সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা

হাসনাইন রিজেন, শিক্ষার্থী, হাটহাজারী সরকারি কলেজ হাটহাজারী, চট্টগ্রাম
  ১১ মার্চ ২০২৪, ০০:০০

আমরা যে শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছি, সেটা কি আসলে আমাদের জন্য ভালো না খারাপ তা কখনো চিন্তা করি না। আমাদের মনে কখনো প্রশ্ন আসে না, আমাদের শিক্ষা কারিকুলাম কারা তৈরি করছে? তাদের উদ্দেশ্য কি? আমাদের শিখানো হয়েছে যে, পড়াশোনা করলে আমরা ভাল চাকরি করতে পারব। ভালো থাকতে পারব। আসলেই কি পড়াশোনা করলে ভালো চাকরি করা সম্ভব? হয়ত হঁ্যা হয়ত না। তবে আমি না র পক্ষে থাকব। পড়াশোনা করলেই ভালো চাকরি পাওয়া সম্ভব না। তাহলে আমাদের দেশে এত শিক্ষিত বেকার থাকত না। আচ্ছা শিক্ষা কি শুধু চাকরির জন্যই হওয়া উচিত? না। শিক্ষা হওয়া উচিত জানার জন্য। যেনে নতুন কিছু সৃষ্টি বা আবিষ্কার করার জন্য। কিন্তু আমাদের বর্তমান বুদ্ধিজীবীরা কারিকুলামের মাধ্যমে আমাদের যে মেসেজ দিচ্ছেন, তা হচ্ছে তোমাকে শিক্ষিত হতে হবে শুধু চাকরি করার জন্য। পড়াশোনা করলে ভালো চাকরি করতে পারবে। ভালো থাকতে পারবে।

ছোটবেলায় পড়েছিলাম 'পড়াশোনা করে যে গাড়ি ঘোরায় চড়ে সে'। যদিও এটি একটি মোটিভেশান বাক্য ছিল। তবে আমি মনে করি, বাক্যটি হওয়া উচিত ছিল পড়াশোনা করে যে গাড়ি-পেস্নন বানাই সে। যে গাড়ি ও পেস্নন তৈরি করতে পারে, সে এমনিতেই এগুলো তো চড়তে পারে। আসলে পড়াশোনা হওয়া উচিত নতুন কিছু সৃষ্টি বা আবিষ্কার করার জন্য। অথচ আমাদের পড়াশোনা হয়ে গেছে চাকরিকেন্দ্রিক।

পড়াশোনা চাকরিকেন্দ্রিক হওয়ার পেছনে একটা শক্তি কাজ করে। যারা চায়, আমরা সব সময় তাদের গোলাম থাকি। তারা চায়, সব সময় আমাদের শাসন করুক, শোষণ করুক। তারা কারিকুলামের মাধ্যমে আমাদের প্রজন্মকে এমনভাবে শিক্ষায় শিক্ষিত করছে যে, যার মাধ্যমে আমরা তাদের প্রতি আনুগতশীল, আত্মসমর্পণকারী ও তাদের শক্তির কাছে সারা জীবন মাথানত করে থাকি। আমাদের উচিত, আমাদের শিক্ষা কারিকুলাম কারা প্রণয়ন করে, তাদের পরিকল্পনা বোঝা। আমরা হয়ত মনে করি, যারা শিক্ষা কারিকুলাম প্রণয়ন করে, তারা সবাই বাঙালি, তারা কেন এমন কারিকুলাম প্রণয়ন করবে, যার মাধ্যমে আমরা বিদেশি শক্তির কাছে মাথানত করে থাকব।

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার দিকে তাকালে দেখতে পাবো, আমরা দিন দিন বিদেশিদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে যাচ্ছি। সেটা হোক শিক্ষা খাত, চিকিৎসা খাত বা অর্থনৈতিক খাত। আমরা আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদের দিকে তাকালে দেখতে পাই, তারা উচ্চ শিক্ষার জন্য দেশ ছেড়ে বিদেশ পাড়ি দিচ্ছে। তাদের কাছে বিদেশে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে তারা দাবি করে, দেশে উচ্চশিক্ষা নেওয়ার তেমন কোনো সুযোগ নেই। উন্নত জীবনযাত্রার ব্যবস্থা নেই। আসলেই কি আমাদের দেশের সুযোগ নেই, নাকি তৈরি হতে দিচ্ছে না। এ প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে আমরা কেন বিদেশিদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে গেছি, তা জানতে হবে। জানতে হবে তাদেরও অনুগত চিন্তাধারায় বেড়ে উঠার কারণ।

আমরা যারা ভারতবর্ষের ইতিহাস সম্পর্কে পড়াশোনা করেছি, তারা হয়ত অনেকে থমাস ম্যালথাসের নাম শুনেছি। যিনি ছিলেন জন্মনিয়ন্ত্রণ তত্ত্বের উদ্বোধক, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও প্রভাবশালী দার্শনিক। এ ছাড়া ধ্রম্নপদী অর্থনীতির প্রবর্তক রিকার্ডো, জেমস মিল, স্যার জন স্টুয়ার্টের ন্যায় দার্শনিকদেরও নাম শুনেছি। যারা ছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অংশীদার ও ভারতবর্ষের প্রধান প্রধান শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অধ্যাপক। যারা তাদের চিন্তা-চেতনা ভারতবর্ষে প্রতিষ্ঠা করেছেন। ফলশ্রম্নতিতে আমাদের আইনব্যবস্থা, প্রশাসনিক কাঠামো, শিক্ষাব্যবস্থার সর্বক্ষেত্রেই ব্রিটিশ আমলের লাল ফিতার দৌরাত্ম্য বিদ্যমান। আর তা সম্ভব হয়েছে এ রকম বড় বড় চিন্তক ও দার্শনিকদের কারণেই। শিক্ষা খাত থেকে শুরু করে আমাদের সামগ্রিক রাষ্ট্র কাঠামোতে আজও সেই শোষণ বিদ্যমান।

আমরা যদি বর্তমান বাংলাদেশের অভ্যন্তরের সমস্যার সমাধানের দিকে লক্ষ্য করি, তাহলে আমরা কি দেখতে পাই? যেকোনো সমস্যার সমাধানে কেন সরকারি-বেসরকারি দলগুলো ইউরোপীয় ইউনিয়ন কমিশন, ব্রিটিশ-মার্কিন রাষ্ট্রদূতদের কাছে ছুটে যায় তারা। কারা জাতির বাজেট পেশ করে? কারা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পরিকল্পনা নির্ধারণ করে? কারা শিক্ষা কারিকুলাম নির্ধারণ করে? কারা দেশের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সাজিয়ে দেয় এবং নিয়ন্ত্রণ করে? লক্ষ্য করলে দেখতে পাবো, সবাই ওই পাশ্চাত্যের চিন্তা-চেতনায় বেড়ে ওঠা চিন্তক বা বুদ্ধিজীবী। যুগ আর সময়ই পাল্টালেও শোষণ আর শাসন রয়ে গেছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মতো। কারণ, আমরা তাদের শিক্ষাই শিক্ষিত হচ্ছি। দিন শেষে আমরা পাশ্চাত্য চিন্তা কাঠামোর বাইরে চিন্তা করতে পারছি না স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরও।

আর এই শিক্ষাব্যবস্থার কারণে আমরা আমাদের দেশের মেধাবীদের মূল্যায়ন করতে পারছি না। আমাদের পড়াশোনার মূল বিষয় হয়ে দাঁড়ায় যে কোনোভাবে ভালো একটা জীবিকার ব্যবস্থা। আর এই সুযোগ লুপে নিয়ে আমাদের মেধা সম্পদগুলো ছিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছে পশ্চিমা দেশগুলো। তাদের লোভ দেখানো হয় উন্নত জীবনযাপন ও নানা বিধির সুযোগ-সুবিধার। আর আমাদের দেশের তরুণ মেধাবীরা সেই দেশে গিয়ে স্বাভাবিকভাবেই পশ্চিমাদের অনুবর্তী ও তোষণকারী হয়ে ওঠে। আমাদের দেশের এই মেধাবীদের তৈরি করে নেওয়া হয় তাদের চিন্তাধারায়। ফলে এসব দেশ থেকে যারা পড়াশোনা করে আসে, তারা তাদের ধাঁচের বুদ্ধিজীবী হিসেবে গড়ে ওঠে। মেনে নেয় পাশ্চাত্যের দাসত্ব।

আমাদের তরুণ প্রজন্মের সঙ্গে চিন্তা-চেতনায় আমাদের বুদ্ধিজীবীদের যে দূরত্ব, তার কারণ কিন্তু তারা নিজেরা না, এর জন্য দায়ী আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা। আমরা যে শিক্ষাব্যবস্থা ও পরিবেশে বড় হচ্ছি, এর কারণেই আমরা আমাদের শক্তি বা চিন্তা-চেতনার প্রসার ঘটাতে পারছি না। একটি জাতিকে আত্মসমর্পণকারী বা দাসত্ব করে রাখার জন্য লোহার শিকল প্রয়োজন পড়ে না। একটি জাতির শিক্ষিত বিভাগ ও ইচ্ছাশক্তিকে প্যারালাইজড করতে পারলেই ওই জাতি সারা জীবনের জন্য আপনার অনুগত থাকতে বাধ্য হবে। গভীরভাবে দৃষ্টি দিলে দেখতে পাবেন, বর্তমান শিক্ষা কারিকুলাম ও সিলেবাস আমাদের তরুণ প্রজন্মের মেধা বা চিন্তা শক্তিকে ঠিক যেন প্যারালাইজড করে দিচ্ছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে