কৃষি এবং চাষাবাদের উন্নয়নে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। জনসংখ্যার দ্রম্নত বৃদ্ধি এবং খাদ্যের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটানোর জন্য কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে এসব রাসায়নিকের ব্যবহার এখন অপরিহার্য বলে বিবেচিত হচ্ছে। কিন্তু এই আধুনিক কৃষি পদ্ধতির ভয়ংকর পরিণতি হলো, রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের অতিরিক্ত এবং অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। ফসল উৎপাদনে তাৎক্ষণিক লাভজনক ফলাফল পাওয়া গেলেও দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যঝুঁকি এবং পরিবেশের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব অত্যন্ত গুরুতর।
মাটির উর্বরতা বাড়াতে রাসায়নিক সার ব্যবহৃত হলেও এর অবাধ ও অধিক মাত্রায় প্রয়োগে মাটির স্বাভাবিক পুষ্টিগুণ নষ্ট হয়। সার ব্যবহারের মাধ্যমে জমির উৎপাদনশীলতা তাৎক্ষণিকভাবে বাড়লেও মাটির জীববৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে, কৃষিজমির ওপর নির্ভরশীল প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্য এবং মাটির প্রাকৃতিক গঠন পরিবর্তিত হতে শুরু করেছে। রাসায়নিক সারের উপাদানগুলো জমিতে জমা হতে হতে পরিবেশে বিপজ্জনক ভারসাম্যহীনতা তৈরি করে। এর ফলে, পরিবেশের সুস্থ প্রাকৃতিক চক্র ধ্বংস হয় এবং ক্ষতিকর প্রভাবগুলো ধীরে ধীরে মানুষের দেহে প্রতিফলিত হয়। রাসায়নিক সার ও কীটনাশক সরাসরি খাদ্যচক্রে প্রবেশ করে- যা আমাদের শরীরে বিষক্রিয়ার সৃষ্টি করে। খাদ্য ও পানীয়ের মাধ্যমে এই রাসায়নিকগুলো আমাদের শরীরে প্রবেশ করে এবং নানারকম দীর্ঘমেয়াদি জটিলতার জন্ম দেয়। কীটনাশকের অতি ব্যবহারের ফলে যেমন কৃষি জমিতে থাকা উপকারী পোকামাকড় মরে যায়, তেমনি এই রাসায়নিকগুলো ফসলের ওপর লেগে থাকার কারণে খাদ্যচক্রে প্রবেশ করে। ফলে, খাদ্যে বিষক্রিয়া ঘটে এবং তা আমাদের শারীরিক সুস্থতার জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়ায়।
এসব রাসায়নিকের প্রভাবে মানবদেহে নানা ধরনের শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়। প্রথমত, কীটনাশকের সঙ্গে যুক্ত কিছু রাসায়নিক যেমন ডিডিটি, অর্গানোফসফেট এবং গস্নাইফোসেটের মতো উপাদানগুলো ক্যানসার সৃষ্টির জন্য দায়ী। গবেষণায় জানা যায়, দীর্ঘসময় ধরে এই রাসায়নিক পদার্থগুলো মানবদেহে জমা হতে থাকে এবং ক্যানসার সৃষ্টির ঝুঁকি বাড়ায়। বিশেষ করে, লিভার, ফুসফুস ও পাকস্থলীতে এসব ক্যানসারের আশঙ্কা বেশি দেখা যায়। এছাড়া, এই রাসায়নিক পদার্থগুলোর প্রভাবে শ্বাসকষ্ট, অ্যাজমা এবং অন্যান্য শ্বাসতন্ত্রের সমস্যাও হতে পারে। কীটনাশক শরীরে প্রবেশ করলে ফুসফুসের অভ্যন্তরে প্রদাহ সৃষ্টি করে- যা দীর্ঘমেয়াদে শ্বাসতন্ত্রের মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে। বিশেষ করে, গ্রামীণ এলাকায় কৃষকরা নিয়মিত কীটনাশকের সংস্পর্শে থাকায় তারা শ্বাসকষ্ট ও অন্যান্য শ্বাসতন্ত্রের সমস্যার ঝুঁকিতে বেশি থাকে। রাসায়নিক কীটনাশক স্নায়বিক সমস্যারও কারণ হতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, কীটনাশকের দীর্ঘমেয়াদি ব্যবহারের ফলে মানুষের স্নায়ুতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়। স্নায়বিক সমস্যাগুলোর মধ্যে পারকিনসন্স ডিজিজ, স্মৃতিশক্তি হ্রাস এবং স্নায়ু দুর্বলতা উলেস্নখযোগ্য। এসব রোগের প্রভাবে কোনো ব্যক্তি দৈনন্দিন কাজকর্মে অক্ষম হয়ে পড়ে এবং মানসিক স্বাস্থ্যেরও অবনতি ঘটে। শুধু তাই নয়, রাসায়নিক কীটনাশক ও সারের প্রভাবে মানবদেহের এন্ডোক্রাইন সিস্টেমেও মারাত্মক ক্ষতি হয়। মানবদেহের হরমোনাল ভারসাম্য বজায় রাখার প্রক্রিয়ায় এই রাসায়নিকগুলো বাধা সৃষ্টি করে। ফলে, নারীদের ক্ষেত্রে মাসিক চক্রের অসামঞ্জস্য, গর্ভধারণে সমস্যা এবং গর্ভপাতের ঝুঁকি বাড়তে থাকে। পুরুষদের ক্ষেত্রে বীর্য উৎপাদনের ক্ষমতা হ্রাস এবং স্পার্ম কাউন্ট কমে যাওয়ার মতো সমস্যাও দেখা দেয়। প্রজনন ক্ষমতায় এই ধরনের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব সমগ্র মানবজাতির জন্য এক গুরুতর সংকটের সৃষ্টি করতে পারে। গবেষণায় আরও জানা যায়, গর্ভাবস্থায় রাসায়নিক কীটনাশকের সংস্পর্শে আসার ফলে গর্ভস্থ শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এর ফলে, শিশুরা জন্মগত ত্রম্নটি নিয়ে জন্মগ্রহণ করে এবং তাদের মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। দীর্ঘমেয়াদে এই সমস্যা শিশুদের শেখার ক্ষমতায়ও বাধা সৃষ্টি করে এবং তাদের মধ্যে আচরণগত সমস্যা দেখা দেয়। রাসায়নিক কীটনাশক ও সার ব্যবহারের ফলে শিশুদের বুদ্ধিমত্তা এবং একাগ্রতা হ্রাস পায়- যা পরবর্তী সময়ে তাদের শিক্ষাজীবন ও ব্যক্তিগত জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ক্ষতিকর প্রভাব শুধু মানুষ ও মানবদেহের ওপরই সীমাবদ্ধ নয়, পরিবেশেও ভয়াবহ প্রভাব ফেলছে। কৃষি জমিতে জমা থাকা রাসায়নিক উপাদানগুলো বৃষ্টির পানি ও ভূগর্ভস্থ পানির মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এবং আমাদের প্রাকৃতিক জলাধারগুলোকেও দূষিত করে। এর ফলে, নদী, পুকুর এবং অন্যান্য জলাধারে থাকা জলজপ্রাণিগুলোর জীববৈচিত্র্য হ্রাস পায়। মাছ ও অন্যান্য জলজপ্রাণির দেহে রাসায়নিকের প্রভাব পড়ায় তাদের খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করাও স্বাস্থ্যঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। এছাড়া, কীটনাশক ব্যবহারের ফলে পরিবেশের বায়ু দূষিত হয়। স্প্রে করা কীটনাশক বাতাসের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এবং তা মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর শ্বাসের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে। বায়ুদূষণের ফলে ফুসফুসের রোগ, শ্বাসকষ্ট এবং অন্যান্য শ্বাসতন্ত্রের সমস্যার ঝুঁকি বেড়ে যায়। এভাবে আমাদের পরিবেশ ধীরে ধীরে বিষাক্ত হয়ে উঠছে এবং এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব থেকে মুক্তি পাওয়া অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়বে।
এসব সমস্যার সমাধানে প্রথম এবং প্রধান পদক্ষেপ হতে পারে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার কমিয়ে আনা। এর বিকল্প হিসেবে জৈবসার এবং প্রাকৃতিক কীটনাশক ব্যবহারের প্রতি জোর দিতে হবে। জৈবসার ব্যবহার করলে মাটির স্বাভাবিক পুষ্টিগুণ বজায় থাকে এবং মাটির উর্বরতা রক্ষা হয়। জৈব পদ্ধতিতে চাষাবাদ করলে ফসলের উৎপাদন কিছুটা কম হতে পারে, কিন্তু তা স্বাস্থ্যকর এবং পরিবেশবান্ধব হবে। এছাড়া, প্রাকৃতিক কীটনাশক যেমন নিমপাতার রস, রসুনের নির্যাস এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক উপাদান থেকে তৈরি কীটনাশকগুলো ক্ষতিকর পোকামাকড় দমন করতে সক্ষম। এই ধরনের প্রাকৃতিক কীটনাশক ব্যবহারে মাটির জীববৈচিত্র্য বজায় থাকে এবং কীটপতঙ্গের ক্ষতি ছাড়াই ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। ইন্টিগ্রেটেড পেস্ট ম্যানেজমেন্ট একটি আধুনিক ও টেকসই পদ্ধতি- যা ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই পদ্ধতিতে প্রাকৃতিক এবং প্রযুক্তিগত পদ্ধতির সমন্বয়ে কীটনাশক ব্যবহারের পাশাপাশি কীটপতঙ্গের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এই পদ্ধতি ব্যবহার করলে কীটনাশক ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা কমে আসে এবং পরিবেশ ও মানবদেহের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব হ্রাস পায়। অন্যদিকে, অর্গানিক চাষাবাদ বর্তমানে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এই পদ্ধতিতে সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে চাষাবাদ করা হয় এবং রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। অর্গানিক খাদ্য স্বাস্থ্যকর এবং পুষ্টিগুণে ভরপুর হয়- যা মানুষের শরীরের জন্য উপকারী। এই পদ্ধতি গ্রহণ করলে খাদ্য উৎপাদনের পাশাপাশি পরিবেশের ভারসাম্যও বজায় থাকে।
এই ভয়াবহ বিপর্যয় থেকে মুক্তি পেতে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা অত্যন্ত জরুরি। রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। কৃষকদের বিকল্প কৃষি পদ্ধতি সম্পর্কে সচেতন করতে হবে এবং তাদের রাসায়নিকের ব্যবহার কমিয়ে জৈব চাষাবাদ ও অন্যান্য পরিবেশবান্ধব পদ্ধতির প্রতি উৎসাহিত করতে হবে। জৈব কৃষি সম্পর্কে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ এবং সহায়তা প্রদান করলে কৃষকরা রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের অতিরিক্ত ব্যবহারের ঝুঁকি সম্পর্কে আরও বেশি সচেতন হবেন এবং সেগুলো ব্যবহার না করে নিরাপদ পদ্ধতি গ্রহণ করবেন। এছাড়া, সরকারের উচিত কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ ও নীতিমালা প্রণয়ন করা, যাতে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহারে সুনির্দিষ্ট সীমাবদ্ধতা আরোপ করা যায়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ ধরনের আইন রয়েছে- যা রাসায়নিক পদার্থগুলোর উৎপাদন, বিক্রয় ও ব্যবহারের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে। শুধু উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এই ধরনের আইনের প্রয়োগ শিথিল থাকে- যা এই সমস্যাকে আরও জটিল করে তোলে। জনসচেতনতা ও আইনগত নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি গবেষণা ও উন্নয়নেও জোর দিতে হবে। কৃষিক্ষেত্রে বিকল্প পদ্ধতি ও টেকসই প্রযুক্তি উদ্ভাবনের জন্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও কৃষি বিজ্ঞানীদের সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। জৈব পদ্ধতি ও প্রাকৃতিক কীটনাশকের ব্যবহার আরও কার্যকর ও সহজলভ্য করতে হলে আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে ঐতিহ্যবাহী জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার সমন্বয় করতে হবে।
একটি সুস্থ ও সবুজ পৃথিবী গড়তে হলে আমাদের কৃষি পদ্ধতি এবং পরিবেশের মধ্যে একটি টেকসই ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে।
রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের অবাধ ও অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার আমাদের বর্তমান প্রজন্মের স্বাস্থ্যের ওপর যেমন মারাত্মক প্রভাব ফেলছে, তেমনি ভবিষ্যৎ প্রজন্মকেও ঝুঁকির মুখে ফেলে দিচ্ছে। আমাদের খাদ্য উৎপাদন পদ্ধতিকে টেকসই এবং পরিবেশবান্ধব করতে হলে, রাসায়নিকের ব্যবহার থেকে বেরিয়ে আসতে হবে এবং বিকল্প, নিরাপদ পদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে। এজন্য প্রয়োজন সমন্বিত প্রচেষ্টা সরকারি, বেসরকারি এবং সাধারণ জনগণের মধ্যে। কৃষি খাতের উন্নয়ন এবং পরিবেশ রক্ষার জন্য একটি সুদূরপ্রসারী এবং টেকসই পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে- যা আমাদের আগামী প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ এবং স্বাস্থ্যকর পৃথিবী নিশ্চিত করবে।
আবু হেনা মোস্তফা কামাল :চিকিৎসক ও লেখক