২ জুলাই পাকিস্তানের জন্য ৩ বিলিয়ন ডলার (৩০০ কোটি ডলার) ঋণ অনুমোদন করেছে আইএমএফ। এ জন্য পাকিস্তানকে করতে হয়েছে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি, করের অনুপাত বৃদ্ধির মতো শর্তপূরণ। প্রথম দফায় ১২ বিলিয়ন ডলার ঋণ পেয়েছে পাকিস্তান। পরবর্তী ৯ মাসের ভেতর বাকিটুকু পেয়ে যাবে। এখন দেশের তত্ত্বাবধায় সরকারের প্রধানমন্ত্রী আনোয়ারুল হক কাকার বলেছেন দেশের অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে উঠতে পেরেছে দেশ।

তিনি কি বলেছেন? তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী আনোয়ারুল হক কাকার সম্প্রতি বলেছেন যে, সরকার অর্থনীতির ডকুমেন্টেশনের জন্য বাস্তব পদক্ষেপ নেওয়ার পাশাপাশি তার প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার এজেন্ডা বাস্তবায়ন নিশ্চিত করছে। এর ফলে দেশ অর্থনীতির ট্র্যাকে উঠতে পেরেছে। দি নেশন পত্রিকা দি নিউজ শিরোনাম লিখেছে- চধশ ঊপড়হড়সু রং নধপশ ড়হ :ৎধপশ: চগ কধশধৎ. পাকিস্তান স্টক এক্সচেঞ্জের সদস্য এবং পাকিস্তানের নেতৃস্থানীয় কোম্পানির প্রধানদের সঙ্গে এক বৈঠকে তিনি বলেন, ব্যবসায়িক সম্প্রদায় এবং বিনিয়োগকারীদের সুবিধা প্রদান সরকারের অগ্রাধিকারের মধ্যে রয়েছে। আনোয়ারুল হক কাকার নির্বাচনের আগে সমস্ত দলকে লেভেল পেস্নইং ফিল্ড প্রদান না করার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন, যে কোনো রাজনৈতিক নেতার জনপ্রিয়তা নির্বাচনের মাধ্যমে বিচার করা হবে। অতি উত্তম কথা সন্দেহ নেই। কিন্তু এতে দলগুলোর সংশয় কি দূর হবে বা হয়েছে? তিনি বলেন, ৮ ফেব্রম্নয়ারি, ২০২৪-এ অনুষ্ঠিতব্য সাধারণ নির্বাচন সম্পর্কে জাতির কোনো সন্দেহ থাকা উচিত নয়। 'এ নিয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই... উদ্বেগগুলো প্রায়ই আমাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত। আমাদের নিজস্ব একটি ইতিহাস আছে,' তিনি ইন্ডিপেনডেন্ট উর্দুকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেন। তিনি বলেন, তিনি আশাবাদী যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার তুলনামূলকভাবে ভালো ফলাফল দিতে সক্ষম হবে। ইতোমধ্যে তফসিল ঘোষিত হয়েছে। এখন সরকারের কাজ নির্বাচন দিয়ে সরে পড়া।

ইমরান খানের পতনের সঙ্গে নির্বাচনের ধারণা সম্পর্কে জানতে চাইলে নির্বাচনী প্রক্রিয়া থেকে তার বাদ পড়ার বিষয়টিকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা বলে অভিহিত করেছেন প্রধানমন্ত্রী। তবে নির্বাচনই যে কোনো রাজনৈতিক নেতার জনপ্রিয়তা বিচার করবে বলে মন্তব্য করেন তিনি। সাধারণ নির্বাচনে ইমরান খান বা তার দলের অংশগ্রহণের বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'তার ওপর এখনো কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। তবে, যদি অস্বাভাবিক কিছু আসে, আমি এটি সম্পর্কে কিছু বলতে পারি না। আজ পর্যন্ত, তারা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অবস্থান রয়েছে এবং তারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে।' মি কাকারের কথাতেই এটা স্পষ্ট যে, নির্বাচন নিয়ে একটা ঢাক ঢাক গুড় গুড় আছে। তার সমাধান কি সেটা অজানা। আর সংকটটা সে স্থানেই।

এদিকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার সিকান্দার সুলতান রাজার সঙ্গে সম্প্রতি দেখা করেছেন পিপলস পার্টির প্রতিনিধিদল নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ, নির্বাচনের তফসিল এবং বদলি ও পদায়ন সংক্রান্ত বিষয়ে আলোচনা করতে। পিপিপি সময়মতো সাধারণ নির্বাচন নিশ্চিত করতে এবং পুলগুলিতে বিলম্ব সম্পর্কিত আবেদনের শুনানি এড়াতে বলেছে। পিপিপির সিনিয়র সদস্য তাজ হায়দার প্রধান নির্বাচন কমিশনার সিকান্দার সুলতান রাজার সঙ্গে সাক্ষাতের পর গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন। নির্বাচনের তারিখ খুব বেশি দূরে নয় এমন সময়ে প্রতিনিধিদল বদলি ও পদায়ন সংক্রান্ত উদ্বেগ তুলে ধরেন। তাজ হায়দার বলেন, পিপিপি প্রতিনিধিদলকে আশ্বস্ত করা হয়েছে যে, নির্বাচনে কোনো বিলম্ব হবে না।

এদিকে পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নওয়াজ (পিএমএল-এন) সিনিয়র সহ-সভাপতি মরিয়ম নওয়াজ পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি)কে আক্রমণ করে বলেছেন, তিনি চান কেউ যেন তার পিতা নওয়াজ শরিফের মতো সমান খেলার ক্ষেত্র না পায়। তিনি বলেন, কেউ যদি নওয়াজ শরিফের মতো একটি লেভেল পেস্নয়িং ফিল্ড চান, তাহলে তাকে দেখতে হবে যে, তাকে বিগত দিনে কোনো লেভেল পেস্নয়িং ফিল্ড দেওয়া হয়েছে। তিনি প্রশ্ন রাখেন, আপনি কি এই লেভেল পেস্নয়িং ফিল্ড চান?' পিএমএল-এন সুপ্রিমোর নির্বাসিত ও কারাগারের বছরগুলোর কথা উলেস্নখ করে মরিয়ম এ প্রশ্ন করেন। শনিবার গুজরাটে দলের যুব সম্মেলনে ভাষণ দেওয়ার সময় মরিয়ম বলেন, নওয়াজকে ২২ বছরে একবার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল, যখন তিনি জেলে ও বিদেশে থাকাকালে তার স্ত্রী আর মাকে হারিয়েছিলেন।

নির্বাচনের মাধ্যমে আরেকটি বেসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠা করা গেলে তা হবে পাকিস্তানে নির্বাচনের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতার পরিবর্তনের আরেকটি নিদর্শন- যা অতীতে কমই দেখা গেছে। দ্বিতীয়ত, নির্বাচনের পর নতুন পার্লামেন্ট ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যরা নির্বাচন করবেন দেশের প্রেসিডেন্টকে। বর্তমান প্রেসিডেন্ট আরিফ আলভির মেয়াদ শেষ হয়েছে গত সেপ্টেম্বরে। তিনি ইতোমধ্যে মেয়াদের পর ৮০ দিনের বেশি পার করেছেন। ইলেকটোরাল কলেজের ভোটে মানে পার্লামেন্ট ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের ভোটে নতুন প্রেসিডেন্ট দায়িত্ব নেয়ার আগ পর্যন্ত তিনি থাকবেন এ পদে। তিনি এ পদে থাকবেন, না অন্য কেউ তার স্থলাভিষিক্ত হবেন সেটা নির্ভর করছে পার্লামেন্ট নির্বাচনের ওপর। তৃতীয়ত, আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদে পরিবর্তন আসছে সেটাও একটি ফ্যাক্টর বটে। পাকিস্তানে সেনাবাহিনী একটা গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। আসন্ন নির্বাচনে কোনো দলের প্রতি তাদের কোনো বেস্নসিংস আছে কিনা তা আগামী দিনগুলোতে হয়তো স্পষ্ট হবে। তবে তারা নিরপেক্ষ ভূমিকা নিলে সেটা হবে একটি ভালো অর্জন। পাকিস্তানের নির্বাচনের সঙ্গে এ পরিবর্তনগুলোর একটা বড় ধরনের যোগসূত্র আছে। নির্বাচন অনুষ্ঠান যদি কোনোভাবে বাধাগ্রস্ত হয় তবে এসব পরিবর্তন প্রায় অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। নিয়মানুযায়ী সংসদ ভাঙার ৯০ দিনের মধ্যে রাষ্ট্রপতিকে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করতে হয়। কিন্তু সেখানেও বিরোধ বেঁধেছিল। দেশটির প্রধান নির্বাচন কমিশনার প্রেসিডেন্টকে সংশোধিত আইনের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছিলেন তিনি আর তারিখ নির্ধারণের ক্ষমতা রাখেন না। ৮ ফেব্রম্নয়ারি তারিখ ঘোষণার মধ্য দিয়ে তার অবসান ঘটেছে।

পাকিস্তানে নির্বাচন দিনটি এগিয়ে আসায় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দোলাচল বৃদ্ধি পেয়েছে এবং সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের জোটের শরিকরা এখন কার্যত নানা ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন সে কথা আগেই বলেছি। নির্বাচন নিয়ে আসলে কি হচ্ছে এমন প্রশ্ন করছেন বিশ্লেষকরা। সাংবিধানে তিন মাসের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতা থাকলেও সে ক্ষেত্রে বিদায়ী সরকারের দিক থেকে সুকৌশলে আরেকটি কাজ করা হয়েছে। সেটি হচ্ছে আদমশুমারির কাজ- যা বর্তমানে চলমান, শেষ হতে সময় লেগেছে কয়েক মাস। এরপর নির্বাচন সঠিক সময়ে হওয়া নিয়ে সাবেক সরকারের দুই প্রধান শরিক পিএমএল-এন ও পিপিপির মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। অন্যদিকে, কোণঠাসা ইমরানের দল পিটিআই চাইছিল যত তাড়াতাড়ি নির্বাচন করা যায়। আর নির্বাচন করা নিয়ে বিশেষ করে সময় নির্ধারণ নিয়ে খোদ প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বিরোধ বাঁধে নির্বাচন কমিশনের। যে আদমশুমারির কথা বলা হচ্ছিল তার ভিত্তিতে নির্বাচনী এলাকার সীমানা পুনর্নিরধারণ করার ফলে বদলে গেছে ভোটের হিসাব। বলা যায়, বেশ পরিকল্পিতভাবেই এমনটি করা হয়েছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ইমরান খানের জনপ্রিয়তা যেভাবে দিন দিন বাড়ছে, এটিকে অন্য খাতে প্রবাহিত করে নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে শাহবাজ শরিফের রেখে যাওয়া প্রশাসন নির্বাচন প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করতে চাইছে।

নওয়াজ শরিফ ও আসিফ আলী জারদারির কথা ইমরান খান প্রকাশ্যে উচ্চারণ করে থাকেন, তাদের দুজনের কেউই এখন প্রকাশ্যে তাদের নিজ নিজ দলের রাজনীতির দৃশ্যপটে না থাকলেও এ বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই যে ইমরান খানকে ক্ষমতা থেকে সরাতে তারাই মূল ভূমিকা পালন করেন। তাদের দুজনই জানেন যে, এই মুহূর্তে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে ইমরান খানকে পরাজিত করা খুবই কঠিন হয়ে পড়বে। এক ইমরানকে ঠেকাতে গিয়ে তাদের দিক থেকে হেন কোনো অপতৎপরতা নেই- যা করা হচ্ছে না। আসিফ আলী জারদারির রাজনীতিবিদ হয়ে ওঠা তার পত্নী বেনজির ভুট্টোর মাধ্যমে। অথচ স্ত্রী হত্যার জন্য প্রতিবাদী হতে দেখা যায়নি তাকে, এমনকি পাঁচ বছর তার দল পিপিপি রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকাকালে, এমনকি তিনি রাষ্ট্রপতি থাকলেও বেনজির ভুট্টোর হত্যার রহস্য উন্মোচিত হয়নি। যদিও তার ছেলে বিলওয়াল ভুট্টো বর্তমানে দলের চেয়ারম্যান, তার পরও বাবা হিসেবে দলটির মূল কৌশল তিনিই নির্ধারণ করেন। বিলাওয়াল এখন এসব হত্যাকান্ডের বিচারের বিষয়ে নতুন করে তদন্ত চাইছেন। সেটাও হবে একটা বড় পদক্ষেপ। নওয়াজ শরিফ নিজে শাস্তিপ্রাপ্ত হয়ে বিদেশে অবস্থান করে তার ভাই শাহবাজকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মনোনীত করে মূলত চাইছিলেন, যে কোনোভাবে ইমরানকে ঠেকিয়ে পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনে নিজেদের বিজয়কে আরও পোক্ত করতে। তিনি ইতোমধ্যে দেশে ফিরেছেন এবং দল জয়লাভ করলে তিনি আবার প্রধানমন্ত্রী হবেন এমনটাই জানা যাচ্ছে। পিপিপির নেতারা অবশ্য নওয়াজের এই ফেরাকে ভালো চোখে দেখছেন না। ফলে ভুট্টোকে ফাঁসিতে হত্যা হত্যার বিষয়ে তদন্তের বিষয়টি সামনে আনতে চাইছেন পিপিপি নেতা ও বেনজিরের সন্তান বিলাওয়াল, যিনি ছিলেন বিদায়ী কোয়ালিশন সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

পিপিপি চেয়ারম্যান বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি ১১ ডিসেম্বর বলেছেন, তার দল জুলফিকার আলী ভুট্টো, বেনজির ভুট্টো এবং রাষ্ট্রপতি জারদারির অর্জনগুলো অব্যাহত রাখতে সাধারণ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। তিনি বলেন, ১৯৭৩ সালের সংবিধান, ১৮তম সংশোধনী এবং এনএফসি অ্যাওয়ার্ড সবই পিপিপি দ্বারা জনগণকে দেওয়া উপহার এবং যারা এটি বাতিল করতে চায় তাদের আমাদের মুখোমুখি হতে হবে। আমরা একটি প্রকৃত 'জনগণের শাসন' প্রতিষ্ঠা করব এবং জনগণ যাতে তাদের অধিকার এবং ন্যায্য অংশ পায় তা দেখব। তিনি বলেন, বারো বছর আগে জারদারি পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টে জুলফিকার আলী ভুট্টোর বিচার বিভাগীয় হত্যা মামলা পর্যালোচনার জন্য একটি রেফারেন্স পাঠিয়েছিলেন। 'আমরা আশা করি, (প্রধান) বিচারপতি কাজী ফয়েজ ঈসা এই সুযোগটি ব্যবহার করবেন তার নিজের প্রতিষ্ঠানের ভুল সংশোধনের জন্য।

সাবেক কোয়ালিশন সরকারের দুই প্রধান শরিক মুসলিম লীগ (এন) ও পিপিপির মধ্যকার বর্তমান বিরোধটা কোথায় সেটা কিছু স্পষ্ট হয়েছে। প্রথমত, দুটি দলই রাজনৈতিক আদর্শের ধারায় পরস্পর বিরোধী। দুটো দলেই এককভাবে সরকারে ছিল। ফলে ইগোর একটা সমস্যা রয়েছেই। ইমরান খানকে হটাতে তারা একতাবদ্ধ হয়েছিল। এখন তারা আখের গোছাতে চাইছে। দ্বিতীয়ত, সর্বশেষ আদমশুমারির ফলাফলের আলোকে নতুন সীমানা নির্ধারণের ইসিপির ঘোষণাটি সাবেক জোটের অংশীদারদের সংঘর্ষের পথে ফেলেছে। পিপিপি ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন চেয়েছিল। পিএমএল-এন চেয়েছিল সীমানা নির্ধারণ শেষে নির্বাচন। তার পাশে আছে জোটের শরিক জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম-এফ। এ বিষয়ে পিএমএলের জয় হওয়ায় কার্যত নাখোশ পিপিপি। তাদের উষ্মার কথা আগেই বলেছি। পৃথকভাবে নির্বাচন করলে এবং নওয়াজ শরিফ বাড়তি কোনো সুবিধা পেলে তাদের মধ্যকার বিরোধটি আরো প্রকট হয়ে উঠবে সন্দেহ নেই। এসব বিষয়টি আরো স্পষ্ট হবে।

ঘোলাটে এই রাজনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পাকিস্তানের টালমাটাল অর্থনৈতিক অবস্থা। বন্যা পরিস্থিতিতে পর্যুদস্ত ছিল পাকিস্তান। ছিল ব্যাপক তারল্য সংকট। দ্য ডনের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, এ বছরের ফেব্রম্নয়ারিতে গত বছরের তুলনায় পাকিস্তানের মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়ায় ৩১ দশমিক ৫ শতাংশে। প্রায় ৮ মাসব্যাপী আলোচনার পর গত ১২ জুলাই পাকিস্তানের জন্য ৩ বিলিয়ন ডলার (৩০০ কোটি ডলার) ঋণ অনুমোদন করেছে আইএমএফ। এ জন্য পাকিস্তানকে করতে হয়েছে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি, করের অনুপাত বৃদ্ধির মতো শর্তপূরণ। প্রথম দফায় ১২ বিলিয়ন ডলার ঋণ পেয়েছে পাকিস্তান। পরবর্তী ৯ মাসের ভেতর বাকিটুকু পেয়ে যাবে। এখন দেশের তত্ত্ব্বাবধায় সরকারের প্রধানমন্ত্রী আনোয়ারুল হক কাকার বলেছেন, দেশের অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে উঠতে পেরেছে দেশ. যে কথা শুরুতে বলেছি। তার এই আশ্বাসবাণীতে জনগণ কতখানি আশ্বস্ত হতে পারবেন সেটাও ভাবনার বিষয় বৈকি।

এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানে স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে কি? বিষয়টাতে ধোঁয়াশাই থেকে যাচ্ছে- কেন না, দলগুলোর বিরোধ ব্যাপক রূপ লাভ করতে পারে বলে শঙ্কা রয়েছে। ডলার সংকট ও তারল্য সংকট থেকে পাকিস্তান বের হতে পারেনি। মুদ্রাস্ফীতির ফলে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিও সহসা রোধ করা যাবে না।

শাহবাজ শরিফের কোয়ালিশন সরকারের শরিকদের বিরোধ তাদের কোথায় নিয়ে যায় সেটা একটা দেখার বিষয়। আর পতিত ইমরান খানের দল পিপিপি কতখানি জন সমর্থন লাভ করতে পারে সেটার ওপরও নির্ভর করবে দেশের আগামী সরকার গঠনের বিষয়টি সেই সঙ্গে স্থিতিশীলতার বিষয়টি।

আহমদ মতিউর রহমান :প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে